‘এলি তবে’। ট্রেনটা প্লাটফর্মে থামতেই দূর থেকে জয়ন্তর গলা ভেসে এল। আগেই ও বলে দিয়েছিল, ‘শেষ কামরায় উঠবি, তাহলে বেশি হাঁটতে হবে না।’
শিয়ালদহ থেকে আমরা দুটো পাঁচের গেদে লোকাল ধরেছিলাম, পাক্কা আড়াই ঘন্টা পর যখন জয়ন্তর বলে দেওয়া প্লাটফর্মে নামলাম, তখন শেষ বিকেল।
আমরা বলতে আমি আর বিনয়। পরীক্ষা শেষ হতেই জয়ন্ত ধরেছিল, ‘ছুটিতে আমাদের বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে যা।’
বিনু মুখ বেঁকিয়েছিল, ‘তোদের বাড়ি! সেই তো ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুর।’
বিনয়ের কথা শুনে জয়ন্তর মুখে যখন আলকাতরার প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে আমি তখন বললাম, ‘কেসটা কী বলতো জয়ন্ত ? এত সাধাসাধি করে তোদের গ্রামের বাড়িতে যেতে বলেছিস কেন ?’
‘জিরেন-কাটের রস খেয়েছিস ?’ জয়ন্ত বলল, ‘বাবা, এবারে দু’বিঘা জমি কিনেছে। অনেকগুলো খেজুর গাছ জমিটায় আছে। তাই বাবা-ই বলল, ‘তোর বন্ধুদের আসতে বলিস।’’
আমি জয়ন্তর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললাম, ‘যাচ্ছি রে, বিনুও যাবে।’
শীতকালের বিকেল। ঝুপ করে সন্ধে নেমে যায়। আমরা তিনজন তাড়াতাড়ি প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এলাম। জয়ন্ত বলল, ‘ভ্যান-রিকশা ধরবি ?’
-‘হেঁটে গেলে কতক্ষণ লাগবে ?’
বিনু বলল, ‘এত গাছপালা দেখার লোভ সামলানো যাচ্ছে না।’
জয়ন্ত হাসল, ‘তাহলে ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরেও কিছু দেখার থাকে! চল্। হেঁটে গেলে আধঘন্টার মতো লাগবে।’
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা তিনজনে দোতলার একটা ঘরে শুতে গেলাম। দোতলা বাড়িটা দেখে বিনয় মন্তব্য করেছিল, ‘অদ্ভুত না!’
সত্যিই অদ্ভুত দোতলা বাড়ি। একতলার ছাদটা কাঠের তৈরি। ঘরের দেওয়ালগুলো মাটির। আর দোতলার ছাদটা টিনের। কাঠের ছাদ দেখে বিনয় ঠিক ভরসা পাচ্ছিল না। আমাদের দেখে জয়ন্ত মন্তব্য করল, ‘ভয় লাগছে নাকি ? এ তো সবে সন্ধে!’
‘মানে’, বিনয় চেঁচাল, ‘রাত হলে কী হবে ?’
জয়ন্ত অদ্ভুতভাবে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। ঘড়িটা দশবার ঢং ঢং আওয়াজ তুলে ইস্তফা দিল।
দশটা বাজে। অথচ কি অদ্ভুত নীরবতা চারিদিকে! নীচতলা থেকে মাঝে-মাঝে কাশির শব্দ
আসছে। জয়ন্তর কথা মতো ওর ঠাকুরদার বয়স নাকি নব্বই ছাড়িয়েছে।
দূরে কোথাও কোরাসে একপাল কুকুর ডেকে উঠল। আমার মনে হল ওরা বিনয়ের কথার প্রতিবাদ জানাল।
শীতের রাত। চারিদিক নিঝুম। তার মধ্যে জয়ন্তর গল্প আশ্চর্য রূপকথার মতো লাগছিল।
হঠাৎ করে কুকুরের ডাক শুনে বুকের মধ্যে ধড়াস্ ধড়াস্ করে উঠল। জয়ন্তকে বললাম, এত রাতে কুকুর ডাকছে ? চোর-টোর এল নাকি ?
জয়ন্ত মুচকি হাসল। বলল, ‘ওগুলো শিয়ালের ডাক। গ্রামে রাত কাটানোর এটাই তো মজা। কত বিচিত্র শব্দ শুনতে পাবি। ঝিঁঝিঁর ডাক, পেঁচার ডাক। বাদ দে। কাল তোদের নদীটা দেখাব। নদীর পাশেই মন্দির। পাঁচকুঠুরির দালান। এখানকার মানুষের বিশ্বাস মন্দিরের দেবতা মাঝে-মাঝেই রাত্রে জেগে উঠেন। কেউ কেউ নাকি নিজের চোখে দেখেছে।’
‘ধ্যুস্ ! জয়ন্ত তোর গুল-গল্প বন্ধ কর। কাল আবার সকাল-সকাল উঠতে হবে।’ বিনয় বলল।
জয়ন্ত লাইট বন্ধ করে দিল। ঘুমটা তখনও গাঢ় হয়নি। একটা মৃদু টুং টাং শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। জয়ন্তকে ধাক্কা দিলাম, ‘এই জয়ন্ত, জয়ন্ত ওঠ’ বলে কয়েকবার ডাকার পর জয়ন্ত উঠল। তারপর লাইটটা জ্বালিয়ে দিল।
বিনয় অনেকক্ষণ জেগে ছিল। বলল, ‘নিচে কারো মোবাইল বাজছে।’
জয়ন্ত হাসল। জানলাটা খুলে দিয়ে আমাদের ডাকল, ‘এদিকে আয়।’
জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। চাঁদের আলো আর কুয়াশা মেখে চারিধার কেমন যেন রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। তবে জানলা খোলাতে শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
-ভালো করে শোন।
-মনে তো হচ্ছে সেতার বাজাচ্ছে কেউ। বিনয় বলল, ‘এত রাত্রে কে বাজাচ্ছে ? হাত কিন্তু দারুণ।’
-এটা ওই গুল-গল্পের কীর্তন হচ্ছে, বুঝলি। জয়ন্ত বলল।
-মানে ? আমি বললাম। রাত-বিরেতে এটা কি হচ্ছে বল তো ?
-কেন ? বিনু তো আগেই বলেছে সব গুল-গল্প। গাঁজাখুরি। তাই হচ্ছে। ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে এর থেকে আর কি বেশি আশা করিস ? - জয়ন্ত বলল।
বুঝলাম জয়ন্ত চটেছে। বললাম, ‘শহরে থাকি। এসবের আমরা কি বুঝব। তুই একটু খোলসা করে বল।’
-ঠিক আছে। জয়ন্ত বলল, বলব, সব বলব, তবে আজ রাতে না। কাল সকালে।
-এটা কি ফল রে ? বিনয় বলল। আমাদের ওদিকে তো পাওয়া যায় না।
-গাব ফল, খেয়েছিস ? গাব ফলের গা-টা চিরে দিলে যে আঠা বেরোয় সেটা ফেভিকলের বাবা। পাকা গাব অনেকটা সবেদার মতো খেতে। জয়ন্ত বলল।
-আরে জয়ন্ত তুই আঠার গল্প বলে তো নিজের মুখই বন্ধ করে দিলি। কালকের রাতের ঘটনাটা কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছিস। আমি বললাম।
জয়ন্ত হাসল, ‘আমি কিছু বললেই তো বলবি গাঁজাখুরি-গুল-গল্প শোনাচ্ছি।’
-ক্ষমা দে। বিনয় বলল, অবশ্য তোর কথা শোনাতে অত ইন্টারেস্ট নেই আমার। তোদের খেজুর গাছ আর কত দূর ?
-জয়ন্ত, তুই বিনয়ের কথাতে রাগ করিস না। প্লিজ, কালকের ঘটনাটা বল।
-না-না। রাগ করব কেন ? জয়ন্ত বলল, কাল পূর্ণিমা ছিল, সেটা নিশ্চয়ই জানিস। আর প্রতি পূর্ণিমাতেই গভীর রাতে সেতারের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। গ্রামের লোকের বিশ্বাস পূর্ণিমার রাতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তিতে প্রাণ ফিরে আসে। সবই লোককথা।
আমি বললাম, ‘আজ তো মন্দির আর নদী দেখতে যাবার কথা ছিল।’
-যাব তো। তার আগে খেজুরের রস খেয়ে নে। জয়ন্ত একটু দম নিল। বিনয়, ওই যে খেজুর গাছ দেখা যাচ্ছে।
দুদিনের প্রোগ্রাম ছিল। জয়ন্ত আর বিনয় প্লাটফর্মে বসে আছে। আমি যখন প্লাটফর্মে পৌঁছলাম, তখনও ট্রেনের আধঘন্টা দেরি।
-কোথায় গিয়েছিলি মিঃ তোপসে ? - বিনয় হেসে বলল, মামাকে তো নিয়ে এলেই পারতিস।
বিনয় মাঝে মাঝেই আমাকে তোপসে বলে ডাকে। বললাম, মামাকে তো আসতেই হবে। জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বললাম, এবার পুজোতে তোদের গ্রামের বাড়ির পুজো দেখতে আসব। সঙ্গে কিন্তু মামা আসবে।
-কিন্তু ব্যাপার কি বল তো ? সকালে একবার মন্দিরটা দেখে এলি, আবার প্লাটফর্মে আসার সময় একা-একা গেলি ? জয়ন্ত বলল, ট্রেনের কিন্তু বেশি দেরি নেই। কেসটা কি, তাড়াতাড়ি বল।
আমি পকেট থেকে একটা টেপ রেকর্ডারের ক্যাসেট বের করে বললাম, এটা বাড়ি ফেরার সময় মন্দিরের পুরোহিতকে দিয়ে দিবি। ওনাকে বলা আছে। তোদের দেখাব বলে এনেছিলাম।
ক্যাসেটটা দেখে বিনুর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। -কাল রাতে রেকর্ড করা সেতার বাজছিল।
-হ্যাঁ। আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। তাই আরেকবার মন্দিরে গেলাম। পুরোহিত তখন দুপুরের ভাতঘুম দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর মন্দিরের ভেতরে রেকর্ড ক্যাসেট আর টেপ রেকর্ডার দেখতে পাই। কোথায় ছিল ওটা জানিস ?
-কোথায় ? বিনু আর জয়ন্ত একসঙ্গে বলল।
-মন্দিরের ভেতরে। রাধাকৃষ্ণের বেদীর উপর টেপটা ছিল। তার ওপর চাদরের মতো কিছু চাপা ছিল। আর তারও উপরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই।
-ছিঃ, কি বাজে ব্যাপার। জয়ন্ত বলল। কিন্তু তুই ব্যাপারটা বুঝলি কি করে ?
-আমি ভাবলাম, রাতে যদি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রাণ ফিরে পায়, তাহলে নিশ্চয়ই স্ট্যাচু হয়ে থাকবে না। নড়াচড়া করবেই। আমি এই ব্যাপারটাই দেখতে গিয়েছিলাম। যাইহোক, ব্যাপারটা কাউকে জানাস না, এতে তোদের গ্রামের মানহানি হবে। তাছাড়া বেচার পুরোহিতেরও রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।
-কিন্তু তোর কথা মতো পরেরবার পূর্ণিমাতেও একই রেকর্ড বাজবে।
-হ্যাঁ, আমি পুরোহিতকেও তাই বলে এসেছি। রাতে সেতার না বাজলে মন্দিরের মহিমা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বললাম।
-তাই বলে দেবতার সঙ্গে প্রতারণা ! জয়ন্ত মর্মাহত।
-নারে, এটা ঠিক প্রতারণা নয়। ইতিহাসকে ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। তাছাড়া নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইও বটে। আমি বললাম।
-শোন, বিগ্রহের ঠিক নিচে একটা গোপন কুঠুরি আছে। ওখানে একটা সেতার সত্যি সত্যিই আছে, আর ওটা একসময় বাজতও।
-এখনও রাখা আছে! জয়ন্ত বিস্মিত গলায় বলল, কিন্তু তুই এতসব জানলি কী করে ?
-মন্দিরের পুরোহিতই বলল। অবশ্য উনিও পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছেন। আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু উনি তখন একটা হাতে লেখা বই বের করে আনলেন। সংস্কৃতে লেখা। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মহন্ত পূর্ণদাসের নিজের হাতে লেখা।
-তুই পড়লি ? বিনু বলল।
-আমার সংস্কৃত জ্ঞানে এইট পাশ করা যায়। এর বেশি নয়। তাই পুরোহিতের কথায় বিশ্বাস করলাম।
-কিন্তু মহন্ত পূর্ণদাস কে ? জয়ন্ত বলল, এত ব্যাপার তো জানতাম না।
-উনি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। অনেক গল্প আছে। শুধু এটা বলে রাখি, বহু বছর আগে মন্দিরের চূড়োয় ধাতব পাখা লাগানো থাকত। পাখার ব্লেডগুলো তামার তৈরি ছিল। আর জোরে হাওয়া দিলে পাখাটা ঘুরত। পাখার সঙ্গে মন্দিরের নিচে গোপন কুঠুরিতে রাখা লুকোনো সেতারের যোগ ছিল। ফলে সেতার মাঝে-মাঝে আপনিই বেজে উঠত।
-কিন্তু রেকর্ডারের গল্প ? বিনয় বলল।
-বছর কুড়ি আগে মন্দিরে বড়ো চুরি হয়েছিল। তখনই চোরের দল মন্দিরের চূড়ার তামার পাখাটা খুলে নিয়ে পালিয়েছিল। অন্ততঃ পুরোহিতের বক্তব্য তাই।
-নারে সত্যিই চুরি হয়েছিল। আমার ঠাকুরদার মুখে বহুবার শুনেছি।
-তারপর থেকেই মন্দিরের সেতারের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। লোকমুখে রটে যায়, পাপের স্পর্শে রাধাকৃষ্ণ পালিয়েছে। মন্দিরের ভক্ত সংখ্যাও কমে যায় দ্রুত। রোজগারও কমে যায় পুরোহিতের। তখন বুদ্ধি করে রেকর্ড করা সেতার বাজাতে শুরু করে।
-আশ্চর্য ! ইতিহাস ! বিনয় বলল, ট্রেন ঢুকছে রে।
-জয়ন্ত যা বললাম তাই কর। আমি কথা দিয়েছি ব্যাপারটা কাউকে জানাব না।
ট্রেনের জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললাম, তুইও কাউকে কিছু বলিস না। পুজোর ছুটিতে মামাকে নিয়ে আসব। মামা সংস্কৃত জানে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ