Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

টুকলুর বন্ধুরা ।। প্রদীপ্তা সরকার বড়ুয়া

 


টুকলুর বয়স নয়। থ্রিতে পড়ে। খুব ভালো ছবি আঁকে আর কমিকস পড়তে খুব ভালোবাসে। কালরাতে ছোটা ভীম পড়তে-পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। বইগুলো বিছানাতেই পড়ে আছে। ঢুলু-ঢুলু চোখে বই গোছাতে-গোছাতে টুকলুর মনে পড়ে গেল, আজ তো নতুন স্কুলে প্রথম দিন। এক দৌড়ে চলে গেল রান্নাঘরে মায়ের কাছে। ব্যস্ত হাতে মা টুকলুর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে একটা হাম্পি খেয়ে বলল, চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে হবে। স্কুলে যেতে হবে না ?

মিষ্টি হেসে মাথা ঝাঁকালো টুকলু।

একমাস হল টুকলুর বাবা কর্মসূত্রে বদলি হয়ে এসেছেন উত্তরবঙ্গের এই ছোট্ট-সুন্দর মহকুমা শহরে। নাম আলিপুর দুয়ার। এখানে টুকলুর নতুন স্কুলের আন্টিদের প্রথম দিনই খুব ভালো লেগে গেল। স্কুলটাও খুব সুন্দর করে সাজানো। চারিদিকে কত গাছ, কত ফুল, নানা রং-এ রং করা স্কুলের ক্লাসঘরগুলো। কিন্তু এত ভালোর মধ্যেও টুকলুর মনে একটাই দুঃখ নতুন কোনো বন্ধু হল না এখনো।

প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল টুকলু স্কুলে যাচ্ছে। তবুও কেন মনের মতো বন্ধু পেল না! বন্ধু না থাকলে কিছু কী ভালো লাগে ? লাগে না। এমনকী ছবি আঁকতেও ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না কমিকস পড়তেও।

যে বাড়িটাতে ওরা থাকে তার চারপাশের পরিবেশটা বেশ ভালো। গেটের পাশেই একটা মস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছ। তার পাশে ছোট্ট একটা বসবার জায়গাও আছে। আশেপাশের বাড়িগুলোও বেশ বড়ো বড়ো। পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় ছোট্ট একটা মাঠ। ওই এক চিলতে মাঠে বিকেলবেলা বড়ো বড়ো দাদারা ক্রিকেট খেলতে আসে। স্কুল থেকে ফিরে কখনো-কখনো আনমনে টুকলু ওদের খেলা দেখে। মনে-মনে ভাবে ওর মতো ছোটো-ছোটো ছেলেরা যদি ওই মাঠে খেলতে আসত তাহলে টুকলুও খেলত ওদের সঙ্গে। কত নতুন বন্ধু হত। কত মজা। ভাবতে -ভাবতেই কলিং বেলের আওয়াজ। ভাবনার পাখিটা জানলা দিয়ে পালালো আর বাবার আওয়াজ পেয়ে টুকলু একদৌড়ে বসার ঘরে।

সারা সপ্তাহে রোববারই একমাত্র একটু বেশি ঘুমোয় টুকলু। এদিন স্কুলের তাড়া নেই, তাই কোনো অ্যালার্ম বাজে না। মা আদর করে টুকলুকে জাগায়। ঘুম ভাঙতেই টুকলু দেখে মা গুনগুন করে গান করছে। মায়ের গান শুনতে টুকলুর খুব ভালো লাগে।

ব্রেকফাস্ট সেরে বাবার অনুমতি নিয়ে টুকলু ব্যাট-বল হাতে বেরিয়ে পড়ল। ডাইনিং টেবিল থেকে মা চিৎকার করে বলল, টুকলু, নতুন জায়গা, বেশিদূর যেও না কিন্তু। হারিয়ে যাবে।

টুকলু ততক্ষণে গেট পেরিয়ে রাস্তায়। মাকে আশ্বস্ত করতে তার প্রত্যুত্তর, আমি ক্লাস থ্রি। ভয় পেয়ো না মাগো ...। ছড়া কাটতে-কাটতে তার আওয়াজ মিলিয়ে গেল বসন্তের বাতাসে।

এপাড়ার কিছুই চেনে না টুকলু। তবুও বীরপুরুষের মতো চলেছে। যেন কতদিনের চেনা জায়গা। ওদের বাড়ির পর তিনটে বাড়ি ছাড়িয়ে একটা সরু গলিপথ। সেই পথটাই আকর্ষণ করল টুকলুকে। আশ্চর্য, গলি পেরিয়েই সেই একচিলতে মাঠটা ! যেটা পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পায় টুকলু। মাঠে দাঁড়িয়ে সে একবার তাকালো বাড়ির দিকে। ওই তো তার পড়ার ঘরের জানলাটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একী! বড়ো দাদারা তো আজকে নেই। বদলে টুকলুরই বয়সী কয়েকটি ছেলেমেয়ে দৌড়দৌড়ি করে কী যেন খেলছে।

মনটা আনন্দে ভরে গেল টুকলুর। এইবার বন্ধু পাওয়া গেছে ভেবে যেই না দৌড়ে যাবে ওদের কাছে ওমনি পেছন থেকে মিনতি মাসি হাতটা ধরে টান দিল, আর বলল, বাড়ি যাবা না ? মা তোমাকে খুঁজ্তাছে। অভিমানী হয়ে টুকলু প্রশ্ন করল, তুমি ওদের সঙ্গে আমায় খেলতে দিলে না কেন ? মিনতি মাসি বলল, উদের সাথে খেলা করে না। উরা তো তোমার সমান না। এইখানে আর আইবানা। টুকলুর মন খারাপ হয়ে গেল। বাবা তো বলে সবাই বন্ধু হতে পারে। বন্ধু হতে কাউকে কারো সমান হতে হয় না। ছোটো-বড়ো সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব করা যায়। মিনতি মাসির কথা কিছুই বুঝল না টুকলু। হাত ছেড়ে একছুটে বাড়ি চলে গেল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দার ব্যালকনিতে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে বাবা জানতে চাইল সকালে টুকলু কোথায়-কোথায় গিয়েছিল, কি-কি করেছিল। টুকলু ওমনি সমস্ত ঘটনা বলে ফেলল। মিনতি মাসির ওপর তার অসন্তোষের কথাও জানাতে ভুলল না। কথাগুলো বলতে-বলতে টুকলুর চোখ বেয়ে অভিমানের জল গড়িয়ে পড়ল।

মা কোলে তুলে নিল টুকলুকে। আদর করতে-করতে জানালো মিনতি মাসির সঙ্গে কথা বলবে আর তাকে ওই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেবে। শুনে তো টুকলু মহাখুশি। মাকে একটা হাম্পি দিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। নতুন বন্ধু পাবে জেনে মনটা তার আনন্দে ভরে উঠল। আঁকার খাতাটা বের করে নিয়ে বসে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাতার পাতায় সেই নাম না জানা ভালোলাগা বন্ধুদের ছবি ভেসে উঠল, একচিলতে মাঠের মধ্যে তারা খেলা করছে।

আজকের দিনটা টুকলুর খুব ভালো কাটল। কারণ আজ স্কুলে রিনি আন্টি তার সঙ্গে অনেকের বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছে। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন খেয়েছে, কদমগাছের নিচে খেলেছে। খুব মজা হয়েছে স্কুলে আজ টুকলুর। বাড়িতে ফিরে খাওয়ার সময় সব বলল মাকে। নতুন বন্ধুদের নামগুলো একে-একে বলে ফেলল। টুকলুর পোশাকী নাম, যেটা সবাই ভালো নাম বলেই জানে তা হল দেবার্পন রায়, কিন্তু ওর নতুন বন্ধুরা ওকে টুকলু বলেই ডাকবে, সেকথাও মাকে জানাতে ভুলল না। ছেলের মনের প্রশান্তিতে মায়ের মুখেও ঝলমলে হাসি ফুটে উঠল।

সবকিছুর মধ্যেও টুকলু কিছুতেই ভুলতে পারেনি মাঠের বন্ধুদের কথা। পরিচয় না হলেও কেন জানি ওরা টুকলুর অনেক কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে। জানলা দিয়ে ও প্রায়ই ওদের খেলা দেখে আর ভাবে মা কবে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেবে। কবে সে একছুটে চলে যেতে পারবে ওদের কাছে। কিন্তু মা বলেছে, বড়োরা যা বলে সেটা শুনতে হয়। মিনতি মাসি তো টুকলুর থেকে অনেক বড়ো, এমনকি মায়ের থেকেও। কিন্তু এভাবে ভালো লাগছে না টুকলুর। মনটা কেমন করে ওঠে, একদৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে ওদের কাছে।

এদিকে টুকলুর মা সুযোগ বুঝে মিনতি মাসির কাছে জানতে চাইল, কেন টুকলুকে মাঠে যেতে বারণ করেছে। টুকলুর যে অভিমান হয়েছে সেকথাও জানালো। মিনতি মাসি জানালো ওই মাঠে যারা খেলে তারা গরীব ঘরের ছেলেমেয়ে। কারো বাবা স্কুলের গেটে আলুকাবলি বিক্রি করে, কারো-কারো বাবার চায়ের দোকান, ঠেলাগাড়িতে করে পাড়ায়-পাড়ায় ফুলের চারা বিক্রি করা পেশা। ওই ছেলেমেয়েদের দলে মিনতি মাসির ছেলে কমল আর টিয়াও আছে। ওরা কাছের একটা সরকারি স্কুলে পড়ে। ওসব গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা টুকলুর খেলার সঙ্গী হলে যদি ওর বাবা-মায়ের পছন্দ না হয়। যদি টুকলুকে বকাবকি করে।

টুকলুর মা মিনতি মাসির কথা থামিয়ে অবাক হয়ে বলল, এসব কি বলছ তুমি ? ওরা গরীব ঘরের বলে টুকলুর বন্ধু হতে পারবে না ? ওদের সঙ্গে খেললে আমি ওকে বকবো ? গরীব আর ধনী সে আবার কি রকম ? সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে শেখাটাই তো আসল। আর কখনো এমন ভাববে না।

কথার মাঝেই মিনতি মাসির চোখে জল চলে এল। চোখের জল মুছতে-মুছতে মাসি বলল, ভুল হইছে, আর কখনো অমন কথা কইবো না বৌদি। আমাকে মাফ কইরো।

মিনতি মাসির সঙ্গে মায়ের এই কথাবার্তার খবরটা টুকলু কানে পৌঁছল না।

বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে কিছু পাতা হাওয়ায় ভর করে দোল খেতে-খেতে এসে পড়ছে মেঝের কার্পেটে। দূর থেকে একটা কোকিলের কুহু..কুহু ডাক শোনা যাচ্ছে। বোধহয় মাঠের পাশের রাধাচূড়া গাছটা থেকে ডাকছে। হঠাৎ ভিডিও গেম থেকে চোখ উঠিয়ে টুকলু দৌড়ে গেল মার কাছে। জিজ্ঞেস করল, মা এটা কোন সিশ্ন ?

ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রেখেই মা গেয়ে উঠল, “এল ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত...

আর তখনই টুকলু লাফিয়ে উঠে বলল, বসন্ত মানেই তো দোল তাই না মা ? কবে দোল ?

ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বুলিয়ে মা জানালো, আর মাত্র দিন-দশেক বাকি। অফিস থেকে বাবা ফেরা মাত্রই টুকলুর হিসেব কষা শুরু। দোলের দিন কাদের-কাদের বাড়িতে ডাকবে, কি-কি রং কিনবে, কি খাওয়া হবে। এমনই আরো কত কি। হিসেব থেকে বাদ পড়ল না স্কুলের বন্ধুরাও। দেখতে-দেখতে চলে এল সেই দিনটাও।

দোল মানেই তো রঙের উৎসব। আর রং মানেই আনন্দে মন ভরে ওঠা। সেদিন সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে টুকলুদের বাড়িতে হাজির দাদান আর ঠাম্মি। আহ্লাদে একেবারে আটখানা হয়ে গেল টুকলু। তারপরে একে-একে নিমন্ত্রিতরা এল। সবার হাতেই রঙের প্যাকেট। আর তো কিছুতেই অপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু মা বারেবারেই বলছে, আর একটু অপেক্ষা কর, সবাই আসুক, একসঙ্গে রং খেলব।

টুকলুর হিসেবে আর তো কেউ বাকি নেই। বাবার অফিসের আঙ্কেলরা, টুকলুর ইস্কুলের বন্ধুরা আর তাদের বাবা-মা, উপরন্তু ঠাম্মি-দাদান সবাই তো এসেছে। তবে বাকি আর কে!

ঠিক তখনই হুড়মুড় করে গেট দিয়ে ঢুকছে মিনতি মাসি। একটু দেরি হইল বৌদি, বলে। আরে, ওরা কারা! অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টুকলু। মাঠের সেই বন্ধুরা না! যাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করেছিল মিনতি মাসি। কিন্তু ওরা এখানে কেন! অনেক প্রশ্নই টুকলুর মনের ভিতর জড়ো হয়ে এল। আর সেই সময়ই মিনতি মাসি এসে টুকলুকে বলল, নাও তোমার বন্ধুদের নিয়া আইসি। আর রাগ নাই তো আমার উপরে।

আনন্দে টুকলু জড়িয়ে ধরল মিনতি মাসিকে। ছুটে গেল ওই বন্ধুদের কাছে। ওরা রং নিয়ে এসেছে। টুকলুর গালে-কপালে রং মাখিয়ে দিল। তারপর সবাই মিলে খুব মজা করে দোল খেলল। নতুন বন্ধুদের সঙ্গে টুকলু পরিচয় করিয়ে দিল ইস্কুলের বন্ধুদের। ঠাম্মি-দাদানের সঙ্গেও সবার আলাপ করিয়ে দিল। টুকলু ভাবল এসব মিনতি মাসির কাজ। কিন্তু আসল আইডিয়াটা টুকলুর মায়ের। গতকাল রাতে ওর মা-বাবা দুজনে গিয়েছিল মিনতি মাসির বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে। তারপর সবার বাড়ি খুঁজে বাকিদেরও বলে এসেছিল।

সব বন্ধুদের একসঙ্গে পেয়ে দিনটা দারুণ কাটল টুকলুর। মায়ের হাতের দারুণ রান্না, ঠাম্মির গল্প আর রঙে-রঙে রঙিন হয়ে উঠল দিনটা। টুকলুর মনে হল এটাই ওর বেস্ট হোলি, খুশির দোল। সারাদিন খু-উ-ব আনন্দ করে বিকেলে সব বন্ধুরা যে যার বাড়িতে ফিরে গেল। টুকলু বসে গেল ছবি আঁকতে। ছবিটার নাম দিল দ্যা কালার ফেসটিবেল ইন মাই হাউস

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আগস্ট ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ