সে অনেককাল আগের কথা।
এক ছিল রাজা। তার ছিল দুই রানি। দুই রানির কোনো সন্তান ছিল না। তাই তাদের মনে সুখও ছিল না।
একদিন রাজবাড়িতে হাজির হলেন এক সন্ন্যাসী। পরনে তার গেরুয়া পোশাক। মাথায় জটা। হাতে কমন্ডলু। কাঁধে ঝোলা। তাকে দেখে দুই রানি ভক্তি ভরে আনত হয়ে প্রণাম করলেন।
সন্ন্যাসী বললেন, আমি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। আমি তোমাদের ভক্তিতে খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের মনোবাঞ্ছা কি তা আমাকে জানাতে পারো। আমি তা সফল করতে চেষ্টা করব।
দুই রানি তাদের মনের দুঃখের কথা জানালেন, আমাদের কারোর কোনো সন্তান নেই। সন্তান ছাড়া এই রাজবাড়ির কী দাম ? এই রাজত্বও অর্থহীন। আমরা সবাই বিমর্ষ হয়ে দিন কাটাচ্ছি।
সন্ন্যাসী একথা শুনে প্রশান্ত হাসি হাসলেন। বললেন, তোমাদের সন্তান হবে, মা। এই বলে তার ঝোলা থেকে দুটো ফল বের করলেন।
ফল দুটো আর কিছু নয়, দুটো পাকা আম। সন্ন্যাসী তার একটি তুলে দিলেন বড়ো রানির হাতে। অন্যটি ছোটো রানির হাতে। বললেন, আমি দুজনকে অমৃত ফল দিলাম। তোমরা আজই রাত্রে শোয়ার আগে যত্ন করে খাবে। তোমাদের মনের সাধ পূর্ণ হবে।
বড়োরানির ফলটি ছিল খুবই পাকা। একধারে খোসায় তার পচন ধরেছিল। তাই তিনি কেবল ভালো অংশটুকু খেলেন। আর পচা অংশটুকু ফেলে দিলেন। ছোটোরানি তার আমটি পরম যত্নে সবটাই খেয়ে নিলেন।
সন্ন্যাসীর আশীর্বাদ সত্য হল। দুই রানি যথাসময়ে সন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বড়ো রানির ছেলে হল বিকলাঙ্গ। তার একটি হাত ছিল অন্যটির তুলনায় বেশ ছোটো।
এক বছর পর সেই সন্ন্যাসী রাজবাড়িতে আবার এলেন। এসে সব কিছু অবগত হলেন। বড়ো রানিকে বললেন, মা, তুমি আমার কথা ঠিক মতো পালন করোনি। ফলের সবটুকু খাওনি বলে, তোমার ছেলে সম্পূর্ণ আকার পায়নি। অঙ্গে খুঁত হয়েছে। এখন আর আমি কী করতে পারি ? এটাই তোমার ভবিতব্য।
সে যা হোক, রাজা দুটি পুত্র লাভ করে আনন্দিত। তবে তিনি ছোটো রানির ছেলেকে বেশি ভালোবাসতে লাগলেন। তার ইচ্ছা, একদিন তার অবর্তমানে এই সুন্দর ছেলেটিই রাজ্যের অধিশ্বর হবে।
রাজা একদিন রাজউদ্যানে বসেছিলেন। সঙ্গে ছিল পাত্র-মিত্র ও অনুচর। কিছু দূরে রাজপুত্র দুটিতে খেলা করছিল। একসময় তারা দুজন বাবার কাছে হাজির হল। রাজা আগ্রহ সহকারে ছোটো ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন।
এ-দৃশ্য বড়োরানির চোখ এড়ালো না। তিনি তখন ছিলেন তার মহলের দোতলায়। তিনি তার ছেলের প্রতি এমন অনাদরে দুঃখ পেলেন। আর ছোটোরানির ছেলের প্রতি ঈর্ষায় জ্বলে উঠলেন।
ফল কিছুদিনের মধ্যে ফলল। বড়োরানির প্ররোচনায় রাজা ছোটোরানির জন্য এক নতুন মহল তৈরি করলেন। তার নগরের একপ্রান্তে। সেখানে ছোটোরানি ছোটো রাজকুমারকে নিয়ে বাস করতে বাধ্য হলেন।
ছোটো রাজকুমার ক্রমে ক্রমে বড়ো হতে লাগল। এক সময় সে বুঝে ফেলল, তার মায়ের দুঃখ। তারই জন্য তার এই দুঃখ। সে সুদেহী বলে রাজা তাকে ভালোবাসেন। আর বড়ো-মা তাকে ঈর্ষা করেন। আর সেই ঈর্ষার জন্যই আজ তার মায়ের হতাদর।
মনের মধ্যে ছোটো রাজকুমারের তাই সর্বদা বিরাজ করত এক বিষন্নতা। সে ভাবত, পিতৃরাজ্যের উত্তরাধিকারী হোক বড়ো রাজকুমার। সে তার দাবীদার হবে না কোনোদিন। কিন্তু মিথ্যা সন্দেহে তার জন্য তার মা কেন নগরের প্রান্তে এভাবে বাস করবে অবহেলায় ?
একদিন ছোটো রাজকুমার ঘোড়া ছুটিয়ে উদাসীনভাবে বেরিয়ে পড়ল। ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছে। এক সময় এক বনের মধ্যে হাজির হল সে। তখন বিকেল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অবসন্ন হয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। সামনে এক সরোবর দেখতে পেয়ে আকণ্ঠ জল পান করল।
এবার সে বসে পড়ল একটা বটগাছের নিচে। অজস্র ডালপালা ও পাতায় সুনিবিড়। সেই গাছে বাস করত ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী। কিছুক্ষণের মধ্যে ছোটো রাজকুমারের চোখ দুটি তন্দ্রায় বুজে এল। এমন সময় গাছ থেকে ব্যঙ্গমা পাখিটি ডেকে উঠল-
কুরুর কুরুর কুরুর কু....
রাজকুমারের খুব দুঃখু।
পাখির ডাকে রাজকুমারের তন্দ্রা টুটে গেল। সে শুনতে পেল ব্যাঙ্গমার প্রতি ব্যাঙ্গমীর প্রশ্ন। ব্যাঙ্গমী বলছে, কোথায় রাজকুমার ? তার কিসের বা দুঃখু ?
ব্যাঙ্গমা বলল, সে এই গাছটার নিচে বসে আছে। তার মায়ের প্রতি রাজার অনাদর আর বড়োরানির ঈর্ষা তাকে যন্ত্রণা দেয়। তার পিতৃরাজ্যের প্রতি কোনো লোভ নেই। তবু সে রাজ্য পাবে। সে রাজা হবে।
ব্যাঙ্গমী জানতে চাইল, কী করে ? কী করে ?
ব্যাঙ্গমা বলল-
পিতার রাজ্য যে নিক তার
সে রাজ্যে তার কি দরকার ?
পাষাণপুরের ফিরবে প্রাণ
রাজ্য সমেত কন্যা দান
উত্তরদিকে বনের শেষ
সেইখানেতে রাজার দেশ।
ব্যাঙ্গমী খুশি হয়ে বলে উঠল, বাঃ ! বাঃ ! অতি উত্তম কথা শোনালে তুমি। বেচারার দুঃখ তাহলে ঘুচবে ?
এরপর ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমী উড়ে গেল উত্তর দিকে।
ছোটো রাজকুমার বটগাছের তলা থেকে উঠে পড়ল। সে এবার উত্তর দিক লক্ষ্য রেখে ঘন বনের ভেতর ঘোড়ার লাগাম ধরে হাঁটতে থাকল। হাঁটতে-হাঁটতে এক সময় সে বনের প্রান্তে এসে পৌঁছল এক ভিন্ন রাজবাড়ির সামনে।
সে চেয়ে দেখল, সিংহদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন বলশালী প্রহরী। হাতে তাদের অস্ত্র। কিন্তু তারা সবাই প্রস্তরীভূত। যেন পাথরের তৈরি নিটোল ভাষ্কর্য মূর্তি।
রাজকুমার তোরণ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। ভিতরে কোনো জীবন্ত জনপ্রাণীর সন্ধান পেল না। যতই এগোয়, ততই দেখা যায় পাথরের মূর্তি। রাজবাড়ির এ-ঘর থেকে সে-ঘরে সে অবাক হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। নাঃ কোথাও কেউ নেই।
ঘুরতে ঘুরতে সে এক সময় ক্লান্ত হয়ে একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। সে-ঘরে সোনার পালঙ্ক। পালঙ্কের ওপর সুন্দর বিছানা। সেই বিছানার ওপর শুয়ে আছে এক রূপবতী কন্যা। তার অপরূপ রূপ। পদ্মের মতো দুটো চোখ। চাঁপার কলির মতো আঙুল। মাথায় কালো মেঘের মতো চুল।
রাজকুমার বেশ অবাক হল এই দেখে যে, এই কন্যা পাথরের নয় বটে, তবে বোধ হয় মৃত। বেশ ভালো করে দেখে বুঝল, না, সে মৃত নয়। তার অল্প-অল্প নিঃশ্বাস পড়ছে। মেয়েটি তাহলে ঘুমিয়ে আছে। সে ঘুমন্ত।
ঘুমন্ত মেয়েটির মাথার কাছে দুটো বাতি জ্বলছে। দুটো বাতিদানে বসানো রয়েছে দুটো বাতি। একটা রূপোর বাতিদান, অন্যটি সোনার। দুটোর গায়ে সুদৃশ্য কারুকাজ করা।
রাজকুমার মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ। বাতির আলোতে তাকে বারে-বারে দেখে যেন আশ মেটে না। তাই রূপো বাতিদানটি টেনে নিয়ে ভালো করে সুন্দর মুখটি দেখতে লাগল। আবার সে রেখে দিল বাতি। কিছুক্ষণ পর টেনে নিল সোনার বাতিদান। সেটি নিয়ে যেই রূপবতীর মুখ দেখছে, তখনই জেগে গেল মেয়েটি। চোখের পাতা খুলে গেল তার। সে বিস্ময়ে উঠে বসল। অস্ফুট শব্দে তার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে। বলল, কে তুমি ? এখানে কিভাবে এলে ?
ছোটো রাজকুমার বলল, আমি এক ভিন্ন রাজ্যের রাজকুমার। আজ এই বনের মধ্যে এসে এই রাজবাড়ির সন্ধান পেয়েছি। ঘুরতে-ঘুরতে এখানকার সমস্ত পাষাণ-মূর্তি দৃষ্টিগোচর হয়েছে আমার। তাতে কৌতুহল বেড়েছে। অবশেষে তোমার ঘরে হাজির হয়েছি। তুমিই বা কে ? সেটাই বলো তুমি আগে। আর, এভাবে আছ কেন ?
মেয়েটি বলল, আমি এই মায়াগ্রস্ত পাষাণপুরীর ভাগ্যহত রাজকন্যা। এখানকার রাজা, রানী, মন্ত্রী, সৈন্যসামন্ত, রাজকর্মচারী সবাই এক বুড়ি রাক্ষসীর মায়াবিদ্যায় পাথর হয়ে গেছে। কেবল আমি পাথর নই। কেন জানি না, আমাকে পাথরে রূপান্তরিত করেনি।
এখন এই রাজ্য ও রাজবাড়ির সেই রাক্ষসীর দখলে। এখানে বাস করে পাঁচশ রাক্ষস। তারা সকলে প্রতিদিন সকাল হলে অন্য দ্বীপে চরা করতে যায়, আর সন্ধ্যায় ফিরে আসে। যাওয়ার সময় আমাকে এই ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যায়, আর সন্ধ্যায় ফিরে আমাকে জাগায়। তাদের আসার সময় হয়ে গেল। তুমি পালাও, তা না হলে তাদের হাতে তোমার প্রাণ যাবে।
ছোটো রাজকুমার বলল, আমি আর কোথাও যাব না। মরতে হলে মরব, তোমার সামনেই মরব। তোমাকে না বাঁচিয়ে আমিও বাঁচতে চাই না।
রাজকুমারী কী যেন বুঝে হাসল।
মুক্তোর মতো সুন্দর দাঁতের হাসি ছাড়িয়ে পড়ল। যেন ছড়িয়ে পড়ল এক রাশ জুঁই ফুল। যেন ছড়িয়ে পড়ল স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না। সেই হাসি দেখে রাজকুমার বলল, আমাকে আর অন্য কোথাও যেতে বলো না। আমি যাব না।
কিন্তু রাজকুমারী রাজকুমারকে বাঁচানোর চেষ্টায় আতঙ্কিত হল। বলল, এখন আমি কী করি ! তুমি এক কাজ কর। ওই দেখ, রাজবাড়ির প্রাঙ্গণের দক্ষিণ কোণে এক শিবমন্দির। শিবমন্দিরের ভেতর বেলপাতার স্তুপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখো। রাক্ষসরা বেলপাতার গন্ধে তোমার গন্ধ বুঝে উঠতে পারবে না। আবার তোমার সঙ্গে আগামীকাল কথা হবে। ওরা এখনই এল বলে। পালাও আর হ্যাঁ, একটা কথা ওরা সকাল হলে আমার মুখের কাছে রূপোর বাতিদান এনে ঘুম পাড়ায়, আর সন্ধ্যায় সোনার বাতিদান এনে জাগায়। তুমি এখন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাও। তা না হলে ওরা সন্দেহ করবে।
কথা মতো রাজকুমার তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। আর তারপর দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে তাড়াতাড়ি মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
সন্ধ্যা হয়ে যেতেই রাক্ষসগুলো হাঁউ-মাঁউ রবে ছুটে হাজির হল। তাদের পায়ের দাপাদাপিতে কেঁপে উঠল সেই পাষাণপুরী। শিবমন্দিরের ভেতর লুকিয়ে থাকা রাজকুমারের প্রাণ ভয়ে ধুকপুক করতে লাগল।
ততক্ষণে রাক্ষসদের বুড়িরানি রূপবতী কন্যাকে জাগিয়ে তুলেছে। সে হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করে বলল, মানুষের গন্ধ পাঁউ কেন রে মেয়ে ! এখানে কোনো মানুষ আছে না কি ?
রূপবতী কন্যা তখন তার গা টিপতে-টিপতে বলল, কী যে বলো, মা ! আমিই তো মানুষ, আমার গায়েরই গন্ধ পাচ্ছ বোধহয়। যদি খাওয়ার ইচ্ছা হয়, আমাকে খাও।
একথা শুনে রাক্ষস-বুড়ি এক হাত জিভ কেটে বলল, এমন কথা বলতে পারলি, মেয়ে ? যদি খাওয়ার ইচ্ছে হতো, তাহলে কবে খেয়ে ফেলতাম তোকে। তোর সুন্দর মুখ দেখে আমি মজেছি। তোকে মেয়ের মতো ভালোবাসি। রাজবাড়ির সবাইকে আমার মায়াবিদ্যায় পাষাণ করে দিয়েছি। তোকেও কবে পাষাণ করে দিতাম। তা দিতে পারলাম কই ?
কিছুক্ষণের মধ্যে রাক্ষস-বুড়ি ঘুমিয়ে পড়ল। আর ঘুমিয়ে পড়ল অন্য সব রাক্ষস অনুচরেরাও।
পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসরা হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ করে চলে গেল। মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ছোটো রাজকুমার। সোনার বাতিদান টেনে এনে মুখের কাছে ধরতেই জেগে উঠল কন্যা। সারাদিন ধরে নানা কথাবার্তায় মশগুল হল তারা। চলল নানা সলা-পরামর্শ। কি করে হতে পারে রাক্ষস নিধন। কি করে মায়াবিদ্যার প্রভাবে পাষাণ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো ফিরে পেতে পারে প্রাণ।
সন্ধ্যার আগেভাগে রাজকন্যা পালঙ্কে ঘুমিয়ে রইল। আর রাজকুমার ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতর। তারপর রাক্ষসেরা মহাকলরবে ফিলে এল।
রূপবতী কন্যা প্রতিদিনের মতো পা টিপে দিতে লাগল রাক্ষস-বুড়িকে। পরিকল্পনা মতো চোখের জল ফেলল কয়েক ফোঁটা বুড়ির গায়ে।
বুড়ি চমকে উঠল, একি ! তুই কাঁদছিস কেন বেটি ?
রাজকন্যা বলল, তোমার তো বয়স হয়েছে, কতদিন আর বাঁচবে ? তারপর আমার কি হবে ? তোমার অনুচরেরা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
রাক্ষস-বুড়ি বলল, আমি মরব না। আমার সঙ্গীরাও মরবে না। খুব গোপন কথা বলছি, আমাদের প্রাণ-ভোমরা কৌটোয় করে পোঁতা আছে সরোবরের শ্বেতপদ্ম গাছের গোড়ায়, পাঁকে। কেউ যদি এক ডুবে তুলে এনে সেই ভোমরাকে মেরে ফেলতে পারে মাটিতে রক্ত না ফেলে, তবেই আমাদের মরণ। তা না হলে নয়।
রূপবতী জিজ্ঞেস করল, তোমার মায়াবিদ্যার প্রভাবে আজ সবাই তো পাষাণ হয়ে গেছে। কী করে ওই মায়া কাটে ?
রাক্ষস-বুড়ি বলল, তোর তা জেনে লাভ কি ? তবে বললি যখন শুনে রাখ। ওই শ্বেতপদ্ম গাছের মূল তুলে এনে পূব মুখে বসে শিলে বেটে, এক কলসী জলে মিশিয়ে, এবার পাষাণ হওয়া মানুষের ওপর ছিটিয়ে দিলে তারা প্রাণ ফিরে পাবে। বুঝলি, মেয়ে ! তুই এখন চুপ কর, বড়ো ঘুম পাচ্ছে। এই বলে ঘুমিয়ে পড়ল বুড়ি।
পরের দিন সকাল হল।
রাক্ষসরা সবাই চলে গেল চরা করতে।
এবার রূপবতী ও রাজকুমার খাওয়া-দাওয়া সেরে সরোবরের তীরে হাজির হল। এমন সময় উড়ে এল সেই ব্যাঙ্গমা পাখিটি। আকাশে চক্কর মেরে সে ডেকে উঠে নির্দেশ দিল রাজপুত্রকে-
কুরুর কুরুর কু....
বলতে এলাম কু,
কাজটি আদৌ নয় তো সোজা
বিপদ আছে কৌটো খোঁজা
পদ্মমূলে সাপের বাসা
বিষথলি তার বিষে ঠাসা
‘ছু মন্তর ছু,....
বিপদ সবই কেটে যাবে
কুরুর কুরুর কু....
এই বলে উড়ে গেল ব্যাঙ্গমা। রাজপুত্র নামল সরোবরের জলে। ডুব মেরে পদ্মমূলের বিষধর সাপকে বশীভূত করে, পাঁকের ভেতর থেকে তুলে আনল প্রাণ-ভোমরার কৌটো। যাতে মাটিতে রক্ত না পড়ে তাই ছাই-এর ওপর রেখে পিষে মারল ভোমরাকে। পিষে মারার আগে রাক্ষসেরা তাদের বিপদ অনুধাবন করে ছুটে আসছিল চরা ফেলে। মাঝপথে যে যার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল। বুড়ি রাক্ষসী মরার আগে হাঁউ-মাঁউ করে রাজকন্যাকে বলল, তোর মনে এই ইচ্ছা ছিল শয়তানী !
রাজকুমার আবার ডুব দিয়ে পদ্মের মূল তুলে আনল। আর পুব দিকে মুখ করে পদ্মমূল শিলে বাটতে বসল রূপবতী। এমন সময় কোথা থেকে সেই ব্যাঙ্গমা পাখিটি উড়ে এসে বসল গাছের ডালে। সে বলে উঠল-
কুরুর কুরুর কু...
বলতে এলাম সু,
সুদিন এবার আসবে তোদের
কুরুর কুরুর কু।
পদ্মমূল বাটা সাঙ্গ হলে কলসীর জলে মেশানো হল। কথা মতো জল ছিটিয়ে দিতেই, কেটে গেল রাক্ষসের মায়াজাল। একে-একে সবাই পাষাণ দেহ থেকে রক্ত-মাংসের শরীর ফিরে পেল। প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে উঠল সবাই। রাজা, রানী, মন্ত্রী, সেপাই, রাজকর্মচারী যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল এক যুগ পরে।
রূপবতী রাজকন্যা ও ছোটোরাজকুমার প্রণাম করল রাজা ও রানীকে।
পরিচয় করিয়ে দিয়ে রূপবতী বলল, বাবা, এ এক ভিন রাজ্যের রাজকুমার। এ না থাকলে তোমরা কেউ পাষাণ দেহ থেকে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারতে না।
সবাই খুশি। সেই খুশির ভেতর একদিন শুভ কাজ সম্পন্ন হল। বিয়ে হল রূপবতীর সঙ্গে রাজকুমারের মহা ধুমধামে।
এই বিয়ের কয়েকদিন পর রাজা বললেন, আমার আর রাজকার্য চালানোর ইচ্ছে নেই। জামাই ছোটো রাজকুমারই হবে এই রাজ্যের রাজা। তাকে আমি আমার রাজ সিংহাসনে অভিষেক করতে চাই।
তাই হল। ছোটো রাজকুমার হল সেই রাজ্যের রাজা। ছোটো রাজকুমার রাজা হয়ে তার মাকে একদিন চতুর্দোলায় চাপিয়ে নিয়ে এল বনের ধারের সেই নতুন রাজবাড়িতে। আসার আগে তার বড়ো ভাইকে ছেড়ে দিয়ে এল তার পিতার রাজ্যের অধিকার।
তারপর তারা সবাই বসবাস করতে লাগল সেই পাষাণপুরের রাজবাড়িতে। পরম সুখে। পরম আনন্দে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১৪
2 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লাগলো ।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ। খুব ভালো থাকুন। সর্বদাই চিরকালের ছেলেবেলার সঙ্গে থাকুন!
মুছুন