ডালিমপুরে ডংকার সিংহ রাজা হওয়ার পর থেকেই যত গোলমাল শুরু হল। আগের রাজা ঢাকেশ্বর সিংহ খুব ভালো লোক ছিলেন। প্রজাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি ওনার খুব নজর ছিল। কিন্তু উনি ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ। যুদ্ধ-বিগ্রহ ওনার এতোটুকু পছন্দ ছিল না। সেই তথ্যের সুযোগ নিয়েই ডংকার সিংহ রাজ সিংহাসন হাতিয়ে বসলেন। ডংকার সিংহ আসলে একজন দস্যু। দস্যুবৃত্তি করে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ কিভাবে জানি ডালিমপুরে এসে হাজির হল। ওখানে এসেই বুঝতে পারল এখানকার ব্যাপারটা আলাদা। এখানকার লোকজন সবাই বেশ খুশি-আনন্দে দিন কাটাচ্ছে।
ডংকার সিংহ একজনকে ডেকে বলল, কি হে ভায়া, তোমাদের তো খুব খুশি বলে মনে হচ্ছে! সাধারণ লোকজনকে এতটা খুশি তো সচরাচর দেখা যায় না!
লোকটা হেসে বলল, হ্যাঁ, এসবই আমাদের রাজার গুণে। উনি সবাইকে বলেছেন ঝগড়া করবে না, যুদ্ধ করবে না, সবাই মিলেমিশে থাকবে। প্রথম প্রথম সবার খুব অসুবিধা হত। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই চারিদিকে শান্তি আর শান্তি।
ডংকার সিংহ চমকে উঠল। বলল, বল কি হে ? তোমাদের রাজা যুদ্ধ করেন না ?
না। একদম করেন না। কারোর সঙ্গে না। আশেপাশের সব রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে আমাদের শান্তির সম্পর্ক।
লোকটা হেসে বলল, কিন্তু রাজার সেনাবাহিনী তো আছে ?
না। সেনাদের সব চাষবাস আর ঘর বাড়ি তৈরীর কাজে-কর্মে লাগিয়ে দিয়েছেন রাজামশাই। যুদ্ধ যখন হচ্ছে না তখন শুধু শুধু সেনাবাহিনী রেখে কি লাভ ?
তা রাজবাড়িটা কোনদিকে বলে দাও ভাই। আমি তোমাদের রাজার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। এইরকম রাজা আমি কোনদিন দেখিনি!
লোকটা সরল বিশ্বাসে ওকে রাজবাড়ীর রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস ডংকার সিংহ তার কুবুদ্ধির ঝাঁপি নিয়ে রাজবাড়ীতে গিয়ে হাজির হল। অনেক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে যখন সে রাজাকে বন্দী করে ফেলল তখনও মহারাজ ঢাকেশ্বর দরবারের লোকজনদের বললেন, না-না, তোমরা যুদ্ধ কোরো না। যা হচ্ছে হতে দাও। ফলে ডংকার সিংহের সুবিধাই হল। সে রাজাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলের মাঝে একটা অন্ধকার ঘরে বন্দি করে দিয়ে এসে নিজে রাজা হয়ে বসল। ডালিমপুরবাসীরা পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখল ওদের রাজা বদলে গেছে। কিন্তু রাজা বদলে গেলে কি হবে, লোকজন তো রাজা ঢাকেশ্বরের কথা বলা বন্ধ করে না। লোকে যত আগের প্রশংসা করে ডংকার সিংহের রাগ তত বাড়ে। শেষে ডংকার সিংহ রেগে হুকুম দিল, এই রাজ্যে কেউ ঢাকেশ্বরের নাম উচ্চারণ করতে পারবে না।
কিন্তু লোকে তাও থামে না। বলে, “ঢ''-রাজা বেশ ছিলেন!
তখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ডংকার সিংহ। বলল, এই রাজ্যে “ঢ'' অক্ষরটাই উচ্চারণ করা বারণ।
লোকে হাউমাউ করে উঠল। তা কি করে হয় ? এ তো ভয়ানক অনাচার!
কিন্তু ডংকার সিংহকে থামানো গেল না। ব্যাপারটা প্রায় অসুখের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল তার। রাস্তায় রাস্তায় লম্বা লিস্টি লাগানো হল। তাতে যা লেখা আছে-
১. মন্দির গীর্জা ঘন্টা আর ঢং ঢং করে বাজবে না। ডংডং বা টংটং বা টিংটিং করে বাজবে।
২. কেউ ঘুমে ঢুলে পড়তে পারবে না। হয় জেগে থাকতে হবে, নাহলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
৩. কোনোকিছু ঢাকা দেওয়া চলবে না। সব চাপা দিতে হবে।
৪. ঢাক-ঢোল, ঢোলক ইত্যাদি বাজানো চলবে না। ঢুলি, ঢাকি এদের সবাইকে অন্য কাজ নিতে হবে।
৫. সব ঢিবিকে পাহাড় বলে সম্বোধন করতে হবে।
৬. ঢালাই করা চলবে না। সবকিছু লোহা পেটাই করে বানাতে হবে।
৭. ন্যাকামি করতে পারো কিন্তু ঢং করতে পারবে না।
৮. ঢেকুর তোলা বারণ।
৯. কাউকে ঢ্যাঙা বা ঢলঢলে বলা যাবে না।
১০. তলোয়ার ব্যবহার করতে পারো কিন্তু ঢাল ব্যবহার নিষেধ।
ডংকার সিংহের তালিকা বেড়েই চলল দিনকে দিন। “ঢ'' অক্ষরটাকে বর্ণমালা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টায় উঠে-পড়ে লাগল সে। কেউ “ঢ''-এর শব্দ উচ্চারণ করলে বা করেছে জানলে তাকে বেদম শাস্তি দেয় রাজা ডংকার সিংহ। দস্যু রাজা নিজের মণি-মাণিক্যের সম্ভার বাড়াতে বাড়াতে রাজকোষ প্রায় খালি করে ফেলল। তার অনাচার-অত্যাচার দিনকে-দিন বেড়েই চলল। মন্ত্রীরা চিন্তায় পড়লেন। প্রজারা শঙ্কিত হল।
দুই
শ্যামু অনু সেদিন খেলতে খেলতে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। তারপর গহন জঙ্গলে পথ হারিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখল একটা কাঠের ঘর। ঘরে কি আছে দেখার জন্য দুজনে ছিটকানি খুলে ভেতরে ঢুকল। ওমা! অন্ধকার ঘরের মাটিতে কে একজন শুয়ে রয়েছে! এক মুখ দাঁড়ি গোঁফ, মাথায় জট পাকানো চুল! একটু ভালো করে দেখতেই চমকে উঠল দুজনে। আরে, ইনি তো ওদের আগের রাজা ঢাকেশ্বর সিংহ। খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি! কি করবে ভাবছে ওরা। এমন সময় শুনতে পেল কারা যেন বাইরে থেকে ওদের নাম ধরে ডাকছে। ছুটে গিয়ে দেখল বাবা আর কাকু ওদের খুঁজতে বেরিয়েছে।
ওদের কাছে রাজামশাইয়ের কথা শুনে বাবা আর কাকু আরো লোকজন নিয়ে এসে ধরাধরি করে
রাজাকে বাড়ি নিয়ে এল। সেবা-শুশ্রূষার ফলে রাজা অনেকটা ভালো হয়ে উঠলেন। সবাই
জিজ্ঞেস করছিল, আপনি এতদিন বেঁচে
ছিলেন কি করে রাজামশাই ?
ঘরটার ছাদে একটা ফুটো ছিল, সেটা দিয়েই পাখিরা আমার জন্য খাবার দিয়ে যেত। কিন্তু ওরা নিজেরাই তো ছোটো। কোনদিন এক টুকরো ফল, কোনদিন এক টুকরো রুটি, এইরকম। আর বৃষ্টির জল পড়ত ওখান থেকে, খেতাম। তা তোমরা কেমন আছো সবাই ?
সবাই তাদের দুঃখের কথা শোনাল। সব শুনে উনি বললেন, আমারই ভুল। যুদ্ধ করব না বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে নিজের দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়াটা ঠিক নয়। প্রজাদের প্রতি তো আমার একটা দায়িত্ব ছিল, আমি সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। তবে আর নয়। আমার অনেক শিক্ষা হয়েছে। ওই দস্যু ডংকার সিংহকে আমি ওর ফাঁদে ফেলেই জব্দ করব। ওর দজ্জাল কীর্তিকলাপের একটা ইতি টানতেই হবে। ডংকার সিংহ এখন কোথায় ?
উনি পাশের রাজ্যে গেছেন। ওখানকার রাজার মেয়ের বিয়েতে। আমার কাকু ওনার মন্ত্রী, তাই আমি জানি। উনি কাল সকালে ফিরবেন।
ঠিক আছে। আজ রাতেই সবাইকে মতলবটা বুঝিয়ে দিতে হবে।
তিন
পরদিন সকালবেলা ডংকার সিংহ ডালিমপুরে ফিরতে গিয়ে দেখল ডালিমপুরের হাজার-হাজার বাসিন্দা পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কি ব্যাপার ? তোমরা এখানে কেন ? রেগে জিজ্ঞেস করল ডংকার সিংহ।
ডংকার সিংহ, “ঢ'' -এর নিয়ম তুমিই আমাদের ওপর চাপিয়ে ছিলে। সে নিয়ম যে তোমাকেও মানতে হবে। তাই ডালিমপুর থেকে একবার যখন তুমি বেরিয়েছ তখন আর ডালিমপুরে তোমার ঢোকা হবে না। এই বলে ডালিমপুরের হাজার-হাজার প্রজা তলোয়ার নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।
ডংকার সিংহ আর কিছুই করতে পারল না অতগুলো মানুষের সামনে। তাছাড়া নিজের দোষেই তো নিজের কাছে আজ ঢাল নেই। ঢাল বর্জনের নির্দেশ দিয়েছিল সে নিজেই। তাই পালিয়ে বাঁচতে হল তাকে।
ডালিমপুরে আবার শান্তি আর “ঢ'' ফিরে এল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১১
0 মন্তব্যসমূহ