![]() |
শুনছো তোমরা, আমাদের আমতলীর সবেধন নীলমণি রিকশাওয়ালা মধুদা নাকি বুড়ো হয়েছে। আর তার রিকশাও। বুড়ো হয়ে দুজন নাকি বাড়িতেই বসে আছে। রিকশা নিমগাছে গরুর দড়ি দিয়ে বাঁধা, আর মধুদা নিজেও বসে আছে ভিটের সামনে বকুলতলায়। চন্দ্রমোহন বাড়ি ফিরল কলকাতা থেকে। সে পড়ছে নামকরা কলেজে, নম্বর আনছে ঝুড়ি ঝুড়ি। সেই নম্বর আবার কাউকে কাউকে দান করে দিচ্ছে। মধুদা বলেছে, সে কী করবে নম্বর, যদি তুফানের কোনো কাজে লাগে তো চাঁদুদা দিতে পারে, আর তুফানেরই বা কী কাজে লাগবে, বরং বকুলগাছে যিনি এয়েচেন, সেই সে যদি নেন, তো নিতে পারে।
বুড়ো হলে কী হবে, কথা তার তেমন আছে। চন্দ্রমোহন এসেছে ঠিক দুপুরে তার কাছে, যদি রিকশা নিয়ে একটু বসিরহাট খেলার মাঠে যাওয়া যায়। সেখানে আজ শাঁকচুড়ো স্পোরটিং বনাম ভ্যাবলা সম্মিলনির জোর ফাইনাল। শুনে মধুদা বলল, ইস্কুল ছেড়ে যে কলেজে গেলে কলকাতায়, কত নম্বর নিয়ে এলে বাপ-মার জন্যি?
সে হবেখন, চলো ইস্কুল মাঠে যাই, খেলাটা দেখে আসি।
না বুড়ো মানুষের যেতি নেই।
কে বুড়ো?
মধুদা বলল, কেন আমি আর আমার রিকশা তুফানবাবু কুমার মেল।
কত বড়ো নাম দিয়েছ তোমার রিকশার।
আরো আছে। বলে মিটি মিটি হাসতে লাগল শ্রী মধুসূদন দাস রিকশাওয়ালা, ওর অনেক নাম, ছিরিমান বুমবেক্সপেরেস নাথ মেল, বাবুহাসনাবাদ লোকাল মেল, কত।
হুঁ, সব হল রেলগাড়ির নামে। তবু ওর চলতি নাম তুফান মেল। তারা দুজনেই নাকি বুড়ো হয়ে গেছে, তাই বেরুনো বারণ। বুড়ো মানুষের কত কি হয়। শুনে চন্দ্রমোহন মানে কলকাতার কলেজে পড়া চাঁদুদা বলল, তোমাকে বুড়ো বলেছে কে বলো দেখি?
নির্বিকার মধুদা বলল, তা তো বলা যাবে না, ভাবতিছি এবার একটা লাঠি নেব হাঁটার টায়েমে।
কি অদ্ভুত। চুল পাকেনি, দাঁত পড়েনি শ্রী মধুসূদন দাস রিকশাওয়ালার, কদিন আগেও ডাকাত ধরেছে চাঁদুদার বাড়ির সামনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। সে এক কাণ্ড বটে। মাঝরাত্তিরে কাউকে একটা বুকে চেপে ধরেছিল মধুদা চন্দ্রমোহনদের বাড়ির পেছনে ভুতো বোম্বাই আমগাছের পেছনে, 'ডাকাত ডাকাত ডাকাত' করে চিৎকার জুড়েছিল। আর তা শুনে কেউ ঘর ছেড়ে বাইরে আসেনি। ডাকাতের কথা শুনে বুক উড়ে যায় না? যারা জানলা খুলেছিল, তারা পটাপট বন্ধ করে দিয়ে ঘরের ভিতরে বসে কাঁপতে কাঁপতে রাম নাম জপেছিল, রাম রাম রাম আম আম রাম। এই আমতলীর লোকের ডাকাত আর ভুতের খুব ভয়। আর দেখেছে রাম নাম নিলে ভূত আর ডাকাত দুই-ই পালায়। ভূতের সঙ্গে ডাকাতের এই মিল। আরো মিল কি নেই, ভূতে রাত্তিরে চরে বেড়ায়, ডাকাতের কারবারও রাতে। আরো মিল, ডাকাত মুখে আর গায়ে তেল কালি মেখে ভূত হয়েই তো বেরোয় তার কাজে। আরো মিল, ভূতের মতো ডাকাতও মন্তর বলে ফুস হয়ে যেতে পারে, বিশেষত মৌখালির নিধে ডাকাত। মধুদা সারাদিন রিক্সা নিয়ে ঝাউতলায় কি বকুলতলায় ঝিমোয়, আর কেউ চাপতে এলে বলে, আগি কড়ি পরে চড়ি। তার মানে আগে ভাড়া দাও, পরে গদি নাও। গদি হল রিকশার গদি। ওতেই তাদের দুটো পেট চলে যায়। দুটো পেট মানে, তার আর তুফান মেলের। সে শুধু তেল খায়। তেল চায়। তার সামনে তার প্রশংসা করলেই হল। আর চাকার গোড়ায় মানে তার তিন পায়ে তেল মাখালেই হল। মধুদা তো চন্দ্রমোহনের বাড়িতেই দুপুরে পাত পেতে বসে। আবার কোনো কোনো দিন যায় না, যষ্টি মাসে আম জাম লিচু, শ্রাবণ মাসে পাকা কাঁঠাল, ভাদ্র মাসে পাকা তাল... এইসব দিয়ে চলে যায়। এখন সে বকুলতলায় বুড়ো হয়ে বসে আছে। আহা মধু নাকি আচমকা বুড়ো হয়ে গেছে, চন্দ্রমোহনের মা দুপুরে মধুর জন্য ভাত পাঠায়। আহা রে এই সেদিন ডাকাত ধরল, এর ভিতরে বুড়ো।
ডাকাত ধরেছিল কি মধু সেই রাতে? কেউ বলে হ্যাঁ, কেউ বলে না। যারা না বলে তারা মধুকে দেখতে পারে না। কেন পারে না, কারণ তারা নিজেরা ছিঁচকে চোর বা ছিঁচকে ডাকাত। গাঁয়ের কেউ কেউ তো চুরি ডাকাতি করে। তবে লুকোছাপা করে। মধুসূদন দিনে ঝিমোয় রাতে রিকশা নিয়ে টহল দেয়, এই হয়েছে বিপদ। গাঁয়ের সিঁদেল চোর ভিন গাঁয়ে গিয়ে কাজ সেরে আসে। এই গাঁয়ে আর উপায় নেই। তবে শোনা যাচ্ছে সে বুড়ো হয়েছে, বকুলতলা থেকে নড়ছে না, এইবার যদি হয় হাতের কাজ, মধু তো আর চেপে ধরতে পারবে না।
হুঁ, কী হয়েছিল সেই রাতে, এই মাসটাক আগে যে মধু ধরল ডাকাত। আর ডাকাতের ভয়ে সবাই দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে রাম নাম করতে লাগল। চন্দ্রমোহন সেদিন কলকাতায় তার হোস্টেলে। রাম রাম করতে মা ফোন করেছিল, ও চাঁদু, মধু ডাকাত ধরেছে, কি হবে এখন?
ডাকাত না চোর মা? চন্দ্রমোহন জিজ্ঞেস করেছিল।
চোর কেন হবে বাবা, ডাকাত, ডাকাত বলে ভয় বেশি।
বাবা কোথায় মা? চন্দ্রমোহন এর মা বলেছিল, তোর বাবা তো হাসনাবাদের ওদিকে বরুণহাটে গেছে এক বিয়েবাড়ী। এই ফাঁকে ডাকাত এসে ঘুর-ঘুর করছিল বাগানে, তো মধু রিকশা প্যাঁক প্যাঁক করে ঘুরছিল, আর তাতেই দেখতে পেয়ে ধরেছে, চাঁদু আমার খুব ভয় লাগছে মধুর জন্য।
ডাকাতের ভয় যত না, চন্দ্রমোহনের মা শ্রী মধুসূদনের জন্য রাম নাম জপে ছিল কত সময়। আশপাশের বাড়ির লোকও সেই রাম নাম ডাকাতের নাম করে কাঁপছিল। অনেক সময় বাদে মধুর গলা আবার শোনা গিয়েছিল, মা ঠাইরেন, জানলা খোলেন, ডাকাত গেছে।
গেছে মানে? চন্দ্রমোহনের পাশের বাড়ির ছটাক চন্দ্র দাস তো মস্ত এক আট ব্যাটারির টর্চ হাতে বেরিয়ে এসে বলেছিল, নেই মানে, তুই ধরে রাখলিনে কেন, আজ গাছের সঙ্গে বেঁধে জলবিছুটি লাগাতাম।
তার ভাই কাচ্চা দাস বলেছিল, গালে থাপ্পর মেরে হাতের সুখ করতাম, ডাকাতি ওর ঘুচিয়ে দিতাম, আমরা ছটাক কাচ্চা দুই ভাই।
হুঁ, শ্রী শ্রীমধুসূদন বলেছিল, ছটাক কাচ্চা দুই ভাই... ওজনের কোনো ঠিক নাই।
এই কী বললি আবার বল দেখি।
শ্রীমধুসূদন বলেছিল, সে আসবে বলে গেছে, আমার কাছে কাকুতি করতে লাগল মিনতি দেখাতে লাগল, বলল, একটু ঘুরে আসতে হবে, মোবাইলে খপর এয়েছে তার মেয়ের জ্বর বেড়েছে, জ্বর যদি না বাড়ে আবার কাজে আসবে।
শুনে তুই ছেড়ে দিলি? ছটাক চন্দ্র হম্বি করল আর কাচ্চা চন্দ্র তম্বি, তোরেইতো পুলিশে দেওয়া দরকার, ডাকাত ধরে ছেড়ে দিলি।
চল, নে চল পুলিশে, সে ডাকাতের মেয়ের জ্বর যদি কমে যায়, তবে আসবে, আর এলি তারে আর আমি ধরব না। কেন ধরবি নে, হাতে পেয়েও ধরবি নে?
না শুধু আমি দেখে যাচ্ছি, চাঁদুদাদের বাড়ির কেউ পুরুষ মানুষ নেই, সে বাড়িতে ঢোকবে না, কথাও আছে তাই, চল চটাকদা, পুলিশে দিবা চল।
তার মানে?
মানে কিছু না, ছটাক কাচ্চা গদিতে বসো, আমি জামতলায় যাই।
জামতলায় হল থানা। সেখানে যাবে সে ছটাক কাচ্চা নিয়ে। তারপর জেলে ঢুকবে। তার আগে থানার পাল্লায় ওজন হবে ছটাকদা কাচ্চাদার। যদি কম হয় তো থানাদার গোটা গোটা দানাদার খাইয়ে ব্যবস্থা নেবে। শুনে ছটাক কাচ্চার হম্বিতম্বি গেল। তারা বলে, মধু তুই আমার বারান্দায় শুয়ে থাক, সকালে খেয়ে যাবি।
না ছটাকদা, তুমি থানায় চলো।
না না, ওটা কথার কথা, এমনি বলেছি।
এমনি কেন বললে, এমনি চল থানা গোড়ায়, সে লোকের খুব টাকা আর মালপত্তরের দরকার, তার মেয়ের অসুখ কিনা, বড়ো হাসপাতালে দেখাতি হবে, বড়ো ডাক্তারের খুব খাঁই, তুমি আমার সঙ্গে থানায় গিয়ে খপর দাও, এর ভিতরে সে কাজ করে যাবে, বাড়ির বৌদিমনিদের ঠিক করতি বল কি কি দেবেন, ক'য় ভরি গয়না, ক'খানা কাঁসার থালা, গেলাস বাটি গামলা, রূরোপ বাসনও তো আছে তুমার ঘরে। তুমাদের বন্ধকী কারবার কতদিনের, গতকালের। যাও বাড়ি গে ঠিক করি এসো, আমি রিকশা নে দাঁড়াই আছি, থানায় খপর দেব, থানায় কাল দুকুরের আগে দারোগার টিকি দেখতি পাবা না। কনিস্টবলও আসবে না, নিধে ডাকাত তার আগে কাজ করে যাবে। মেয়েডার অসুখ কিনা, সেজন্যি টাকা চাই কিনা।
তখন কাচ্চা আর ছটাক চন্দ্র মধুসূদনের হাত ধরে এ কাকুতি ও মিনতি করতে লাগল।
ছটাক কাকুতি করলে কাচ্চা মিনতি করে। আবার কাচ্চা মিনতি করলে ছটাক কাকুতি করে।
মধুসূদন তখন থাকল ছটাকের বারান্দায় শুয়ে। তার আগে এক পেট জল দেওয়া ভাত কাগজি
লেবুর পাতা, নুন দিয়ে খেয়ে
নিল। রিকশার চাকায় সর্ষের তেল দিল ছটাকের ঘর থেকে চেয়ে। সবাই ঘুমোল নিশ্চিন্তে।
শুধু মাঝরাতে ছটাক চন্দ্রের বউ শুনতে পেল, মধু যেন কার সঙ্গে কথা বলছে, এই যাহ, মেয়ের জ্বর ছেড়েছে তো আবার চুরি ডাকাতি কেন,
চ তোরে বাড়ি দিয়ে আসি,
রিকশায় বস, কাল থেকে মাটি কুপতে যাবি শাঁকচুড়ো, চ চ।
তারপর রিকশার একবার প্যাঁক। চাকা গড়িয়ে গেল। ডাকাত নিয়ে শ্রী মধুসূদন চলল ডাকাতের বাড়ি। ছটাক চন্দ্রর বউ দু হাত জোড় করে ঠাকুর ঠাকুর করতে লাগল। তখন কাচ্চা ছটাক দুই ভাই, ভোঁসভসিয়ে ঘুমায় তাই।
আহা, এমন মধুসূদন কিনা বুড়ো হয়ে ভিটের সামনে বকুলতলায় বসে আছে, আর তার রিকশা নিমতলায়। মধুর কি হল, এক রাত্তিরে বুড়ো হল। অথচ মধু যেমন ছিল তেমনি আছে। তাহলে কী করে বুড়ো হল? ছটাকচন্দ্র সেই রাতের কথা ভুলবে না। তাকে ঠকিয়ে মধু এক থালা ভাত খেয়ে গেল। রাতে তার বারান্দায় থাকেওনি, কথা বলতে বলতে হাওয়া। সে ভাবে বাগে পেলে হয়, মধুকে দেখে নেবে। কিন্তু যে কিনা বুড়ো হয়েছে, তার উপর আর কি বদলা নেবে? আর একটা ব্যাপার হয়েছে, ছটাকচন্দ্রের বউ মিলি বা মিগ্রা শুধু বলছে, বন্ধকীর কারবার বন্ধ করে যার জিনিস তাকে ফেরত দিতে। ছটাক ভাবছে তাই করবে। আর এর ভিতরে মধুসূদন বুড়ো হল। দাঁত পড়েনি, চুল পাকেনি, বুড়ো হল। ছটাকচন্দ্র আর তার ভাই বলে বেড়াতে লাগল, বন্ধকীর কারবার তুলে দেবে। যার জিনিস তাকে ফেরত দেবে।
চন্দ্রমোহন কলকাতা থেকে এসে এই দেখে জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েচে মধুদা, এমন কী হল যে তোমায় বুড়ো হতে হল।
মধুদা বলে, কে জানে কী হল। তবে কিনা বুড়ো গলি এক জায়গায় বসে থাকতে হয়।
তাতে লাভ কী?
দরকার আছে রে ভাই চাঁদুদা, সেই যে সেই নিধে ডাকাত, সে আমার কথায় ডাকাতি ছেড়েচে, মাটি কেটে বেড়ায়, তাই দিয়ে সংসার চালায়। সে আমারে বলেচে একটা উপকার করতি।
কী হয়েছে, বলবে তো।
বলচি রে বলচি, নিধের মেয়ে মেয়ে ভালো হল। কিন্তু নব্বই বছরের ঠাকুমা গেল।
কোথায় গেল? চন্দ্রমোহনের গা কাঁপে যেন।
যমপুরে। উনি গিয়ে এই বকুল কাছে এসে আশ্রয় নিয়েচে। মধুসূদন নিব্বিকার গলায় বলল, খুব ভূতির ভয় ছিল ঠাকমার, সেই ভয়েই মরেচে।
আমি যাই। চন্দ্রগ্রহণ বলে।
কেন, যাবা কেন?
চন্দ্রমোহন বলল, তুমি ঐসব কথা রাখো।
তোমারও কি ভূতির ভয়? মধুদা জিজ্ঞেস করে।
না, তা কেন, আমি সায়েন্সের স্টুডেন্ট।
মধুদা বলল, ও তাই, ছাইনছে ভূত নাই, ভূত বিজ্ঞান ছেল শুনিচি।
ভূত বিজ্ঞান না, ভৌত বিজ্ঞান।
মধুদা বলে, ওই হল, যা পনের,তা পঁচানব্বুই।
না-না, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন।
মোটেই না, বুড়ি পঁচানব্বুই ছেল। আর মেয়ে তো পনের। মেয়ে ভৌত বিজ্ঞানে ভয় পায়। ভূতে তার কি ডর। আর বুড়ি তো পঁচানব্বুইয়ে ভূতের ভয়ে মরে গিয়ে আরো বিপদে পড়ল। জানত না, মরে গিয়ে ভূতের ডেরায গিয়ে পড়বে।
চন্দ্রমোহনের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে বটে, কিন্তু মধুদার কথা যে ফেলে দেওয়ার নয়। নিধে ডাকাতের মেয়ের জ্বর গেল, জ্বর এসেছিল তো ভূতের ভয়ে। তার জ্বর যেতে বুড়ির জ্বর এল। জ্বরে বুড়ি কুপোকাত হল পঁচানব্বুইয়ে। তাতেও কি তার নিস্তার আছে। নাতনির উপর টানে সে ঘুরঘুর করছিল নিধের ভিটের আশেপাশে। কিন্তু শুধু নাতনির কথাই বা কেন, বুড়ি মানে নিধে ডাকাতের মায়ের ভূতের ভয় মরণের পরেও গেল না। সে মরে গিয়ে ভূত হয়ে পুরনো আদ্যিকেলে ভূতের হাটে গিয়ে ভয়ে কাঁটা। এতখানি ঘোমটা দিয়েও নিস্তার নেই। যত রাজ্যির বিটকেলে অন্ধকার জমা ভূতের ভয়ে সে কুঁকড়ে গেল। তার চারপাশে স্কন্ধকাটা ভূতেরা খোনা গলায় কথা বলে। বুড়ি তার ছেলের ভিটেয় গিয়ে আস্তানা গাড়বে ভেবেছিল ভূতের ভয়। কিন্তু নিধে তো সন্ধে থেকে রাম নাম করে খোল-কত্তাল বাজিয়ে। তাতে বুড়ির আরো ভয় করে। মরে গিয়ে কী বিপত্তি!রাম নাম আার ভূত দুয়েই তার ভয়। তখন না পেরে সে মধুর কাছে এসে পড়ল। আমারে বাঁচা মধু, মরে গিয়ে ভূত ভূতের ভয় গেল না। তখন মধুই তাকে বকুল গাছে বাসা বেঁধে দিল। সেই গাছের ডালে বসে সারাদিন সে ঘুমায় আর রাত্তিরে দোল খায়, বকুল ফুল ঝরিযে দেয় মাটিতে। আদ্যিকেলে স্কন্ধকাটা, হাড়-কঙ্গালে আর অন্ধকার জমা মামদো হামদো ভূতেরা আর কিছু না হোক মধুরে খুব ভয করে। কেন ভয়, না মধুর মামা না পিসে ভূতের ওঝা ভোলামামা বা ভোলা পিসে। এমন সর্ষে বান মারে সে, গা জ্বলে যায়। তবুও সাবধানের মার কী, বুড়ি কেঁদেকেটে বলে যে, ও মধু তুই যাসনে, গেলি আমারে খেয়ে নেবে স্কন্ধকাটা আর আঁধারজমা ভূতের দল। আমি মরে যাব রে মধু, মরে যাব, ভূতেরা একবার আমারে শেষ করেচে, আবার করবে। তুই গাছ তলে বসে থাক মধু, আমি একটু আরামে ঘুমোই আর ঘুম ভাঙলে দোল খাই, বকুল ফুল ছড়াই।
তুমি তাই বসে থাকো মধুদা? গায়ে জেগে ওঠা রোঁয়া পরখ করতে করতে জিজ্ঞেস করল চন্দ্রমোহন।
হ্যাঁ দেখো, কত বকুল ফুল ছড়ায় বুড়ি সারারাত ধরে। ওই গন্ধে ভুত পালায়।
চন্দ্রমোহন বলে, তাই তো!
উপরে তাকাও, দ্যাকো কেমন ঘুমায় বুড়ি, দিনভর ঘুমায়।
চন্দ্রমোহনের উপরে তাকাতে সাহস হয় না। কিন্তু বকুল ফুলের গন্ধ নেয় সে বুক
ভরে। আহা! মধুদা বুড়ো হয়নি, বুড়োর ভান করে
ভূত পাহারা দিয়ে যাচ্ছে সকাল বিকাল। বকুল
ফুলের গন্ধে ভূত পালায়। শুনে রাখো এই কথা। বিশ্বাস না হয়, আমতলী যাও, দেখতে পাবে, গন্ধ পাবে।
অলংকরণ- রাহুল মজুমদার
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০
Topic : Ghost story in Bengali ভূত ভৌতিক
0 মন্তব্যসমূহ