Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বৃষ্টির ধারাপাত ।। অপূর্ব দত্ত



আজ বুবলির স্কুল ছুটি। চারদিন ধরে একটানা বৃষ্টি পড়েই চলেছে। খুব যে জোরে পড়ছে তা নয়। গুঁড়িগুঁড়ি একঘেঁয়ে বৃষ্টি। বাড়ির থেকে বেরোতে পারছে না। গত দু'দিন শনি আর রোববার ছিল বলে এমনিতেই স্কুল বন্ধ ছিল। আজ রথ। আজকেও তাই ছুটি।

কিন্তু হলে কি হবে। বুবলির মনটা ভীষণ খারাপ। ওদের বাড়ির খুব কাছে চৌধুরী বাড়ির মাঠে বড়ো রথের মেলা হয়। সারা বছর রথটা রাখা থাকে চৌধুরী বাড়ির উঠোনের একটা ট্রিপল ঘেরা জায়গায়। একমাস আগে থেকে রথটাকে ঝেড়ে-পুছে রং করা হয়। তারপর ঢাক-ঢোল কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে স্নানযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকে জগন্নাথ মন্দির'' থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রথতলার মাঠে। সেখান থেকে মাসির বাড়ি''

বুবলির ভালো নাম ধারাপাত। তবে ধারাপাত নামটা বুবলির মোটেই পছন্দ নয়। ওর ক্লাসের মেয়েদের কত ভালো ভালো নাম- শ্যামলী, দেবস্মিতা, অর্চি, যোজনগন্ধা, ছাম্দসিকা- আরো কত। ধারাপাত নামটা একেবারে পচা। কাউকে বলতেই বুবলির লজ্জা করে। বাবাকে-মাকে কতবার বলেছে নামটা পাল্টে দিতে, বাবা-মা শোনেইনি। বলেছে স্কুলে একবার নাম দেওয়া হয়ে গেলে তা নাকি আর পাল্টানো যায় না। পচা-পচা-পচা। বাবা বুবলি বলে ডাকলেও মা বেশিরভাগ সময়ে বুবলাই বলে ডাকে।

এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। বাবার সঙ্গে কতরকম পরিকল্পনা করে- ছোটো কাঠের রথ কিনে তাতে নানান রঙের চিনকাগজ কেটে সাজানো হবে। মাটির জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা কিনতে হবে। ওর সব থেকে ভালো ভালো বন্ধুদের নেমন্তন্ন করতে হবে। বুবলির মা লুচি, আলুভাজা, নকুলদানা পিতলের থালায় করে সাজিয়ে দেবে। প্রতি বছর এই দিনটায় বুবলি ওর ছোটমামার দেওয়া নতুন জামা পরে। রথের দিনে তো আর বাবা-মার অফিস ছুটি থাকে না। অফিস তো আর স্কুল নয় যে রথের দিনেও ছুটি থাকবে।

সন্ধেবেলা বাবা বুবলিকে নিয়ে মেলায় যায়। ঝুমঝুমি আর রাঙা লাঠি কিনে দেয়। পাঁপড়ভাজা, ফুটকড়াই, চিনিরমঠ এসব কিনে দেয়। সব থেকে বেশি যেটার উপর বুবলির লোভ হয় সেটা হল গ্যাস বেলুন। অনেকগুলো গ্যাস বেলুন কিনে একসঙ্গে সুতোয় বেঁধে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। বেলুনগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর খুব কষ্টও হয়। বেলুনগুলো যেন হাঁসফাঁস করে ছুটে পালিয়ে যাবার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর একসময় হাত থেকে ছেড়ে দেয় এবং সেগুলো ঝিরঝিরে ভেজা হাওয়ায় ভাসতে-ভাসতে তালগাছ, নারকেলগাছের মাথা টপকে নদীর ধারে ঢাউস অশ্বত্থগাছটার পাতা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখের আড়ালে চলে যায় বুবলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোনো দিকে তার মন থাকে না তখন। বেলুনগুলো বাঁধা থাকলে ওর বড় কষ্ট হয়।

এবারও ভেবে রেখেছিল বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলে বাবার সঙ্গে রথের মেলায় যাবে। এও ভেবে রেখেছিল, সারাবছর ধরে ওর পয়সার ভাঁড়ে যা পয়সা জমবে সেগুলো দিয়ে মাকে একটা কবিতার বই কিনে দেবে। মা কবিতা লেখে বলে কবিতার বই খুব ভালোবাসে। নিজে তো আর দোকানে যেতে পারবে না। ছোটোমামা এলে ওকে দিয়ে কিনিয়ে রাখবে। রথের দিনেই তো মায়ের জন্মদিন। কি মজা!

সকাল নটার সময় বাবা মা অফিসে বেরিয়ে গেল। অন্যদিন বুবলি এই সময় স্কুলে থাকে। দশটার পরে ছুটি হলে ভ্যানকাকু স্কুল থেকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সুমিত্রাদি তখন থাকে। বুবলির যখন এক বছর বয়স তখন থেকে সুমিত্রাদি ওদের বাড়িতে থাকে। সকাল আটটায় আসে আর সন্ধেবেলা মা-বাবা অফিস থেকে ফিরলে তারপর বাড়ি যায়। ১০ বছর ধরে একইরকম চলছে। সুমিত্রাদিরা বুবলিদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে একটা চালা ঘরে থাকে। ওর একটা ছেলে আছে। চার বছর বয়স। নাম রুপাই। খুব শান্ত আর কি মিষ্টি দেখতে। মাঝেমাঝে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসে। বুবলি ওকে আদর করে, বিস্কুট দেয়। ওর পুরোনো খেলনাগুলো থেকে দুটো-একটা দিয়েও দেয়।

দোতালার বারান্দা থেকে মা-বাবাকে হাত নেড়ে টা-টা করল বুবলি। রোজ-রোজ এরকম সুযোগ আসে না। ভাগ্যিস আজ স্কুল ছুটি। মা-বাবাকে টা-টা করে বুবলি। পড়ার টেবিলে বসে পয়সার ভাঁড়টা ভাঙল। তারপর দু-টাকা, এক-টাকা, আট-আনা, চার-আনা এভাবে ভাগ করে রাখতে লাগল। তিনটে পাঁচ টাকার কয়েন আর দুটো দশ টাকার নোটও পেয়েছে। দশ টাকার নোট দুটো ছোটোমামা একদিন ভাঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বুবলি জানত। সব পয়সা আর নোট গোনা হয়ে গেলে দেখল সাড়ে ৫৩ টাকা হয়েছে। তাও গুনতে-গুনতে কতবার ভুল হয়ে যাচ্ছিল। খাতা-পেন্সিল নিয়ে লিখে -লিখে হিসেব করতে হয়েছে। ছোটোমামা আজ এলে দিয়ে দেবে বই কেনার জন্য। ছোটোমামাকে বলে রেখেছে দুপুরবেলা আসতে। যাতে মা অফিস থেকে ফেরার আগেই বইটা কিনে এনে রাখে। ছোটোমামা অবশ্য এমনিতেই রথের দিন দুপুরবেলাতেই আসে একটা নতুন জামা নিয়ে, তা সে যত কাজই থাকুক। তারপর ওর রথটাকে রঙিন চিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে একটা দড়ি বেঁধে দেয়।

-বুবলি চানে যাও। বেলা হয়ে যাচ্ছে। চান করে ভাত খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবে।

সুমিত্রাদির গলা পেয়ে বুবলি টাকা-পয়সাগুলো ওর পুতুলের বাক্সে রেখে চান করতে গেল। ও এখন নিজে-নিজেই চান করতে পারে। ভাত খেতে পারে। বিছানা করতে পারে। ওর খেলনাবাটি গুছিয়ে রাখতে পারে। মা বলে, যাদের বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে তাদের নিজের কাজ নিজে করা শিখে নিতে হয়। তাতে বড়ো হয়ে আর কোনো কষ্ট হয় না। অন্যের ওপরে নির্ভর করতে হয় না। একে বলে স্বাবলম্বী হওয়া। স্বাবলম্বী কথাটার মানে বুবলি আগে জানত না, এখন জানে।

আজ আর শুতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে নীল। কোথাও এতটুকু মেঘ নেই। মনে হচ্ছে এইমাত্র কেউ যেন সাবান দিয়ে কেঁচে দিয়েছে। বুবলি বারান্দার চেয়ারটায় এসে বসল। ওর খুব ভালো লাগে বারান্দায় বসতে। এখান থেকে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। সামনের তালগাছগুলো দেখে ওর রবি ঠাকুরের সেই কবিতাটার কথা মনে পড়ে যায়-

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে

সব গাছ ছাড়িয়ে

উঁকি মারে আকাশে...।''

বুবলি একটু যেন অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। রথের দিন এলে ওর একটা কবিতার কথা মনে পড়ে। মা খুব আবৃত্তি করে কবিতাটা- বসেছে আজ রথ তলাতে স্নান যাত্রার মেলা...।'' কিন্তু কবিতার শেষ লাইনটা ওর একদম ভাল্লাগে না। পড়লে বড়ো কষ্ট হয়। যতবার পড়েছে ততোবারই চোখে জল এসে গেছে। ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুবলির খুব আনন্দ হল। আজকে আর কবিতাটার শেষ লাইনটা মানে- অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ধারায় ভেসে যায় রে দেশ'' মনে পড়লে কষ্ট হবে না। কারণ আজ তো আর লাইনটা সত্যি হবে না।

উঠে গিয়ে পড়ার টেবিল থেকে আঁকার খাতাটা নিয়ে বারান্দায় মেঝেতে বসে প্যাস্টেল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করল। প্রথমে একটা রথ আঁকল। তারপর অনেক লোকের ভিড়। তারপর দোকান-পাঁপড়ভাজা, পপকর্ণ, ভেলপুরির দোকান আরো কত্ত। একটা গ্যাস বেলুনওয়ালাও আঁকল। নানারঙের বেলুন আঁকল।

হঠাৎ বুবলির কানে এল- বেলুন নেবে দিদি ? একটাকায় একটা। আমার মা-র খুব অসুখ। চার দিন ধরে জ্বর। ওষুধ কিনতে পারিনি। আমার তো আর বাবা নেই। দাদাও নেই। জ্বর হয়েছে বলে মাও বাসন মাজার কাজে যেতে পারছে না। নাওনা দিদি। তোমাদের তো কত পয়সা। দশটা বেলুন আছে। তোমাকে ১০টাকা দিতে হবে না। তুমি তো আমারই মতো ছোটো। তোমার কাছে যা আছে দাও। এই টাকা দিয়ে ওষুধ কাকুর দোকান থেকে পাঁচ টাকার বড়ি কিনব আর বাকি টাকার মুড়ি-বাতাসা কিনে নিয়ে যাব আমার আর মা-র জন্য। সকাল থেকে আমরা কিছুই খাইনি। এক গ্লাস জল দেবে বুবলিদি!

বুবলি দোতালার বারান্দা থেকে দেখল একটা মেয়ে করুণ চোখে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বুবলি মেয়েটাকে চেনে। এই পাড়াতে আগে দেখেছে। ওর নামও জানে- রাধারানী। পয়সার বাক্সটা হাতে নিয়ে বুবলি চুপিচুপি একতলায় নেমে এল। সুমিত্রাদি রান্নাঘরে কাজ করছে। বেশিনে জলের শব্দ। কিছুই টের পেল না। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল- রাধারানী, তুমি এই বাক্সটা নাও। এতে সাড়ে ৫৩ টাকা আর কয়েকটা পুতুল আছে। তুমি ওষুধ আর মুড়ি-বাতাসা কিনে বাড়ি যাও। ভয় নেই এটা আমার ভাঁড়ে জমানো পয়সা। আর এই ফ্রকটা নাও। তোমার শাড়িটা তো পুরো ভিজে গেছে। ভেজা শাড়ি পরে থাকলে তোমার মা-র মতো তোমারও জ্বর আসবে। বেলুনগুলো আমার লাগবে না, তুমি নিয়ে যাও। বেলুন দেখলে আমার বড়ো কষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি নাও, সুমিত্রাদি এসে পড়বে।

বুবলি দোতালায় এসে বারান্দার মেঝেতে আঁকার খাতার পাশে শুয়ে পড়ল। কখন যে চোখের পাতায় ঘুম নেমে এল জানতেও পারল না।

আচমকা উপুর-ঝুপুর বৃষ্টি নামল। বারান্দায় এসে দেখল উঠোনে জল থৈ-থৈ করছে। জানালার কার্নিশে দুটো কাক ভিজে গোবর হয়ে কা-কা করে ডেকে যাচ্ছে। আকাশের কোথাও একছিটে নীলের নামগন্ধ নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই বুবলি দেখল বারান্দায় পড়ে থাকা আঁকার খাতাটা ভিজে ন্যাতা হয়ে পড়েছে। ওর মনে পড়ল বাংলা বইয়ের গল্পটার কথা- রাধারানী নামে এক বালিকা মাহেশের রথ দেখতে গিয়েছিল। বালিকার বয়স একাদশ পরিপূর্ণ হয় নাই।... কিন্তু তাহার পিতা নাই।... আর আহারের সংস্থান রহিল না।... দুর্ভাগ্যক্রমে রথের পূর্বে বালিকার মা ঘোরতর পীড়িত হইল।...

বুবলি চোখ খুলে দেখল বিছানার সামনে মা দাঁড়িয়ে। চুল ভেজা। দু-একটা ভেজা চুল কপাল বেয়ে চোখের পাতার উপরে লেপ্টে আছে। মা ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। হাসলে মাকে সুন্দর দেখায়। মা বলল- বুবলাই, তুমি আবার আজকে ভিজেছ ? ফের জ্বর আসবে। ছবি আঁকতে-আঁকতে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে। ভাগ্যিস জোরে বৃষ্টি আসার আগেই সুমিত্রা তুলে এনে মাথা মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। আঁকার খাতা আর প্যাস্টেল কালার তো গলে জল হয়ে গেছে।

বুবলি একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাধারাণীর কথা মনে পড়ছে বারবার। আজ সকালেও বাংলা পড়ার সময় পড়েছে- ...অন্ধকার... পথ কর্দমময়, পিচ্ছিল... রাধারানী কাঁদিতে-কাঁদিতে আছাড় খাইতেছিল...। বুবলির এতক্ষণে মনে পড়ল বইয়ের রাধারানীর হাতে তো বেলুন ছিল না। ওগুলো তো বনফুলের মালা।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। ছোটোমামা ঘরে ঢুকল। হাতে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। তার ভেতর থেকে একটা বই বের করে ছোটোমামা বলল- এই নে তোর জন্য নিয়ে এলাম। আজই বেরিয়েছে।

বুবলি হাতে নিয়ে দেখল অসম্ভব সুন্দর একটা বই, চৌকোনো। হলুদ রঙের মলাট, লাল কালিতে ছাপা- বৃষ্টির ধারাপাত-শ্রেয়স্রী দত্ত।'' অনেকক্ষণ ধরে উল্টে-পাল্টে দেখে মায়ের কাছে ঘন হয়ে বলল- জানো মা, এই বইটার লেখকের নাম আর তোমার নাম এক। ছোটোমামা দুষ্টুমি করে কিনেছে মজা করার জন্য। এই বইটা মা, তোমাকে জন্মদিনে আমি প্রেজেন্ট করব। দাঁড়াও আমি তোমার নাম লিখে দিচ্ছি।

ছোটোমামা প্রথম পাতাটা খুলে বলল- এই পাতাটা পড়ে দেখ।

বুবলি অবাক হয়ে পড়ল- অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ধারায় ভেসে যায় রে দেশ- স্নেহের বুবলাইকে- আশীর্বাদক মা।''

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ