Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কেন আবৃত্তি করব ।। অলক রায় ঘটক

আমেরিকার ডেট্রয়েট শহরে চলছে বঙ্গ সম্মিলনউৎসব। স্থানীয় একটি ছোট্ট মেয়েকে শিখিয়ে-পড়িয়ে মঞ্চে তোলা হয়েছে, সুকুমার রায়ের কবিতা আবৃত্তির জন্য। মেয়েটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল- শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে তোমার নাকি মায়ের বিয়ে...।উপস্থিত দর্শকরা খুবই উপভোগ করল এই মেয়ের বদলে মায়ের বিয়ের বিষয়টা। কিন্তু মা তার কি অবস্থা ভাষা না জেনে শুধু ধ্বনি শুনে মুখস্থ করলে বিয়ের পাত্রী বদলে যাওয়ার মত বিপদ তো হতেই পারে। তাই বাড়িতে- বাংলা এবং স্কুলে- ইংরেজি বলা বাচ্চারা যদি ছড়া-কবিতা বলা অভ্যাস করে তাহলে অন্তত বাংলা ভাষাটা বাঁচে। অবশ্য বা কতটুকু যখন কোন বাবা সগর্বে বলেন- আমার ছেলের আবার বাংলাটা ঠিক আসে না।

এমন ভুল-ভাল বাংলা বলার FM যুগে ঠিকঠাক বাংলা বলতে চেষ্টা করতে হলে একটু আরো একটু আবৃত্তি চর্চা করা যেতেই পারে। এবং সেটা ছোটবেলা থেকেই। সাহিত্য পড়া তো উঠে গেছে। আর দরকারই বা কী, “সাহিত্যের সেরা সময়সিরিয়ালটি দেখে নিলেই তো সব জানা হয়ে যাবে। তো আবার কবিতা পড়া।

হ্যাঁ, তবু কবিতাই শিখছে। তার সহজ এবং প্রধান কারণ, বেশি সময় দিতে হয় না। তিন থেকে চার মিনিটেই একটা মোটামুটি মাপের কবিতা একবার পড়ে ফেলা যায়। সিরিয়াল দেখার সময়ে টান পড়ে না।

আরো একটা গভীর কারণও রয়েছে এই আবৃত্তি শিক্ষার পেছনে। সেই যুক্তি প্রতিষ্ঠা পাবে নিচের উক্তিতে-

জনৈকা মা- মেয়েকে নাচে-গানে সবেতেই তো দেখলাম, কিছুই পারে না তাই ভাবছি এবার আবৃত্তিটা শেখাব। (অর্থাৎ যে কিছুই পারে না, সে আবৃত্তিটা অন্তত পারবে)।

আচ্ছা, এভাবে না ভেবে বরং একটু অন্যভাবে তো ভাবা যায় যে, কেন আর কি করব ?

 ১) আবৃত্তি করতে করতে বাংলা ভাষার সঙ্গে একটা নৈকট্য তৈরি হবে।

 ২) কবিতার শরীর থেকে অনেক অচেনা বাংলা শব্দ এবং তার অর্থ প্রয়োগ শেখা যাবে। অর্থাৎ শব্দ ভান্ডার (Stock of word) বাড়বে।

 ৩) কবিতার  ছন্দময়তা কান ও মনকে রুচিশীল করবে জীবনের ছন্দময় রূপকে চিনতে সাহায্য করবে।

 ৪) জীবনে গভীরভাবে ভাববার যে অভ্যেস আমাদের চলে তাও হয়তো একটু ফিরবে।

 ৫) আবৃত্তির কাছাকাছি যেসব শিল্প রয়েছে- অর্থাৎ অভিনয়, সংযোজনা, সংবাদ পাঠ- এসব নিয়ে তো ভবিষ্যতে জীবিকা উপজীবিকা তৈরি হতে পারে।

যদিও এগুলো সবই চর্চার সুদুর প্রসারী ফলাফল। দ্রুত লব্ধ ফলাফলও কিছু তো জুটে যেতে পারে। যেমন ধরা যাক, যে শিশুর জিভের আড়ষ্ঠতা রয়েছে- '' বর্গের (কখগঘ)আর '' বর্গের(তথদধ)উচ্চারণ পৃথক হয় না। (উদাহরণ- ঝর্ণা মাসি বলবে হাসি খুকি এলি নাকি  বলব আমি নইকো খুকি, ঘুম জাগানো পাখি''- অপভ্রংশে, “ঝর্ণা মাসি বলবে হাসি থুতি এলি নাতি  বলব আমি নই তো থুতি, ধুম জাদানো পাথি।'')-সেটাও শুধরে যাবে।

'' ''  তো বাংলা উচ্চারণে প্রায় Identical tain, তফাৎ করার কথা ভাবাই যায় না। যতই না-না-না'' কর না কেন  বলবার সময় তা- ণা-ণা-ণা'' হয়ে পড়ে। বিশেষ তফাৎ করতে না পারার অক্ষমতা ধার্য হয় না।

অঞ্চলভিত্তিক অক্ষতও রয়েছে। পূর্ব বাংলার আবহাওয়া দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে '' এবং ড়''-এর ক্ষেত্রে সমস্যা প্রবল। এপার বাংলায় যদি প্রশ্ন হয়- কিরে, শাড়ি-কাপড়ের ব্যবসা করছিস  নাকি।'' -তা ওপার বাংলায় অনূদিত হয়- কিড়ে শারি-কাপরের ব্যবসা করছিস নাকি।''

''-এ এসে বেসামাল।  '' এবং ''-এর পরে একটা জেলাভিত্তিক অধিকারবোধ তৈরি হয়ে গেছে।  যাদের উচ্চারণে সব ''-ই ইংরেজি S-এর মত।   ভাগ্যের পরিহাসে অথবা পিতৃ-পুরুষের  প্রগাঢ় তাদের নাম  পদবীতেই বিপর্যয়ের শুরু।   তেমন- সমীর দাস, অসীম সামন্ত বা শিখা সরদার।   আবার সব ''-ই যাদের উচ্চারণে '' বা  ইংরেজির Sh-এর মত  তারা দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন বাশে''র(Bus)অপেক্ষায়।  তা থাকুন।  আপত্তি নেই।  সমস্যা হয় সংগীতের শিক্ষাকালে, স্বর সাধনায়।   তাদের শা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-শা শুনলে কানে অমানিশা নেমে আসে।

চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারেও তেমনি অসঙ্গতি। পদ্মার বাতাস বইলেই দেখছি চন্দ্রবিন্দু বিলকুল লোপাট।  যেমন -  চাদফাকিবাশউচু... ইত্যাদি। তেমনি গঙ্গার হাওয়া বইলে চন্দ্রবিন্দুর  ভয়ানক আধিক্য- ঘাঁস, ঘোঁড়া, হাঁসি, হাঁসপাতাল ইত্যাদি।

আসলে যদ্দুর মনে হয় ওপার বাংলা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা যখন প্রাণ টুকু সম্বল করে এদেশে ছুটে এসেছিল, তখন অনেক কিছুর সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু টাও পথে ফেলে রেখে  এসেছিল।  এদিকে এপারের লোকেরা এত মানুষকে ছুটে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি সব চন্দ্রবিন্দু এনে ঘরে তোলে।  অধিক সঞ্চয় এর ফলেই উদ্বৃত্তের অমিত অপচয় পারে।

এইসব ছোটখাটো বিপর্যয় কে সামলে নিতে পারার জন্য ছোটবেলা থেকে আবৃত্তি শেখা যেতেই পারে।  উপকার বৈ অপকার হইবে না''

 

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৬


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ