![]() |
- প্রবাল সোম মারা গেছেন জানো তো, কাকু?
- মানে? দা বার্ডওযাচার
প্রবাল সোম? সে কি! কবে?
- কাল রাতে। খবরের কাগজে হয়তো কালকে বেরোবে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে
আমাদের ডাক পড়েছিল।
প্রবাল সোম বিখ্যাত পক্ষীবিদ। অনেক বইটই লিখেছেন। পাখি নিয়ে পড়াশোনা করতে
ভালোবাসেন ও সি নবীন করের কাকুও পাখি নিয়ে চর্চা করেন। তাই কাকুকে খবরটা বলা।
- এ হে-হে। বড়ো ভালো লোক ছিলেন। জীবনটাকে পাখিদের জন্য উৎসর্গ করে
দিয়েছিলেন। কি হয়েছিল রে নবীন?
- হবে আবার কি! ওনার তো বেশ ভালোই বয়স হয়েছিল। রাতের বেলা কোনো এক পাখির
সন্ধানে চলেছিলেন। পাহাড়ি পথ, তার উপর বৃষ্টি! পা পিছলে খাদে পড়ে যান।
বৃষ্টির জন্যে পথটার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। আমাদের লোকেদের খাদে নেমে তুলতে বেশ
কষ্ট হয়েছে, অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছিল।
- অত্যন্ত দুঃখজনক। উনি একা ছিলেন নাকি? ওই বয়সে অন্ধকারে
বৃষ্টির মধ্যে একা বেরোনো ঠিক হয়নি।
- না, আশ্চর্যের বিষয় উনি একা ছিলেন না। ওনার ছোকরা
সেক্রেটারি অধিকারী ছিল ওনার সঙ্গে। সে ওনার বাড়িতেই থাকে। নোট নেয়। ওনার বইয়ের
পাণ্ডুলিপি টাইপ করে। সেও পড়ে যেতে যেতে বেঁচেছে। পুলিশে ফোনটা সেই করে। ভীষণ ভয়
পেয়ে গেছে বেচারা। ওর কাছে স্টেটমেন্ট নিয়েছি। ব্যাপারটা নিছকই দুর্ঘটনা।
কাকুর কপালে ভাঁজ!- ঠিকই কি বলেছে ছোকরা মনে করে বলতে পারবি?
- দাঁড়াও স্টেটনেন্টটা ব্যাগে রয়েছে। রিপোর্ট তৈরি করব বলে এনেছিলাম। তোমাকে
পড়ে শোনাচ্ছি।
- আমি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দরজার ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল।
দরজা খুলে দেখি স্যার। প্রচণ্ড উত্তেজিত, প্রায় ঠকঠক করে কাঁপছেন।
বললেন, তরুণ তোমাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য দুঃখিত।
কিন্তু এই সুযোগ বারবার আসে না। আমাদের এক্ষুনি বাইরে যেতে হবে। ওয়ান্স ইন এ লাইফ
টাইম চান্স। ডাকটা শুনতে পেয়েছি আবার এবং আমি নিশ্চিত যে ওটা নর্দান হক আউল বা
সুরানিয়া ইউলুলা- সোজা বাংলায় বলতে গেলে বাজপাখি প্যাঁচা। ওদের এদিকে খুব একটা
দেখা যায় না। কিন্তু এবার পাহাড়ের শীত বেশি পড়েছে বলে হয়তো এরা এদিকে এসেছে।
উঠে বসলাম। চোখে-মুখে জল দিয়ে গরম জামা কাপড় পড়ে তৈরি হয়ে চললাম স্যারের
পিছনে। হুড়োহুড়িতে টর্চটা নিতে ভুলে গেলাম। স্যারের কাছে একটা টর্চ ছিল, কিন্তু কিছুদূর
গিয়েই সেটার ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেল। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে, কিন্তু রাস্তাঘাট
পিছল। হঠাৎ মনে হল ডাকটা খুব কাছেই। প্যাঁচাটা হয়তো স্বীকার করতে বেরিয়েছিল।
স্যার হাঁউমাঁউ করে এগিয়ে গেলেন, আর পা হড়কে গিয়ে... আমি কিছুই করতে পারলাম
না। স্যার-স্যার বলে অনেকক্ষণ ধরে ডাকলাম। কোনো উত্তর না পেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
বাড়ি ফিরে দেখি দুর্যোগে ফোন লাইনটা চলছে না। আমার তো মোবাইল ফোন নেই আর স্যারের
ফোনটা ওনার পকেটেই ছিল। কাজের লোক দিনকরকে ঘুম থেকে তুললাম। ওর মোবাইল থেকে
পুলিশকে ফোন করি। তারপর তো আপনারা জানেন।
কাকুর ভ্রু কুঁচকেই রয়েছে। নবীনকে বললেন, ওনার পকেটে সেলফোন ছিল?
- হ্যাঁ, অন-ই ছিল।
এক মিনিট দাঁড়া, আমি আসছি, বলে কাকু উঠে গিয়ে তাক
থেকে একটা বই নামিয়ে নিয়ে এলেন।
প্রবাল সোমের লেখা,- বলে পাতা উল্টে দেখে একটু পরেই বললেন, নবীন এখুনি তোর
লোকজনদের খবর দে। ওই তরুন ছোকরাকে ধর। এটা দুর্ঘটনা নয়, খুন!
- কিন্তু, কিন্তু আমরা তো কেস ক্লোজ করে দিয়েছি! প্রমাণ
কি বলব?
- প্রবালের সঙ্গে আমার বন্ধু দেবেনের চেনাশোনা আছে। উনি দেবেনকে বলেছিলেন যে, কিছুদিন হল কিছু
দুষ্ট চক্র এই এলাকার পাখি ধরে চড়া দামে বিক্রি করছে। ট্রপিক্যাল রিজনের বাহারি
রঙচঙে পাখির বিদেশে প্রচুর দাম। উনি তাদের ধরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছিলেন।
- সেতো বুঝলাম, কিন্তু প্রমাণ কোথায়?
- প্রমাণ এই যে, ওনার সেক্রেটারি তরুণ যে প্যাঁচাটার কথা বলেছে
সেই প্যাঁচাটা এই এলাকার দুর্লভই বটে তাতে ভুল নেই। ও হয়তো ইন্টারনেট বা কোনো বই
থেকে দেখেই ওই নামটা দিয়েছে। কিন্তু পাখিটার একটা বিশেষত্ব আছে যেটা ছেলেটার চোখে
পড়েনি! নর্দান হক আউল অন্যান্য প্যাঁচাদের মতো নিশাচর নয়। তারা দিনের বেলায়
খাবার খোঁজে। রাতেরবেলা অন্য পাখিদের মতো কোটরে ঘুমায়। আর কেউ না জানলেও
প্রবালবাবু সেটা নিয়ে ভুল করবেন না। উনি কোনোদিন রাতেরবেলা ওই প্যাঁচা খুঁজতে
যাবেন না। তাই ওর গল্পটা মিথ্যে। বন্দুক দেখিয়ে ওনাকে খাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ঠেলে
ফেলা হয়েছে, খুব সম্ভবত!
- কি সাংঘাতিক! বলে নবীন চট করে ফোন বার করে ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলতে
লাগলেন। কথা শেষ করে বললেন,- থ্যাংক ইউ, কাকু!
- না না, আমাকে থ্যাংক ইউ দিস না। তরুণ অধিকারীকে যে
পাখি পাচারকারী দলটা কাজে লাগিয়েছে তাদের ধরতে পারলে তবে আমার শান্তি হবে। নর্দান
হক আউল দেখাচ্ছিল! এবার জেলে পচে বুঝবে মজা।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বৈশাখ ১৪১৭ (এপ্রিল ২০১০)
0 মন্তব্যসমূহ