Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ছদ্মবেশী ভূত ।। দেবনারায়ণ চক্রবর্তী



আমাদের পাশের বাড়ির নন্দ সাঁতরার চার ঘর ভাড়াটে। এক ঘর আমার পড়ার ঘরের পাশেই। মুখোমুখি দুটো জানলা খুললেই আমার আর ভাড়াটের ঘরের ভেতরটা পরিস্কার দেখা যায়। মাঝখানে ফুট-তিনেকের দূরত্ব।

একা একজন মানুষ। আসবাব বলতে তেমন কিছুই নেই। চৌকির বিছানা সকালে ঘুম থেকে উঠে গোল করে জড়িয়ে রাখে। সন্ধেয় ঘরে ফিরে বিছানাটা ছড়িয়ে নেয়। চৌকির ওপর মাথার দিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় আছে একটা ভাঙ্গা আয়না আর একটা চিরুনি।

কিছুদিন থেকে দেখছি একটা মুখে মাখার ক্রিম রয়েছে। ঘরের কোণে কয়েকটা টিনের কৌটো আর কাচের শিশি। রবিবার সকালে দেখি লোকটা ঘর ঝাঁট দিয়ে মোছে। ওই একদিনই।

বছরখানেক হল এসেছে লোকটা, কিন্তু আমার সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আমার ভাই বাঘার সঙ্গে ওর খুব ভাব। মানে মাঝে-মাঝে দেখি পাড়ার রকে বসে গল্প করছে। তা বলে বাঘার সঙ্গে কোনোদিন আমাদের বাড়ি আসেনি লোকটা। আমিও লোকটার বিষয়ে আগ্রহ দেখাইনি কোনোদিন। শুধু বাঘার মুখে নাম শুনেছি পঞ্চানন সাধুখাঁ। ডাকনাম পিনু। বয়েস চল্লিশের কোঠায় হলে কী হবে সমবয়সি কারো সঙ্গে পিনু কথা বলে না। বাঘার মুখেই শোনা।

মাঝারি উচ্চতা, কালো, চোখ দুটো ছোটো-ছোটো, লোকটার সঙ্গে নন্দর ফেলু মেয়ে টুম্পা কী যে গল্প করে কে জানে ? সন্ধেবেলা লোকটা কাজ থেকে ফিরলে টুম্পা মাঝে-মাঝে আসে দেখি। দুজন মিলে বোধহয় আচার-টাচার খায়। কেন না দুজনেই মুখে হুম টানে, আঙুল চাটে আর কী হাসি হাসে দুজনেই!

এক সন্ধেবেলা হঠাৎ পঞ্চাননের ঘর থেকে সোঁ-সোঁ শব্দ আসছে শুনে জানলা খুলে দেখি কেরোসিনের স্টোভ জ্বলছে। নতুন হাঁড়িতে ভাত বসেছে স্টোভে। পাশে নতুন কড়াই। নতুন ব্যাগ থেকে আনাজ মেঝেয় উপুড় করছে একটা লোক, তাকে দেখিনি কোনোদিন।

পিনু হৈ-হৈ করে ওঠে, এই কী করলি আরে ডিম ভেঙে যাবে তো।

ততক্ষণে আলু পেঁয়াজ রসুন ডিম গড়িয়ে সারা মেঝেয়। তখনই নন্দর হেংলী মেয়েটা লাফাতে-লাফাতে এল। বলে, তোমাদের ঘরে রান্না হচ্ছে পিনুদা ! বাব্বা, এই প্রথম। কী রান্না করবে গো ? ডিমের ঝোল ? আমি রান্না করে দেব ?

অপরিচিত লোকটা হেঁড়ে গলায় বলে, কেন আমিও রান্না করতে পারি।

-তাহলে আমাকে একটু ঝোল-আলু দিও।

বসে পড়ে টুম্পা। মেঝেয় ছড়ানো আনাজের ওপর চোখ বুলিয়ে বলে, এমা হলুদ কাঁচালঙ্কা আনোনি ?

-আরে সব আছে। বলে পিনু ঢোলা পাঞ্জাবির পকেট থেকে হলুদের প্যাকেট আর কাঁচালঙ্কা বার করে দেয়।

আমি জানলা বন্ধ করে দিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত এই রান্না-খাওয়া আর হুল্লোড় চলবে। সামনেই আমার পরীক্ষা। তাও ভাগ্যি রেডিও বা টেপরেকর্ডার চালাচ্ছে না।

খেতে বসেছে ওরা, জানলা খুলে দেখি আর এক নাটক। ডিমের ঝোলে নুন দেওয়া হয়নি। পিনু আর ওই লোকটা দিব্যি হাপুস-হুপুস খাচ্ছে। টুম্পাটাই চেঁচাচ্ছে, এমা আমি খাব কী করে। ঝোলে তো নুনই দাওনি!

লোকটা তেমনি হেঁড়ে গলায় বলে, তাতে কী হয়েছে। বড়ো বড়ো হোটেলে নুন লঙ্কা ছাড়াই তরকারি রান্না হয়। আমি একবার আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গ্রান্ড হোটেলে ঢুকেছিলাম। সেখানে খেতে গিয়ে দেখি-

টুম্পা ইতিমধ্যে হাঁক পেড়েছে মাকে নুন আনার জন্য। নন্দর বৌ তো এসে অন্যরূপ ধরে, মাঝরাত পর্যন্ত বাপু রান্না-খাওয়া নিয়ে এত হৈ-চৈ এ বাড়িতে চলবে না। তাছাড়া, আলোর জন্য তো একশো টাকা দাও মাসে। এত রাত পর্যন্ত আলো জ্বালালে আরো টাকা বাড়াতে হবে!

কদিনের মধ্যে ওদের ঘর গেরস্থালী জমে উঠল। বাড়িওলির ধমকানিতে কাজ হয়েছে। রান্না ওরা সন্ধেবেলাতেই সেরে নেয়। রাতের ভাত-তরকারি পরেরদিন সকালে পিনু খেয়ে কাজে যায়। ওর বন্ধু দুপুরে খায়। বিকেলে বাজারটা ওর বন্ধুই করে রাখে।

বাঘার কাছ থেকে জানতে পারলাম পঞ্চাননের নতুন বন্ধুটির নাম পান্নালাল। চেহারাটাও বেশ সুন্দর। মাথার চুল একটু পাতলা হলে কী হবে বেশ ফর্সা, লম্বা। ধূতির ওপর হাফসার্ট পরে। সচরাচর এই পোশাকে আজকাল কাউকে দেখা যায় না। হাওয়াই চটি পরে ফট্-ফট্ শব্দ করে হাঁটে। একটু বড়ো না হলে সিনেমার হিরো হতে পারত। মান্ধাতাপুর নাকি পান্নালালের বাড়ি। সেখানকার গল্প শুনে তো আমার ভাই একেবারে মুগ্ধ। পাড়ার লোকের সঙ্গেও ইতিমধ্যেই বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে পান্নালাল। দেখি তো কেউ হয়তো এক বাটি ডাল কেউ তরকারি কেউ ঝোলসহ এক টুকরো মাছ। বাড়িউলি পর্যন্ত খোঁজ-খবর নিয়ে যায় পান্নালাল খেল কিনা দুপুরে।

সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে জানলার দিকে চোখ পড়তে ভয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখি পঞ্চানন আর পান্নালাল জানলায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচিয়ে হাসছে। দুজনেরই মাথা ন্যাড়া। চোখগুলো দপদপ করে জ্বলছে। প্রথমটাতে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, পরক্ষণেই বালিশের নিচ থেকে টর্চটা নিয়ে ওদের মুখে আলো ফেলতেই পান্নালাল জানলার লোহার গারদ বাঁকিয়ে আমার জানলার বাইরে চলে এল! আমি টর্চটা ছুঁড়ে মারতে গেলাম, আমার হাত উঠল না।

পঞ্চানন খিক্-খিক্ করে হাসতে-হাসতে নাকি সুরে বলে, দেখ কেউ যদি ঘুনাক্ষরে জানতে পারে তাহলে তোর অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছিস। অনেক রাত হলেই আমাদের একটু হাত-পা ছড়িয়ে হাসতে ইচ্ছা করে। সারাদিন মানুষের পোশাক পরে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যায়।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি মেঝেয় পড়ে আছি। গা-হাত-পা পাকা ফোঁড়ার মতো ব্যথা।

আস্তে-আস্তে খাটে উঠে খোলা জানলা দিয়ে দেখলাম, পঞ্চানন আর পান্নালাল বসে বিড়ি টানছে। কী নিয়ে যেন কথা বলাবলি করছে আর হাসছে। সে কী হাসির গমক পঞ্চাননের গলায়! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার। খুব চিন্তা হতে লাগল গতকাল রাতের ব্যাপারটা নিয়ে। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখলাম না তো ? কিন্তু আমি যে বালিশের পাশ থেকে টর্চ নিয়ে জানলা দিয়ে ওদের মুখে আলো ফেলেছিলাম, পরিস্কার মনে আছে।

কিছুদিন আর ওদিকের জানলাই খুলিনি। ঘটনাটা কাউকে বলারও সাহস হয়নি। তাছাড়া কেউ বিশ্বাসও করবে না।

সেদিন বিকেলে হঠাৎ পঞ্চাননের বাড়িউলি এসে বলে, সঞ্জু তুই একটু আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে পারিস ? তোর মেসো কেমন পেটের যন্ত্রণায় ছটফট্ করছে! পান্নালাল সঙ্গে যাচ্ছে কিন্তু তুই গেলে একটু ভরসা পাই। পঞ্চাননটা এখনও কাজ থেকেই ফেরেনি।

ডাক্তাররা বলল, নন্দর পেটে গলব্লাডারে পাথর খচখচ্ করছে, এখনই অপারেশন করা দরকার। রক্তের ব্যবস্থা করো। আমার এসব অভিজ্ঞতা নেই। পান্নালালও ফ্যাল-ফ্যাল করে ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে আছে।

নন্দর বৌ আঁচলে চোখ মুছে বলে, সঞ্জু তুই একটা ব্যবস্থা কর। ও গ্রামের ছেলে কলকাতার কোথায় কী আছে ও কী করে জানবে ?

আমি ফিরে এলাম ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে ওই গ্রুপের রক্ত না পেয়ে। পান্নালাল নিজের মাথার পাতলা চুলে বিলি কাটতে-কাটতে বলল, আমি দেখছি কী করা যায়।

আধঘন্টার মধ্যে পান্নালাল ফিরে এল দুজন ষণ্ডামার্কা লোককে সঙ্গে নিয়ে। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে এসে বলল, ওরা রক্ত দেবে টাকা দিতে হবে ওদের।

নন্দর বৌ তো আকাশ থেকে পড়ল, সেকী টাকা আমি পাবো কোথায় ?

পান্নালাল আশ্বাস দেয়, আচ্ছা মাসি আমি থাকতে তুমি এত চিন্তা করছ কেন বলো তো ? টাকা আমি সঙ্গে করেই এনেছি এসব চিন্তা করে।

আমি সাহস করে বলি, পান্নালালদা তুমিই তো রক্ত দিতে পারতে।

তখনই একটা লোক সিরিঞ্চ নিয়ে এল। রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে গ্রুপ মেলাবে।

পরপর দুজনেরই রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করে একজনের সঙ্গে রক্তের গ্রুপ মিলল। অন্যজনকে একশো টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল পান্নালাল।

নন্দর বৌ বারন্দার বেঞ্চিতে বসে খুন-খুন করে শাকচুন্নীর মতো কাঁদছে। পান্নালাল আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে এল। হাত চেপে ধরেছে আমার। মরা মানুষের মতো ঠাণ্ডা ওর হাত। অমনি সেদিনের মতো ধকধকে জ্বলন্ত চোখ। নাকি সুরে পান্নালাল বলল, শোনো সঞ্জুদা, ওপর চালাকি করতে যেও না আমার সঙ্গে। ভূতের আবার রক্ত থাকে ? আমার পরিচয় তুমি জানো না ? ন্যাকামী হচ্ছে! দেখো টাকার আমাদের অভাব হয় না। সার্জারির ওই যে বড়ো ডাক্তারটা এখনই প্রাইভেট চেম্বার করে ঢুকল, ওর নোট বোঝাই টাকার ব্যাগটা হাত সাফাই করে নিয়ে নিলাম। দেখো কত টাকা। তোমার কিছু লাগবে ?

যখন জ্ঞান ফিরল আমার, দেখি বারান্দায় পড়ে আছি। চোখ-মুখ, জামার কলার জলে ভেজা। পান্নালাল অমাকে তুলে এনে বেঞ্চে শুইয়ে দিল। নন্দর বৌ তো হাউমাউ করছে, কী হল সঞ্জু ওর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে অমন গোঁ-গোঁ শব্দ করে পড়ে গেলি কেন ? তোর আবার মৃগী রোগ হল কবে ?

প্রায় ছমাস হয়ে গেল পান্নালাল দিব্যি খাচ্ছে আর বেড়াচ্ছে। পাড়ার সব ছেলেদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। সারাদিন তো ওর কোনো কাজ নেই, আর টাকা-পয়সারও ওদের অভাব হয় না। সেদিন দুপুরে দেখি টুম্পার সঙ্গে কৎবেল মাখা খেয়ে হুস টানছে ঝালের চোটে। এই শীতেও পান্নালালের মুখ ঘেমে উঠেছে। খালি গা হাড়-জিরজিরে বুকের পাঁজর গোনা যায়। আমার চোখে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে দড়ি থেকে জামা টেনে গায়ে দিয়ে নিল।

আজ অসময়ে পঞ্চানন ঘরে ফিরল। সংসার ছড়ানো রয়েছে দেখে অত শান্ত মানুষও হৈ-চৈ করতে লাগল।

আর সেদিনই রাতেরবেলা কী নিয়ে যেন ওদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধল। সে কী তুমুল ঝগড়া। শুধু শুনলাম পঞ্চানন বলছে পান্নালালকে, যা দূর হ আমার ঘর থেকে। এখনই এই রাতেই বেরিয়ে যা!

-তুই আমার ছোটোবেলার বন্ধু এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছিস!

অনেক রাতে পান্নালালের ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলাম। চোখ পিটপিটিয়ে দেখলাম পান্নালাল মানুষের মতো সেই হাফসার্ট আর ধূতি পরে। আমার জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নাকি সুরে বলল, সঞ্জুদা আমি চলে যাচ্ছি। তোমার আর ভয় পাবার দরকার নেই। পঞ্চাননের সঙ্গে দেখা করতে এসে খুব ইচ্ছে হল কদিন ওর কাছে থেকে যাই। ছোটোবেলার বন্ধু তো। তারপর কেমন মায়া পড়ে গেল। আমি পনের বছর আগে একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতাম, কাজ করতে-করতে আগুনে পুড়ে মারা যাই। আর পঞ্চানন মরেছিল রেলে কাটা পড়ে। গ্রামে ওর বিধবা মা একা থাকে। ওর টাকা গেলে তবে সে খেতে পায়। তাই মানুষ সেজে এখানে চাকরি করে। আমি অনেক বুঝিয়ে বললাম, চল আমার সঙ্গে, তোকে হাতসাফাইটা শিখিয়ে দেব। তা এত গোঁয়াড়, বলে, অসৎ পথের পয়সায় আমার মা বেঁচে থাকবে! আসলে তেইশ বছর বয়েসে ও মারা যায় তো, এখনও সেই বয়েসের হয়ে আছে। তুমি শুনছো তো সঞ্জুদা ?

আমি মিন্-মিনে গলায় বলি, হ্যাঁ-হ্যাঁ শুনছি। তুমি বলো।

-অনেকদিন আগেই আমি চলে যেতাম শুধু টুম্পার কৎবেল মাখার হাতটা এত ফাস্টকিলাস না! তাছাড়া ছোটোবেলার বন্ধু অমন করে বললে আর থাকা যায় ? ভূত বলে কী আমার মান-সম্মান নেই। মানুষ হলে না হয় অন্য কথা ছিল। মান-সম্মান ভোঁতা হত। তবে তোমাদের সঙ্গে থাকতে-থাকতে আমারও মাঝে-মাঝে ইচ্ছা করছিল তোমাদের মতো আবার মানুষ হয়ে যাই। কিন্তু তা তো আর হবার নয়। মানুষ হলে জীবনে অনেক মজা আছে। পঞ্চাননও মা মরে গেলে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ওর ভাব-গতিক দেখে আমার ভয় হচ্ছে, পঞ্চাননটা আস্তে-আস্তে না মানুষ হয়ে ওঠে। খিকখিক করে হেঁসে উঠল পান্নালাল। চোখ দুটো জ্বলতে লাগল ধক্-ধক্ করে। বলে, তবে ওর মা মরার খবর পেলে আমিই ওর ঘেঁটি ধরে নিয়ে যাব।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ