Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আলোর হাতছানি ।। অনিন্দ্য ভুক্ত




রোজ বিকেলে এখানেই আড্ডা বসে ওদের। আজ আসতে একটু দেরি হয়ে গেল অলোকের। এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। গেল কোথায় সব, ভাবতেই মনে পড়ে গেল টী-টোয়েন্টীর ম্যাচ চলছে। আজ আর কারো টিকিটিও পাওয়া যাবে না।

মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। এই এক ঝামেলা হয়েছে। আরে বাবাখেলতে পারলে নিজে খেলো না। তা নয় পরের খেলা দেখে সময় নষ্ট। গলাও নষ্ট - চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে। বসে বসে খেলা দেখার চেয়ে আড্ডা মারা বোধহয় ঢের গুণ ভালো।

খানিকক্ষণ গুম হয়ে মাঠের ধারে বসে রইল অলোক। একা-একা করবেটাই বা কি ? কারো বাড়ি যাবে, সেখানেও তো সব হাঁ করে টিভি গিলছে। সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে উঠে পড়ল। আজ জঙ্গলে ঢুকবে। অন্যদিন কথাটা উঠলেই সবাই হাঁ-হাঁ করে ওঠে। আজ নিশ্চিন্তে ঢোকা যাবে।

কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল অলোক। চারটে বাজে। সন্ধে গড়াতে তার মানে এখনো ঘন্টা-আড়াই। বেশিদূর না ঢুকলেই হল, বেলাবেলি ফিরে আসা যাবে। খেলা দেখে রতনরাও হয়ত ততক্ষণে মাঠে এসে যাবে।

গ্রামের শেষপ্রান্তে এই মাঠ। আর মাঠ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই শুরু জঙ্গলের। লম্বায়, চওড়ায় পেল্লায় এক জঙ্গল। যেমন পেল্লায়, তেমনি ঘন। ওরা বলে পাগলাঝোরার জঙ্গল। কেন বলে সে কথা অবশ্য কেউ জানে না। ঘন জঙ্গল, দিনের বেলাতে আলো ঢোকে খুব কম। তবে সেটা জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ঢুকলে তারপর। দিনদুপুরে সামনাসামনি সবাই ঢোকে, ওরাও কতবার ঢুকেছে, কিন্তু বেলা পড়লে কেউ আর জঙ্গলের পথ মাড়াতে চায় না। অলোকের বহুদিনের ইচ্ছে জঙ্গলের গভীরে ঢুকবে, তাও আবার বিকেলের দিকে। ও দেখতে চায় কী আছে বিকেলের জঙ্গলে, কিন্তু বন্ধুরা ঢুকতে দিলে তবে তো।

বেশি ভাবনা না বাড়িয়ে চট করে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল অলোক। সামনের দিকের চেনা অংশটুকু পেরিয়েও এল দ্রুত। আর চেনা অংশটা পেরিয়ে আসতে আসতেই মুগ্ধতা বাড়ছিল। কত নাম না জানা গাছ, কত অচেনা ফুল কত অজস্র পাখির কিচির-মিচির। আরো খানিকটা ঢুকে আসতে বিস্ময় বেড়ে গেল অলোকের। আলো আসছে। জঙ্গল এখানে যেন একটু পাতলা। বিকেলের পড়ন্ত লালচে আলোয় মনে হচ্ছে যেন জঙ্গলে আগুন লেগেছে। দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দাঁড়ালে চলবে না। ভেতরে আরো কত কি দেখবার আছে কে জানে! অলোকের নেশা ধরে যাচ্ছিল।

আরেকটু ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল ও। কী বিশাল দীঘি। পদ্মদীঘি। নিজের মনেই নাম দিয়ে ফেলল। আর এগোতে ইচ্ছে করছিল না। পা দুটো কেউ যেন মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে। হঠাৎ অলোক দেখল দীঘির একপাশের জলে যেন কালো ছায়া পড়ল। প্রথমটায় চমকে উঠলেও অলোক বুঝতে পারল গাছের আড়ালে সূর্য্য নেমে যাচ্ছে।

সর্বনাশ বুঝে ওঠার আগেই ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল। নিকষ কালো অন্ধকার। যতই সাহসী হোক। এই অবস্থায় ভীতু আর সাহসীর মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকে না। অলোকের মনে হচ্ছিল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কষ্ট করে মনের জোর ফিরিয়ে ও পিছু ফিরে হাঁটা লাগাল। জঙ্গলে অন্ধকার নামে আগেই। ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন ছটা। তার মানে বাইরে এখনও আলো আছে। তাড়াতাড়ি পা চালালে এখনও ফেরা যাবে।

কিন্তু চালাবো বললেই তো আর চলে না। অন্ধকারে আন্দাজে এগোনো হয়। হাতড়ে-হাতড়ে এগোতে-এগোতেই হঠাৎ দূরে একটা আলোর রেখা চোখে পড়ল। মনে একটু ভরসা এল যেন। আলো কেন যে ভয় কাটিয়ে দেয় কে জানে। অলোকের গতিবেগ দ্রুত হল আলোর বিন্দুর দিকে চেয়ে।

কয়েক মিনিট হাঁটার পর খেয়াল হল ও আলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না, বরং আলো যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আরো জোরে পা চালাতে হবে। হঠাৎই আলোর বিন্দু দুটো হল। কিন্তু দুটো আলো তো পাশাপাশি নয়। অলোক বিভ্রান্তবোধ করল। কোনদিকে যাবে ? ঠিক করে ওঠার আগেই আবার একটা আলোর বিন্দু ফুটে উঠল চোখের সামনে, ঠিক যেমন আকাশে তারা ফুটে ওঠে সেভাবেই যেন।

দেখতে দেখতে আলোর মালার মধ্যে যেন আটকে গেল অলোক। অমাবস্যার রাতের মতো যেন তারায় ভরা আকাশ। অলোকের মনের থেকে ভয় চলে গেল। ও মুগ্ধ হয়ে আলোর মালা দেখছিল। আস্তে আস্তে আলোর বিন্দুগুলো নাচতে শুরু করল ওর চোখের সামনে। কেউ যেন মন্ত্রের মতো অবশ করে দিচ্ছিল অলোককে। হঠাৎই অলোক আবিষ্কার করল ও সেই পদ্মদীঘির সামনে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ তাহলে কি ও এই দীঘির চারপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছিল।

ভালো করে দীঘির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠল অলোক। একটা হাত। একটা চুড়ি পরা হাত। হাতটা ডুবে যেতে-যেতে যেন ভেসে উঠছে। বুঝতে দেরি হল না অলোকের। কতবার যে এমন ডুবন্ত মানুষকে বাঁচিয়েছে ও। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কেন দাঁড়িয়ে আছে, সব ভুলে ঝাঁপ মারল অলোক।

পরদিন সকালে অলোককে খুঁজতে-খুঁজতে গ্রামের লোক পাগলাঝোরার জঙ্গলের সেই ভেতরে ঢুকে এল। যেখানে এর আগে কখনও আসেনি তারা। এসে দেখল দীঘির পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অলোক। তার ডান হাতটা সামনে বাড়ানো, ঠিক যে ভঙ্গিতে তাকে গ্রামের পুকুরপাড়ে আগেও অনেকবার দেখেছে সবাই।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ