Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

তেরো নদীর পারে ।। বিপ্লব রায়



চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-করে ডাক দিল সাদা ধবধবে ঘোড়াটা। লম্বা দুটি ডানায় উড়তে-উড়তে ঘোড়াটি এসে থামল হরতকি বাগানে। অষ্টমীর রাতে রাজকুমারকে খুঁজে বেড়ায় সে হরতকি বাগানের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। ক্রমাগত ডানা ঝাপটায় ঝড় ওঠে হরতকি বাগানে। গাছপালা তছনছ হয়ে যায়। মাঝ আকাশে চাঁদ উঠলে তবেই শান্ত হয় সে। রাজকুমারের সমাধির পাশে বসে থাকে কিছুক্ষণ। চোখের জল ফেলে সমাধির ওপর। করুণ স্বরে আবার ডাকে, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ। সেই শব্দ গাছে গাছে প্রতিধ্বনিত হয়। আছড়ে পড়ে আমাদের দক্ষিণ দিকের প্রাচীরের ওপর। আশেপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। তারপর ভোরের দিকে আবার শূন্যে উড়তে-উড়তে সাতসমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলে যায়। খবরদার তোরা কেউ অষ্টমীর রাতে দক্ষিণ ঘরের জানালা খুলবি না। আমি বেশ কয়েকবার ওই দৃশ্য দেখেছি। কি ভয়ানক দৃশ্য রে! ভাবলে এখনো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ছোটোদের মাঝখানে বসে কথাগুলো বললেন গল্পদাদু।

বাগচি বাড়ির ছোটোরা শুধু নয় আশেপাশের পাড়াগাঁয়ের সবাই আশুবাবুকে গল্পদাদু বলেই ডাকে। বয়স তার আশি পার হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই। মাথার চুলগুলোই কেবল সাদা। এখনো শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটে।  হাতের ছড়িটি জমিদারি কায়দার অঙ্গ। মহালয়ার দিন থেকেই বাগচি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের সমাগম শুরু হয়ে যায়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনরা দুর্গাপূজার সময় এই বাড়িতে আসে। দুর্গোৎসব বলে কথা। প্রতি রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আশুবাবু ছোটোদের গল্প শোনান। নানাধরনের গল্প। রূপকথা থেকে মেছো ভূত কোনো কিছুই বাদ যায় না। সবাই গোল হয়ে বসে তার চারপাশে। কেউ-কেউ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পুজো উপলক্ষে আসা কচিকাঁচারাও। অনি আশুবাবুর বড়ো নাতি অভিষেকের ছেলে। দার্জিলিংয়ের একটা বোর্ডিং স্কুলে থেকে পড়াশোনা করে। ক্লাস ফোরের ছাত্র। ভীষণ ডানপিটে। ভয়-ডর এর ধারে-কাছে ভীড়তে পারে না। হ্যারিপটারের পাতায়-পাতায় সে বিচরণ করে। সবাই আশুবাবুর কথা বিশ্বাস করে। ব্যতিক্রম শুধু অনি।

ধ্যাৎ, এমনটা হয় নাকি! সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে রাজকুমার এখানে মারতে আসবে কেন ? তাও আবার আমাদের হরতকি বাগানে! কি যে বলো দাদু, বিশ্বাসই হয় না। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অনি।

আমাদের কাছে সাতসমুদ্র তেরো নদী দূর, কিন্তু পক্ষীরাজ ঘোড়ার কাছে এটা আবার দূর নাকি! একবার ডানা ঝাপটা দিলেই হরতকি বাগানে এসে পড়বে। এই হরতকি বাগানটি আগে আমাদের ছিল না। এটা ছিল মাহি রাজপরিবারের। আর আমাদের বাড়ির স্থানে ছিল মাহি রাজার গুমঘর। এখনো মাটি খুঁড়লে ছোটো- ছোটো ইঁটের টুকরো পাওয়া যাবে। সে অনেক বছর আগের কথা। মাহি রাজা ছিলেন শিবের ভক্ত। আর হুমু ছিলেন দানবরাজ। সেই সমুদ্রমন্থনের সময় শিব আর বিষ্ণু মিলে দানবদের অমৃত দেয়নি। সেই থেকে শিব দানবদের শত্রু। তাই মাহি রাজার সঙ্গে হুমু রাজার ছিল দাউ-মাছ সম্পর্ক। দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েকবার। যুদ্ধের সময় হুমু রাজার মুখ দিয়ে আগুনের গোলা বের হতো। দানব তো, তাই ওইরকম শক্তি। সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। মাহি রাজাও কম ছিল না। জয় শিব শম্ভু বলে তীর-ধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত যুদ্ধে। এখনকার মেশিনগানের মতো শয়ে শয়ে তীর বের হত মাহি রাজার ধনুক থেকে। স্বয়ং ভোলানাথ তার হয়ে যুদ্ধে অংশ নিত। যখন দুই রাজার যুদ্ধ হত তখন মনে হত যেন ভুমিকম্প হচ্ছে। এক-একটি যুদ্ধে দু'পক্ষের হাজার-হাজার সৈন্য মারা যেত।

 আচ্ছা দাদু তুমি তো পক্ষীরাজের গল্প বলছিলে। মাহি রাজা, হুমু রাজা এরা সব কোথা থেকে এল ? গল্পের রাশ টেনে অনি বলে।

এই ছেলেটির একটাই দোষ- কথার মাঝে কথা বলা। চুপ করে শোন তবেই না বুঝবি কে কোথা থেকে এল।

তুমি বল তো দাদু। অ্যা-ই অনি, তোর ভালো না লাগলে অন্য ঘরে চলে যা। আমাদের গল্প শুনতে দে। গদাই, বিল্টু, শ্রেয়া একসঙ্গে বলে ওঠে।

অনি চুপ করে বসে থাকে। পাশের ঘরে যায় না। কিছুক্ষণ আগেই আশুবাবু মেছো ভূতের গল্প শেষ করেছেন। পাগল নাকি, একা-একা পাশের ঘরে থাকবে! চুপটি করে বসে থাকে সে। আশুবাবু আবার গল্প শুরু করেন। গলা ঝেড়ে নিয়ে বলেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম, হাজার-হাজার সৈন্যের আত্মাগুলো এখনো হরতকি বাগানে অমাবস্যার রাতে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখতে চাইলে কালীপুজোর রাতে আমি দেখাতে পারব। তবে ভয় পেলে চলবে না। সবাই জড়োসড়ো হয়ে যায়। কাঁপা-কাঁপা গলায় অনি জিজ্ঞেস করে, তারপর ?

মজার ব্যাপার হল এতবার যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু কেউ হারেনি। মাহি রাজার ছিল শিবের বর। আর হুমু রাজার ছিল ইচ্ছামৃত্যু। দুই রাজার যুদ্ধে মরত শুধু উলুখাগড়া। মানে সৈন্যরাই শুধু মরত। নারদ অনেক চেষ্টা করেছিল দুই রাজার মধ্যে সমঝোতা করাবার। কিন্তু পারেনি। কেউ দমবার পাত্র নয়।

হুমু রাজার একমাত্র ছেলে হুতুম। বাবার থেকেও পরাক্রমী ছিল। হাজার হাতির বল ছিল তার শরীরে। হাত দিয়ে পাহাড় ঘোরাতে পারত। জঙ্গলে শিকার করতে গেলে বাঘ-সিংহরা ভয়ে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকত। হুতুমের যখন বয়স ষোল তখন রাজা হুমু অনেক জাঁকজমক করে তাকে যুবরাজ ঘোষণা করে। দানবগুরু কালকেতু যুবরাজ হুতুমকে একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া উপহার দিয়ে বলেন, স্বর্গ-মর্ত্য, গ্রহ-গ্রহান্তে তুমি যেখানে যেতে চাইবে এই পক্ষীরাজ ঘোড়া তোমাকে নিয়ে যাবে। হুতুম তো ভীষণ খুশি। খুশি হবারই কথা। পক্ষীরাজ ঘোড়া তো সবার ভাগ্যে জোটে না। হুতুমের তখন দারুন মজা। সকালবেলা জলখাবার খেয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো। কখনো সে মেঘের ভিতর দিয়ে হিমালয়ের রুপোলি চূড়া ছুঁয়ে যায় কৈলাসে আবার কখনো সে যায় মহাশূন্যে ভাসতে থাকা মঙ্গল গ্রহে। মঙ্গলের মাটিতে টগবগ টগবগ করে ঘোড়া ছোটাত আপন খেয়ালে। ঘোড়ার খুরে-খুরে লালমাটির ঝড় উঠত মঙ্গলগ্রহে। আছড়ে পড়ত সেই ঝড় পৃথিবীতে। কখনো আবার চাঁদে গিয়ে চাঁদবুড়ির সঙ্গে গল্প করত সে। চাঁদবুড়ি সেখানে একাই থাকে। পৃথিবীর কোনো খোঁজই সে রাখে না। চাঁদবুড়ির পাশে বসে হুতুম তাকে অনেক গল্প শোনাত। রাজা মাহির সঙ্গে তার বাবার যুদ্ধের কথা শুনে চাঁদবুড়ির দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। অবাক হয়ে চাঁদবুড়ি বলত, পৃথিবীর মানুষরা এত লড়াই করে কেন! একটি মানুষ আর একটি মানুষের কেন রক্ত ঝরায়! আমি তো সবাইকে সুখে দেখতে চাই! জ্যোৎস্না দিয়ে সবার ঘর ভরাতে চাই!

তুমি চিন্তা করো না চাঁদবুড়ি। বাবার সঙ্গে মাহি রাজার যুদ্ধ আর হতে দেব না। তুমি দেখবে, পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এসেছে।

হুতুমের কথায় চাঁদবুড়ি খুশি হয়। তাকে অনেক সুতো উপহার দেয়। হুতুম তো ভীষণ খুশি। পক্ষীরাজের পিঠে করে সেই সুতো নিয়ে আসে রাজপ্রাসাদে। তৈরি করে সে রকমারি পোশাক।

পক্ষীরাজ ঘোড়াটি ছিল হুতুমের ভীষণ বাধ্য। সে যা বলত ঘোড়াটি তাই শুনত। কখনো কোনো ক্লান্তি ছিল না তার শরীরে। একদিন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে মেঘের ভিতর দিয়ে হুতুম যাচ্ছিল অজানা কোনো দেশের সন্ধানে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর তার শরীর জুড়ে ক্লান্তি নেমে আসে। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে একটি সরোবর দেখতে পায়। বিশ্রাম নেবার জন্য সরোবরের পারে নামে হুতুম। সরোবরের চারপাশে নানাধরণের গাছগাছালিতে হরেকরকম পাখি কিচির-মিচির করছে। থরে-থরে শ্বেতপদ্ম ফুটে আছে সরোবরের টলটলে জলে। পশ্চিম পাড়ে একটি গাছে সুন্দর-সুন্দর অনেক ফল ধরে আছে। লাল রঙের। হুতুমের ভীষণ খিদে পায়। ভাবে, এই ফল খেয়ে কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না। পক্ষীরাজ ঘোড়ার লাগাম খুলে দিয়ে সরোবরের জলে হাত মুখ ধুয়ে নেয় সে। তারপর সেই গাছটি থেকে বেশ কয়েকটি ফল পেড়ে খেতে যাবে এমন সময় কে যেন সুমিষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে, ওই ফল খাবে না, ওটা বিষ ফল।

হুতুম পিছন ফিরে তাকায়। কোনো এক অদৃশ্য জাদুতে তার চোখের পাতা আটকে যায়। কিছুতে চোখের পাতা ফেলতে পারে না। ভাবে, স্বপ্ন দেখছি না তো। মনে হয় রূপকথার দেশের এক পরী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেও তাকিয়ে থাকে হুতুমের দিকে অবাক দৃষ্টিতে। দুজনেরই কথা বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ একদল দামাল মেয়ে ঝর্ণা ধারার মতো ছুটে এসে সুধা-সুধা বলে ডাকে। সম্বিত ফেরে দুজনের। লজ্জায় চোখের পাতা নামায় সুধা। হুতুমও। ছুট্টে চলে যায় সুধা। এক নিমিষে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যায় তার সঙ্গিনীদের নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে খিদে আর ক্লান্তি ভুলে যায় হুতুম। কোনো এক স্বপ্নাতীত জাদুর ছোঁয়ায় মুহ্যমান হয় সে। গাছের তলায় দুম করে বসে পড়ে। ভাবে, এই নির্জন জায়গায় কে এসেছিল প্রাণ বাঁচাতে! সেকি মানবী, না দেবী! বারবার নিজের মনকে প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। পক্ষীরাজ ঘোড়াটি আপন মনে সরোবরের পাড়ে কচি ঘাস খাচ্ছিল। সন্ধ্যা হতে দেখে চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ করে ডেকে ওঠে। হুতুমের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে বোঝার উপায় নেই। পক্ষীরাজ ঘোড়াটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আবার চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ করে ডাক দেয়। চোখ খোলে হুতুম। সন্ধে হয়েছে দেখে বাড়ি ফেরার জন্য পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে বসে। আলতো করে ঘোড়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। কানের পাশে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কাল এখানে নিয়ে আসতে পারবি তো ?

মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয় ঘোড়া, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ, চিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ। হুতুমের কথায় শূন্যে ভেসে যায় পক্ষীরাজ।

রাজ প্রাসাদে ফিরে আর ভালো লাগে না হুতুমের। চোখের সামনে শুধুই সুধাকে দেখতে পায়। যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে অনাবিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে শূন্যে মিশে যায় সুধা। সে এক অদ্ভুত বিড়ম্বনা। সারারাত ঘুমোতে পারে না হুতুম। বিছানায় শুয়ে প্রহর গুনতে থাকে। অপেক্ষা করে কখন সকাল হবে।

ভোরের আলো ফুটতেই পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওনা দেয় হুতুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় সরোবরের পাড়ে। দেখে সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু নেই সুধা। আশেপাশের জঙ্গলে অনেক খুঁজেও পায় না। কাছে-পিঠে কাউকে দেখতে না পেয়ে সুধা-সুধা'' বলে ডাকে বারকয়েক। কোনো উত্তর পায় না। মুখ নিঃসৃত শব্দগুলি শুধু প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে তার কাছে।

গল্পের টানটান উত্তেজনার মাঝে অনির মায়ের আগমন। রাত যে অনেক হল দাদু। গল্প কি আজ শেষ হবে ? কাল ভোরে সপ্তমীর পুজো। অনেক কাজ। আর দেরি না করে শুয়ে পড়ুন। ছোটোদের ধমক দিয়ে বলেন, দাদুকে এবার ছাড়। রাত অনেক হল।

একসঙ্গে সবাই রে-রে করে ওঠে। অনির স্পষ্ট জবাব, কাল পড়াও নেই, স্কুলও নেই। সপ্তমীর পুজো।

-তুমি শুয়ে পড়ো মা। ওদের চিন্তা করতে হবে না। আমি তো আছি।

ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনির মা। আশুবাবু তখন নিজের খেয়ালে আবার বলতে শুরু করলেন। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম! হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হুতুম তখন পাগলের মতো একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত খুঁজে বেড়াচ্ছে সুধাকে। কোথাও পায় না। মনের দুঃখে সরোবরের পশ্চিমপাড়ের বিষফল গাছটির নিচে গিয়ে বসে।

-সুধাকে পেল ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে দিশা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আশুবাবু আবার বলেন, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ পর হুতুম দেখে সরোবরের থেকে শ্বেতপদ্ম তুলছে সুধা। সঙ্গে আরও কয়েকটি মেয়ে। কি করবে ভেবে পায় না। উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে সুধার কাছে যায়। হুতুমকে দেখে অন্য মেয়েরা খিলখিল করে হেসে ওঠে। সুধাকে একলা রেখে দূরে সরে যায় সকলে। একে-অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আর দৌড়ে পালাবার উপায় নেই সুধার। বাধ্য হয়ে কথা বলে সে। অনেক কথা বলে দুজনে। শুধু নিজেদের আসল পরিচয়টা গোপন রাখে একে-অপরের কাছে। হুতুম বলে, সে ভিনদেশ থেকে ব্যবসা করতে এসেছে। সুধা বলে, সে জঙ্গলের পাশের গ্রামেই থাকে। প্রতিদিন শ্বেতপদ্ম তুলতে আসে এখানে।

সরোবরের পাড়ে প্রতিদিন দুজনের দেখা হতে থাকে। অনেক গল্প করে। হারিয়ে যায় জানা-অজানার মাঝে। সুধার সঙ্গীদের সরোবরের পাড়ে রেখে প্রায়দিনই সুধাকে নিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে মেঘের আড়ালে ঘুরে বেড়ায় হুতুম। পাহাড় থেকে সাগর কিছুই বাদ যায় না। ভীষণ আনন্দে কেটে যায় ওদের বেশ কয়েকটা দিন।

হুতুমের মনে দিনরাত একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। তার মতো সুধাও পরিচয় গোপন করছে না তো! মনের প্রশ্নটা মুখে প্রকাশ করে না। একদিন সন্ধের সময় সুধাকে অনুসরণ করে হুতুম। সুধা টের পায় না। সরোবরের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে হুতুম দেখে সুধা বান্ধবীদের নিয়ে একটি মাদুরের উপর দাঁড়াল। বিড়বিড় করে কি যেন বলল আর মাদুরটি অমনি শূন্যে ভাসতে-ভাসতে চলল সুধার নাক বরাবর। দেরি না করে হুতুমও পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে দূর থেকে অনুসরণ করে সুধাকে। শূন্যে উড়ন্ত মাদুরটি সুধাদের নিয়ে একটি রাজপ্রাসাদের ছাদে গিয়ে নামে। হুতুম বুঝতে পারে সুধা তাকে মিথ্যে বলেছে। ও জঙ্গলের পাশের কোনো গ্রামে থাকে না। তবে কি সুধা রাজকুমারী! এই রাজ্যের রাজাই বা কে! এইরূপ অনেক প্রশ্ন হুতুমের মাথায় ভিড় করে ওঠে।

পক্ষীরাজ ঘোড়া নিয়ে আকাশেই কিছুক্ষণ সময় কাটায় হুতুম। তারপর সুযোগ বুঝে রাজপ্রাসাদের ছাদে নামে। আর সবার দৃষ্টি এড়িয়ে সোজা চলে যায় সুধার ঘরে। সুধা তখন বিছানায় শুয়ে কি যেন ভাবছে। হুতুম সামনে এসে দাঁড়ায়। সুধা তো অবাক। তুমি! তুমি এখানে কি করে এলে ? চলে যাও। কেউ দেখলে তোমাকে মেরে ফেলবে। ভয়ার্ত স্বরে কথাগুলি বলে সুধা।

-তুমি যে রাজকুমারী সে কথা কেন বলোনি ?

-হ্যাঁ, আমি রাজকুমারী। রাজা মাহি আমার বাবা। তুমি এবার চলে যাও, কেউ দেখে ফেলবে।

সুধার কথা শুনে হুতুমের সত্যিই ভয় হয়। শত্রুর গর্তে চলে এসেছে সে! হঠাৎ রক্ষীদের পায়ের শব্দ শোনা যায়। সুধা হুতুমকে ঘরের মধ্যে আড়াল করতে চায়। হুতুম রাজি হয় না। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, আমি যুবরাজ। রাজা হুমুর ছেলে। মৃত্যুকে ভয় পাই না। আসুক রক্ষীরা।

হুতুমের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে সুধা। শত্রুর ছেলেকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। বাবা জানলে আস্ত রাখবে না। এইসব কথা মনে হতেই রক্ত হিম হয়ে যায় তার। হাত জোড় করে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। চলে যেতে বলে বারবার। হুতুম কোনো কথাই কানে নেয় না। পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের মধ্যে। এমন সময় এক রক্ষী এসে খবর দেয়- রানীমা আর রাজামশাই আসছেন।

মুহূর্তের মধ্যে রাজা মাহি ও রানী সৌমিলি সুধার ঘরে প্রবেশ করে। রাজকুমারীর ঘরের মধ্যে এক অপরিচিত যুবককে দেখে বিস্মিত হন তারা। হুতুমের কি পরিচয় দেবে ভেবে পায় না সুধা। বাবা-মার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করতে থাকে সে।

-আমি যুবরাজ হুতুম, রাজা হুমুর ছেলে। আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। বীরের মতো মাথা উঁচু করে কথাগুলো বলে হুতুম।

-তোমার স্পর্ধা আমাকে অবাক করছে। এই, কে আছো, বন্দি করো একে। চিৎকার করে হুকুম জারি করে রাজা মাহি।

রাজা মাহির মুখের কথা শেষ হতে না হতেই রক্ষীরা তাকে ঘিরে ফেলে। তার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। মাথা উঁচু করে রাজা ও রানীর উদ্দেশ্যে সে বলে, সুধাকে আমি ভালোবাসি। সুধাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

হুতুমের কথা রাজা মাহির ক্রোধাগ্নিতে ঘি ঢেলে দেয়। রাগে লাল হয়ে যায়। চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে থাকে তার। রাজাকে শান্ত করার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় রানী। কিছুতেই রাজা শান্ত হয় না। সুধা মায়ের পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লজ্জা ও ভয়ে বাকশূণ্য হয়ে যায় সে।

-তোমার অপরাধ অমার্জনীয়। রক্ষী, এই দানবসন্তানকে সহস্য চাবুক মারো, যার শব্দ রাজা হুমু যেন শুনতে পায় তার রাজপ্রাসাদে বসেই। বিস্ফারিত চোখে হুকুম জারি করে রাজা মাহি।

তৎক্ষণাৎ রক্ষীরা চাবুক মারতে শুরু করে। সপাট-সপাট শব্দ ওঠে প্রতিটি আঘাতে। শরীর ফেটে রক্ত ঝরে হুতুমের। কোনোরকম প্রতিরোধ করে না সে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। হুতুমের প্রতি নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সুধা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। রানী তাকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। ক্রমাগত চাবুকের আঘাত সহ্য করতে না পেরে হুতুম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রাজা মাহির নির্দেশে রক্ষীরা তার ক্ষত-বিক্ষত শরীরটা রাজপ্রাসাদের বাইরেই ফেলে দেয়।

হুতুমের এই অবস্থা দেখে পক্ষীরাজ ঘোড়াটি খবর দেয় রাজা হুমুকে। হুংকার দিয়ে ওঠে রাজা হুমু। রণবাদ্য বাজিয়ে মাহির রাজ্য আক্রমণ করে। হুমুর অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে রাজা মাহি। ঝাঁকে-ঝাঁকে তীর, বর্ষা, বল্লম আছড়ে পড়ে রাজপ্রাসাদের দিকে। প্রতিরোধের যথাসাধ্য চেষ্টা করেও পেরে ওঠে না রাজা মাহি।

এমন সময় যুদ্ধরত দুই সৈন্যদলের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে হুতুম। চিৎকার করে বলতে থাকে, তোমরা যুদ্ধ করো না। যুদ্ধ শুধু মৃত্যু আনে, শান্তি আনে না। তোমরা যুদ্ধ করো না। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস করে, সৃষ্টি করে না।

হুতুমের কথায় কেউ কর্ণপাত করে না। রাজা হুমু চিৎকার করে হুতুমকে সরে যেতে বলে। হুতুম সরে না। যুদ্ধরত দুই সৈন্যদলের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। মুহূর্তের মধ্যে দু-পাশ থেকে আসা ঝাঁকে-ঝাঁকে তীর, বর্ষা, বল্লম হুতুমের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। শান্তির বার্তা দিয়ে রণক্ষেত্রেই প্রাণ দেয় হুতুম। দুই রাজার মধ্যে বছর বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধ শেষ হয় তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই। আমাদের হরতকি বাগানে হুতুমের সমাধি দেওয়া হয়।

-সুধার কি হল ? অশ্রুসজল চোখে জিজ্ঞেস করে অনি।

-পাগল হয়ে যায়। হুতুমের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র সুধা পাগল হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশুবাবু উত্তর দেন।

হুতুমের গল্প শুনে সবার মনই বিষন্নতায় ভরে যায়। সুধার জন্য ভীষণ কষ্ট হয় শ্রেয়ার।

মাঝরাতে হুতুমের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনি। ছেঁড়া-ছেঁড়া চাঁদের আলো হুতুমের সমাধির ওপর এসে পড়েছে। ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে হুতুম। দু-চোখে তার জলের ধারা ক্রমাগত বয়ে চলেছে। নীল হয়ে গেছে তার সারা শরীর। করুণ স্বরে অনি জিজ্ঞেস করে, হুতুম, তুমি কাঁদছো কেন ?

-যন্ত্রণা! সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণা! চাবুকের আঘাতে আমার শরীর ফালা-ফালা হয়ে যাচ্ছে!

-এখনো! এখনো তোমাকে কে মারছে হুতুম ? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অনি।

প্রতিমুহূর্তে আমাকে মারছে অস্পৃশ্যতার চাবুক। বিদ্বেষের চাবুক। ঘৃণার চাবুক। আর কত সহ্য করব অনি! তুমি পারবে না ওই চাবুকগুলোকে চিরতরে ভেঙে ফেলতে ?

-হ্যাঁ পারব। পারব হুতুম। চিৎকার করে বলে অনি।

বারান্দা থেকে ছুটে আসে অনির মা। স্বপ্ন দেখছিলি ? এবার ওঠ বাবা। গালটি ধরে আদর করে বলে, সকাল হয়ে গেছে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ