![]() |
ও বাড়িতে রাখা আছে রসগোল্লার হাঁড়ি। যাবি ? .... খাবি ? যাই চল তাড়াতাড়ি গিয়ে সব সাবার করি। বন পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে ওইখানে সেই বাড়ি। খবর এনেছে রাজামশাই। আয় লাইন দিই। আজ আর ইস্কুল নেই। রসগোল্লার খোঁজ, তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ি সবাই। মিলবে না রোজ রোজ, ল্যাণ্ডাব্যাণ্ডা, যে যেখানে আছে। এই বলে রাজার পিছু নিল পিঁপড়ের দল।
রাজা পিঁপড়ে লালা ফেলতে ফেলতে পথ করে এসেছিল। সেইপথে ঝিঁ ঝিঁ পাড়ার পিঁপড়ে পরিবার। জোনাকী পাড়ার পিঁপড়ে পরিবার, গুবরে পাড়ার, মশফ পাড়ার, এরকম বিভিন্ন পাড়ার থেকে চলে এল শয়ে শয়ে পিঁপড়ে পরিবার। এত বড়ো হাজার লাইনের সারি সঠিকভাবে পরিচালনা করে সেন বাড়ির রসগেল্লার হাঁড়ি অবধি পৌঁছানো কি চাট্টিখানি কথা ? রাজা পিঁপড়ের হুকুম ‘পেরোতে হবে অনেক পথ। মিনিটখানেক চলার পরে আগডুম-বাগডুমের জঙ্গল। পেরোতেই হবে, করছি শপথ। জঙ্গল পেরোলে পড়বে গুপ্তিপাড়ার মাঠ, বেঁধে নাও আঁটঘাট। মাঠের শেষপ্রান্তে জল্লাদ সেনের বাড়ি। চলো যাই ঘন্টাখানেকের যাত্রা তাড়াতাড়ি।
জল্লাদ সেনের আসল নাম জওহরলাল সেন। সেন বাড়ির কর্তা। আচার ব্যবহারে সকলে ওকে জল্লাদ সেন বলেই ডাকে। অবশ্য সামনে নয় আড়ালে আবডালে। বাড়িতে কাকপক্ষী বসার জো নেই। একবার জবা গাছের পাতা খেয়েছিল বলে আস্ত একটা ছাগলের ল্যাজ কেটে দিয়েছিল। এ হেন জল্লাদ সেন, থুড়ি জওহরলাল সেনের বাড়িতে দুর্গাপুজোর পর দুর-দুরান্ত থেকে মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজন বিজয়ার প্রণাম করতে এসেছেন। সবার হাতেই একটা করে রসগোল্লার হাঁড়ি, বাড়িটা একেবারে রসোময়। সেন বাড়ির হেঁসেলে সেন বউ, তিন ছেলের বউ, মেয়ে। আর বাচ্চা-কাচ্চা মিলে বাড়িটা গমগম্ করছে।
সেন বাড়ির রিমঝিম। ক্লাস থ্রি। আর ছোটো নাতনি ঝিলমিল। ক্লাস ওয়ান। বড়ো নাতি বাপ্পা ক্লাস সিক্স। ভারি দুষ্টু। সুযোগ পেলেই বোন দুটোকে চুল টেনে দৌড়য়। লুডু খেলায় হেরে গেলেই গুটিগুলো সব এলোমেলো করে দেবে। আর রিমঝিম ? পড়াশুনোয় একদম মন নেই। পড়তে বসে, রান্নাঘর থেকে চুরি করে আনা চিনির দানা সামনের জানলা থেকে পড়ার টেবিল পর্যন্ত লাইন দিয়ে সাজায় আর একটু পরেই লাইন দিয়ে চলে আসে সুড়সুড়ি পিঁপড়ের দল। ততক্ষণে ঝিলমিলের পড়া শেষ। দিদির দুষ্টুমি দেখে বলে, দাঁড়া এক্ষুনি বম্মাকে গিয়ে বলছি।
-না, না বলিস না। কখনো দেখেছিস পিঁপড়েরা কী সুন্দর লাইন দিয়ে খেতে আসে। লাইন করে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়! এই সব গল্প বলে থামিয়ে দেয়।
আর একটা ব্যাপার হল বাপ্পা মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে বড়োরা দেবার পরেও ওকে চুরি করে খেতে হয়। অন্ধকারে রান্নাঘরে ঢুকে রসগোল্লা খেতে গিয়ে তো উল্টে পড়েই গেল ও, হাড়িটাও উল্টোলো। রসে এতক্ষণে স্লাবের ওপরটা যে কী অবস্থা হয়েছে কে জানে ? কাল সকালেই পিঁপড়েরা লাইন দেবে।
দাদু জানলে যে কী করবে ? সেবার দাদুর
পুরোনো বইয়ের পিছনের র্যা কে নেংটি ইঁদুরগুলো কাগজ কুঁচিয়ে ফুলঝুরির মতো বাসা
বানিয়ে ছিল। তাতে কী সুন্দর গোলাপী রং-এর ছোটো ছোটো বাচ্চা। বাপ্পা, ঝিমঝিম্, ঝিলমিল সবাই মিলে পুরোনো বইয়ের ব্যাগটা খুলে
দেখত। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো একটু একটু করে নড়ছে। রিমঝিম তো কেঁদেই ফেলল। যখন দাদু
সবশুদ্ধ বিদায় করল।
কাল সকালে যে কী অবস্থা হবে! এক গাদা পিঁপড়েতে রান্নাঘর ভরে যাবে। কই পাশেই মিত্রির বাড়িতে তো এরকম হয় না। অনায়াসে ছাগল ঢুকে পড়ছে ও বাড়িতে। কেউ তো তাড়ায় না! সকাল ছ‘টায় মিত্তির ঠাকুমা গম ছড়িয়ে মুড়ি ছড়িয়ে পায়রাদের ডাকে।
বিল্টুদের বাড়ির পায়রাগুলো ওবাড়িতে এসে গম খেয়ে যায়, বকবকম করে করে ভোরের ঘুম ভাঙায়। দুপুরবেলা ভুলো, লালু তিন চারটে নেড়ি কুকুর খেতে আসে, আর বেড়ালগুলোর তো সবসময় যাতায়াত। নেংটি বেড়ালগুরোর তো সবসময় যাতায়াত। নেংটি ইঁদুর , কাক কী নেই ওদের বাড়ি ? শালিকদুটোও তো রান্নাঘরের জানলা থেকে খাবার নিয়ে যায়। মিত্তির দাদু-সবাইকে কত ভালোবাসে। কাউকে কিচ্ছু বলে না। সে পশু হোক, প্রাণী হোক আর মানুষই।
ওদিকে রসগোল্লার রস জানলা দিয়ে গড়িয়ে নদীর মতো নামছে মাটিতে। বাপ্পা রাতে ঘুমোতে পারে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ। কি জানি রসগোল্লাগুলো ছিটকে ছিটকে যে কোনটা কোথায় পড়েছে কে জানে! ‘কি এত বিড়বিড় করছিস রে ? সারাদিন খেলবি, আবার রাত্রে সেগুলো আওড়াবি। এখন ঘুমো।' বলল বাপ্পার মা। সেন বাড়ীর বড়ো বউ। বাপ্পা ওপাশ ফেরে।
ওদিকে পিঁপড়ের মিছিল এগিয়ে চলেছে। গুপ্তিপাড়ারমাঠে। বড়ো গোল মাথাওয়ালা ডেউ পিঁপড়ে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘আর মাত্র ১৫মিনিটে পৌঁছাব সেন বাড়ি। তোমরা সারিবদ্ধভাবে ঢুকে ছড়িয়ে পড়বে রান্না ঘরে। তবেই পাবে রস। কেউ হই-হল্লা করবে না। রসের ভিতর গড়িয়ে গেলে, আসবে না কেউ কাউকে ফেলে। কথাটা প্রতিটি পিঁপড়ে মুখে মুখে চালান করে দেয় লাইনের শেষ পিঁপড়ে পর্যন্ত। এভাবেই তারা এগিয়ে চলে সেনবাড়ির দিকে।
এর মাঝে কত বাধা, কাঠ পিঁপড়ে, ডাশ পিঁপড়ে, গাছ পিঁপড়ে সবাই সুধোয় ‘যাচ্ছিস কোন চুলোয় ? কোন বাড়িতে মিছিল ?’ রাজা বলে- ‘বলব না, বলব না। মুখে দিয়েছি খিল’, এই বলে পিঁপড়ের দল কালো কালো মাথা কোমর দুলিয়ে এগিয়ে চলে। পথে ভ্রমর, মৌমাছি বলে, ‘করছিস ভুল, ফিরতে পারবি না। আমাদের সঙ্গে নে, বিপদ বুঝলে ফুটিয়ে দেব হুল। সেন বাড়ির জল্লাদ। মশা মাছি পিঁপড়েকে করে না রেয়াত।’ সে কথায় কর্ণপাত করে না রাজা পিঁপড়ে। ক্রমগতিতে এগিয়ে চলে পিঁপড়ের মিছিল।
অবশেষে সেনবাড়ির রান্নাঘরের জানলা বেয়ে লাইন দিয়ে ওপরে উঠে হেঁসেলের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে পিঁপড়ের দল। একজন আরেকজনের পিঠের ওপর উঠে রসগোল্লা খাচ্ছে। বুড়ো ও শিশু পিঁপড়েরা গড়িয়ে পড়া রসে একেবারে মশগুল। এতক্ষণে বড়ো বউ রান্নাঘরের দরজা খুলে ফেলেছে। ‘এ-কী, এ অবস্থা করল কে ? ইস্ পা-টা একেবারে চ্যাটচ্যাট করছে।’
বলতে না বলতেই রাজা দিল কুটুস করে কামড়ে। অমনি চিৎকার। ছুটে আসে সবাই। মেজো, ছোটো, মেয়ে, জামাই... এ-কী, একী অবস্থা ? সারা রান্নাঘর কালো থিকথিক করছে। সবাই বেশ বুঝতে পারে কালো বলগুলো আসলে এক একটা রসগোল্লা। চ্যাঁচামেচি শুনে চোখ রগরাতে রগরাতে উঠে আসে বাপ্পা, রিমঝিম, ঝিলমিল।
অবশেষে জওহরলাল সেন। ‘কে করল এ অবস্থা ?’ সেন গিন্নী বলল, ‘নিশ্চয়ই মিত্তির বাড়ির বেড়ালগুলো। বেড়াল, কুকুর নিয়ে যা আদিখ্যেতা ওদের।’ ঝিলমিল বলল, ‘কিন্তু ঢুকবে কোথা দিয়ে ?’ জল্লাদ সেন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, চটি, পেপার, লাঠি দিয়ে পিঁপড়ে নিধন আরম্ভ করল। বাপ্পার গলা শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু আাপাতত পিঁপড়ে নিয়ে সবার মাথা ব্যথা।
ওদিকে মিত্তির ঠাকুমা গম ছিটোচ্ছে। বকবকম করে করে পায়রারা খাচ্ছে। রিমঝিমের মনটা একটু খারাপ। মুখে ব্রাশ নিয়ে আনমনে রান্নাঘরের পিছনে গিয়ে দেখছে মরে যাওয়া পিঁপড়েগুলোকে। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে- এক বিরাট পিঁপড়ের মিছিল মরা পিঁপড়েগুলোকে মুখে করে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যায় কে জানে ? ওর চোখে জল সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। এদিকে রাজাকে অনুসরণ করে ওরা এগিয়ে চলেছে। বড়ো ডেউ পিঁপড়েটা মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে,
যাবার সময় ভেবেছিলাম, ফিরব মোরা সবাই।
সেন বাড়ির সে জল্লাদটা, করল দুশো জবাই
রাত ফুরোলো, দিন ফুরোলো, একশো গেল মরে
হাজার জনা ছিলাম মোরা সাতশ এলাম ফিরে।
তবুও হাজার সঙ্গে যাব, লড়াই করে, বাঁচব, খাব।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ডিসেম্বর ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ