Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মামদো ভূতের ঝকমারি ।। সুকুমার মণ্ডল



এমন মুস্কিলে পড়তে হবে তা যদি আগে জানা থাকত তবে মামদো কক্ষণো শহরে আসত না। বেঁচে থাকতে এত তাচ্ছিল্য সে কোনোদিন পায়নি, ভূত হয়ে ইস্তক তো নয়ই। সবাই মামদোকে দেখা মাত্রই ভিরমী খেয়েছে, কেউ-কেউ মুখে গ্যাঁজলাও তুলেছে। আর এসবই ভূত হিসাবে এতকাল অসীম তৃপ্তী জুগিয়েছে মামদোর মনে।

বেশ চলছিল এভাবেই, সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল ওই ফিজেল শাঁকচুন্নীকে দেখার পর থেকে। নদী পাড়ের হোগলাবনের ভূত পরিবারটি ভূত সমাজে বেশ খানদানী এবং ওই এলাকায় খুব প্রভাব প্রতিপত্তি। ওই পরিবারের মেয়ে শাঁকচুন্নী, ছটফটে, দুষ্টু। কোনো এক অমাবস্যার রাতে শ্মশানের ধারের মাঠে আচমকা মুখোমুখি হয়ে গেছিল। প্রথম দর্শনেই মামদো কাত্। শাঁকচুন্নীর পেছু-পেছু ইনিয়ে-বিনিয়ে মনের কথা জানাতে গেছিল। কয়েক কদম যাওয়ার পর বলা নেই কওয়া নেই শাঁকচুন্নী মামদোর ঠ্যাং ধরে দিল এক টান। সঙ্গে খিলখিল হাসি। মামদো সটান ভূমিষ্ঠ। এমনভাবে অপদস্থ সে কোনোদিন হয়নি আগে। অন্য কেউ হলে মামদো ছেড়ে কথা বলত না। কিন্তু মেয়েদের গায়ে যখন খুশি হাত তোলার অবাধ অধিকার জ্যান্তদের সমাজে চালু থাকলেও, ভূত সমাজে নিষিদ্ধ। রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে মামদো হুঙ্কার দেয়, ‘এই এলাকার সব ভূত আমাকে ভয় করে আর তুমি কিনা ...।

-কচু করে। খিলখিলিয়ে শাঁকচুন্নী বলে উঠেছিল। তোমাকে কেউ ভয় করে নাকি ? মানুষই ভয় পায় না, আবার ভূত! আগে প্রমাণ করে দেখাও যে মানুষরা তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছে, তবে বুঝবো তুমি সত্যিকারের বাহাদূর ভূত।

ব্যাস্, এই কথা শোনার পর থেকে কি যে হয়ে গেল মামদোর মধ্যে। এক অদ্ভুত জেদ জন্মাল তার মনে। শাঁকচুন্নীর কাছে তার বাহাদুরীর প্রমাণ পেশ করতেই হবে, নইলে তার ভূত জন্ম বৃথা। মানুষদের ভয় দেখানো কি এমন কঠিন কাজ। মানুষরা তো ভীতুর ডিম। একটু আঁধার-আবডাল দেখে দাঁত ছিরকুটে নাচন-কোদন করলে আচ্ছা-আচ্ছা সাহসীভিরমী খেয়ে যাবে। তারপর শাঁকচুন্নীর কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হওয়া। আহঃ দারুণ রোমান্টিক ব্যাপার হবে। ফুরফুরে মন নিয়ে গ্রামের বাঁশবাগানের আস্তানা ছেড়ে শহরে পৌঁছে গেল সে এক সন্ধ্যায়। গলির শেষপ্রান্তে একতলা বাড়িটা। ছাদের একধারে ছোটো একটা ঘরে বিল্টু মন দিয়ে পড়া মুখস্ত করছে। মাস্টারমশাই একটু আগে পড়িয়ে চলে গেছেন। আর কদিন পরে পরীক্ষা, অথচ ইতিহাসের সাল তারিখগুলো কেবল জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বিল্টু প্রাণপনে চোখ বুজিয়ে মুখস্ত করছিল, এমন সময় সামনের খোলা ছাদে অন্ধকারে কে যেন খটাখট্ আওয়াজ করতে থাকে।

ছেলেটা পড়া থামিয়ে ওর দিকে তাকিয়েছে দেখে মনে-মনে মহা খুশি হয় মামদো। ছেলেটাকে বেদম ভয় পাইয়ে দিতে মামদো এবার প্রাণপণে খিলখিল শব্দে বুক হিম করা এক হাসি ছাড়ল। ছেলেটা নির্ঘাৎ আঁতকে উঠে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু এটা কেমন হল।

বিল্টু ভয় তো পেলই না, উল্টে একরাশ বিরক্তি নিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, ‘দাশুদা ভালো হবে না বলছি, ছোড়দিকে ডাকব ?’

-আমি দাশুদা নই, আমি ভূত।

-ভূত না হাতি। আমি জানি না ভেবেছ। এই তো পরশুদিন তুমি আগাপাশতলা সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে ছোড়দিকে ভয় দেখাতে ছাদে এসেছিলে। কেমন জব্দ হয়েছিলে মনে নেই ? ছোড়দি যে টেস্টপেপারটা তোমার মুখে ছুঁড়েছিল, সেটা এখনও টেবিলে আছে। তোমার দেখছি শিক্ষা হয়নি। যাবে ? নাকি ছুঁড়ব এটা ?

টেবিলের ওপরে গাট্টাগোট্টা থান ইটের মতো লাল বইটার দিকে চোখ পড়তেই মামদোর বুক ভয়ে কেঁপে উঠল।

-কি সাংঘাতিক ছেলেরে বাবা। ভূত বলে গেরাহ্যি করতে চায় না। এখানে বিশেষ সুবিধা করা যাবে না মনে হচ্ছে! অগত্যা অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে, প্রায় চোখের নিমিষে।

ভারী মনমরা হয়ে কিছুদূরে একটা বাতি নেভা লাইটপোস্টের টং-এ চড়ে বসে সে। ভেবেছিল ওকে দেখেই সকলের প্রাণ খাঁচাছাড়া অবস্থা হয়ে যাবে আর মামদো ফিরে গিয়ে শাঁকচুন্নীকে নিজের বীরত্বের কাহিনি শুনিয়ে মন জয় করবে। তারপর ধুমধাম করে বিয়ে, তারপর হনিমুন, তারপর... ওফ্ আর ভাবতে পারে না সে। প্রথম ধাক্কাতেই মামদোর পরিকল্পনা যেভাবে ধাক্কা খেল তাতে সব সুখস্বপ্ন কেমন আবছা হয়ে যাচ্ছে।

বোধহয় ঢুলুনি মতো এসেছিল, হঠাৎ নীচে কি একটা গোলমাল শুনে চটকা ভেঙে গেল। একটা লোক আর এক মহিলাকে ঘিরে ধরেছে জনাপাঁচেক প্যাঁকাটি চেহারার ছোকরা। তাদের হাতে ছোরা, পিস্তল। আবছা অন্ধকারেও ছোরাগুলো ঝিলিক দিচ্ছে। বাপস্ কি কাণ্ড হচ্ছে ওখানে! বিস্ফারিত চোখে মামদো দেখল কাঁপতে-কাঁপতে মেয়েটি গায়ের গয়নাগাঁটি খুলে দিচ্ছে আর সঙ্গের লোকটি ঘড়ি, টাকার ব্যাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওদের দুজনের মুখই ভয়ে ফ্যাকাশে। সামনে ভূত দেখলেও এত ভয় পেত কি ওরা! ডাকাতকে দেখছি সবাই ভয় করে। এসব ভাবতে-ভাবতে নীচের রাস্তায় সবাই হাওয়া। তা হোক্, মামদো রাস্তা খুঁজে পেয়েছে।

খানিক পরে দুজন লোক ইতি-উতি তাকাতে-তাকাতে সেই লাইটপোস্টের নীচে হাজির। লোক দুটোর ভাবভঙ্গী সন্দেহজনক। মনে হচ্ছে কাউকে খুঁজছে ওরা। মামদো টুপ করে লোক দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। না, ভূত হয়ে নয়, একটু আগে দেখা ওই পাঁচ ছোকরার মতো সেজেছে সে। ময়লা জীনসের প্যান্ট, কালো গোল গলা গেঞ্জী, গলায় রুমাল বাঁধা, হাতে একটা ছোরা। লোকদুটো প্রথমে একটু হতবম্ব হয়েছিল বটে কিন্তু দ্রুত সামলেও নিল। কারণ পরক্ষণেই বাজখাঁই গলায় দাবড়ে ওঠে, ‘এ্যাই তো এক মক্কেল, এখনো লোভ মেটেনি। হতচ্ছাড়া। আবার ছোরা নাচানো হচ্ছে। কজন ছিলি অপারেশনে ? কার গ্যাং-এর লোক তুই, আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্চে না।

একগাদা প্রশ্ন হুড়মুড় করে এসে পড়ায় থতমত খেয়ে যায় মামদো। তবু প্রাণপণে সাহসে ভর করে বলে, ‘খবরদার, এই যে ছোরা দেখেছো তো ?’

-রাখ্। ওরকম ছোরা আমরা ঢের দেখেছি। হারামজাদা, পুলিশকে ছোরা দেখাচ্ছিস। থানায় নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে দুরমুশ ধোলাই দিলে তোর তিড়িং-বিড়িং বেরিয়ে যাবে।

-সে কি, তোমরা পুলিশ! মামদো প্রায় তোতলাতে থাকে।

-নয়তো কি তোমার শ্বশুর ? ছোরা ফ্যাল্ শিগগীর। তোদের গ্যাং লিডার কে ? হরেন এক্ষুনি হ্যাণ্ডকাফ লাগা ব্যাটাকে। গ্যাং লিডারের নাম বল।

সঙ্গী পুলিশ, যার নাম হরেন, ঝনাৎ করে কোমর থেকে হ্যাণ্ডকাফ বের করে ফেলে। মামদোর হাত থেকে ছোরা খানা খসে পড়ল। কি মুস্কিলেই যে পড়া গেল। শেষটায় পুলিশের খপ্পরে! থানায় বেধড়ক ধোলাই ? মামদোর মাথা বাঁই করে ঘুরে ওঠে। কোনোমতে মিনমিন করে সে বলে, আমি কোনো গ্যাং-এর লোক নই। ওই গাঙের ধারে আমার বাড়ি বটে। বিশ্বাস করুন, আজই এই শহরে পেত্থম এসিছি।

-বাঃ তুই তো দেখছি তৈরি জিনিস রে। শহরে পা দিয়েই কাজ শুরু করে দিয়েছিস। ব্যাটা এটা জানিস না, আমাদের থানা এলাকায় আমাদের না জানিয়ে কেউ কাজ-কারবার করতে পারে না। বড়োবাবু জানতে পারলে এক্ষুনি তোকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলবে। তোর শিক্ষা হওয়া দরকার। চল থানায়।

ভয় দেখাতে এসে ভয় পেতে কার ভালো লাগে। অগত্যা জয় মা ভূতেশ্বরীবলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে। নেহাৎ ভূত বলেই এযাত্রা পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায় মামদো।

অতঃ কিম্ ? ভূত তো সে হয়েই আছে, তার ওপর আবার হেরে ভূত হয়ে ভূত সমাজে ফিরে গিয়ে কিভাবে মুখ দেখাবে। তাছাড়া ওই ফিজেল শাঁকচুন্নীর তাচ্ছিল্য বিদ্রুপ ঠিক হজম হবে না। নাঃ, হাল ছাড়লে চলবে না। একটা এসপার-ওসপার করে তবে ফিরবে। তবে প্রথম কাজ হল এই কিম্ভুত গুণ্ডা-পোষাকটা পাল্টানো। সভ্যভব্য কিছু একটা পোষাক ধাঁ করে গলিয়ে নেয় সে।

রাত বাড়ছে। অনেকক্ষণ শহরের এখানে-ওখানে মুখ শুকনো করে ঘোরার পর একটা বাড়ির দিকে মামদোর নজর পড়ল। বাড়িতে এক মহিলা জেগে আছেন এখনো। বাড়ির কর্তা, খুব সম্ভবতঃ ওই মহিলার স্বামী, বাড়ি ফেরেননি এখনো। রাত বেশ গভীর, চারদিক শুনশান। বাড়িতে একা এক মহিলা। আঃ, ভয় দেখানোর পক্ষে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট মুহূর্ত আর হয় না। চোর আর ভূতের একটা সুবিধা, কোথাও ঢুকতে হলে দরজা দিয়েই ঢুকতে হবে এমন বাধ্য-বাধকতা থাকে না। দরজা বন্ধ থাকা সত্বেও মামদো দিব্যি ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে গেল, বলতে গেলে নিঃশব্দে। ওপাশের শেষ করে আলো জ্বলছে। ওখানে ভদ্রমহিলাটি আছেন মনে হচ্ছে। পা টিপে-টিপে মামদো এগোতে থাকে, সন্তর্পণে। হঠাৎ সপাটে এক লাঠি পিঠে এসে পড়ল। অসম্ভব চমকে উঠে আঁককরে কঁকিয়ে ওঠে মামদো। সপাসপ্ লাঠির আঘাত পড়তেই থাকে।

-বাপরে, মেরে ফেলল রে। হেঁড়ে গলায় ডুকরে ওঠে মামদো।

এতক্ষণে লাঠি বৃষ্টি থামল। ভদ্রমহিলা কাঁচমাচু হয়ে বলে ওঠেন, একি কে তুমি ? ছিঃ-ছিঃ কি কাণ্ড! দেখি-দেখি কোথায় লেগেছে ?

ভদ্রমহিলার কথায় মামদোর ধড়ে প্রাণ এল, সেই সঙ্গে রাগও হল।

-এখন ছিঃ-ছিঃ করে আর কি লাভ। যা পিটুনি দিলেন, আমার হাড়গোড় সব চুরচুর হয়ে গেছে। লোক চোরকেও বোধহয় এমন অমানুষিক ধোলাই দেয় না।

-ঠিকই তো চোররাও তো মানুষ। তাদের নির্মমভাবে পেটানো কক্ষনো ঠিক নয়, বলতে-বলতে ভদ্রমহিলা ডেটল তুলো এসব বের করতে থাকেন।

-আপনি কিরকম মহিলা ? মুখে বলছেন মারধোর করা ঠিক নয় অথচ একটু আগেই পিটিয়ে আমার দফারফা করে দিলেন। কথায় আর কাজে এত ফারাক! অভিমানে গলা বুজে আসে মামদোর।

-আহা, তুমি বাপু ভুল বুঝেছো আমাকে। তোমাকে চোর ভাবতে যাব কোন দুঃখে। আসলে পেছন থেকে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। আমি ভেবেছিলুম আমার মিনসে মদ গিলে চুপিচুপি মাঝরাতে ঘরে ঢুকেছে। ওকে উচিৎ শিক্ষা দিতেই খিলটা চালিয়ে দিয়েছিলাম কয়েকবার। বিশ্বাস করো তোমাকে মারতে চাইনি। বুঝেছ ?

-বুঝিনি আবার, হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি। স্বামী যে চোরের থেকেও অধম এক প্রাণী তা বেশ মালুম হয়েছে। আচ্ছা আমি চলি।

একদমে তার বাঁশ বাগানের আস্তানায় পৌঁছে মামদো জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অনেক পরে সাড় ফিরে আসার পর মামদো দেখল তার হাড়ে-হাড়ে গোবরের মলম লেপে দিচ্ছে শাকচুন্নী। মামদোর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই শাঁকচুন্নী চটুল ভ্রু ভঙ্গী করে ওঠে। আর তা দেখে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে মামদো।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. Beyond the main bets, there are side bets that fluctuate from one on line casino to another. The Banker additionally takes one other card if the Banker’s hand is greater than 1xbet 5, and relies on what third card the Player attracts. Here the first digit is dropped and the second digit determines the hand value. For example, a 6 and an eight equals 14, 1 is dropped and the result's 4. A pure is an automated winner that occurs when the Player or Banker is dealt a complete of eight or 9 proper off the bat.

    উত্তরমুছুন