Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বিনে পয়সার বড়া ।। অরুণিমা রায়চৌধুরী


তাইওয়ানের এক গ্রামে আছে এক পাহাড়। সে পাহাড়ের নাম বান-পিন-শান'',- যার মানে আধ-মুখো-পাহাড়''। এমন অদ্ভুত নাম কেন ? পাহাড়টার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। পাহাড়টার আধাখানা যে নেই। কী করে এমন হল ? শোনো তবে।

অনেককাল আগে পাহাড়টা অন্য সব পাহাড়ের মতোই ছিল, মানে আধখানা নয়, -একদম পুরো একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের কাছেই একটা গ্রাম।একদিন এক বুড়ো বিরাট এক পাত্র মাথায় করে নিয়ে সেখানে হাজির হল। গ্রামের মাঝখানে খোলা মাঠটির এককোণে বসে সে তার মাথা থেকে পাত্রটি নামিয়ে রাখল। তারপর পাত্রের ঢাকনা খুলে চিৎকার করে ডাকতে লাগল সবাইকে- বড়া চাই ? একদম টাটকা, তাজা, গরম ভাজা বড়া।

এক পয়সায় একটা, দু পয়সায় দুটো আর তিনটে বড়া নিলে কোনো পয়সাই লাগবে না। তার ডাক শুনে গায়ের লোকরা সব ছুটে আসতে লাগল। ততক্ষণে টাটকা বড়া ভাজার সুগন্ধে বাতাস ভরে গিয়েছে।

প্রথমে সবাই ভেবেছিল, লোকটা বোধহয় পাগল। নইলে এক পয়সায় একটা বড়া, দু পয়সায় দুটো বড়া আর বিনিপয়সায় তিনটে বড়া! কিন্ত বড়াগুলোর এমন চমৎকার গন্ধ, যে সবার জিভে জল এসে গেল। সবার আগে চিকি চ্যান এগিয়ে গেল, - ও বুড়ো তোমার সবচেয়ে ভালো বড়া তিনখানা দাও দেখি। বুড়ো সঙ্গে সঙ্গে তার সবচেয়ে বড়ো আর নরম বড়াটি বার করে দিল। চিকি চ্যান সঙ্গে সঙ্গে বড়াটা মুখে পুরে দিল। বাঃ! এরকম বড়া সে কোনোদিন খায়নি।

একটাতেই তার পেট ভরে গেল। কিন্তু তিনটে না খেলে যে পয়সা দিতে হবে। -তিনটে খেলে তো পয়সা দিতে হবে না, তাই না ? বুড়ো বলল, -না না কিছুই দিতে হবে না। এই নাও আরো দুটো। চিকি চ্যান সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুটো বড়াও খেয়ে ফেলল। বিকেলের মধ্যেই গাঁয়ের প্রায় সব লোকই তিনটে করে বড়া খেয়ে ফেলল। ব্যাস। সন্ধের মধ্যেই বুড়োর বড়ার হাড়ি একদম খালি। বুড়ো বেশ হাসিমুখেই তার খালি হাঁড়িখানা মাথায় তুলে ফিরে গেল।

হঠাৎ সেই গাঁয়েরই একটি ছেলে, লেজিলি, তার শেষ বড়াটি খেতে খেতে বলল, -আরে! আমাদের পাহাড়টা এরকম হয়ে গেল কী করে ? সবাই সেদিকে ফিরে তাকাল। পাহাড়টার খানিকটা অংশ যেন কেমন খাবলানো মতো। সবাই দেখল, কিন্তু বিশেষ পাত্তা দিল না। -দুর! ও কিছু না।

পরদিন সকাল থেকেই সবাই গিয়ে জমা হল সেই মাঠে। -কী জানি সেই বড়াওয়ালা বুড়ো আজ আবার আসবে তো ? দেখা যাক। কিছুক্ষণ তো অপেক্ষা করি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পরেই হাড়ি ভর্তি বড়াভাজা নিয়ে বুড়ো এসে হাজির। ঠিক আগের দিনের মতোই সে হেঁকে বলল, -এক পয়সায় একটা বড়া, দু পয়সায় দুটো আর তিনটে নিলে পয়সাই লাগবে না। সবাই ভিড় করে এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগল, -আমাকে তিনটে, আমার তিনটে চাই। এমনি করেই কাটল পরের দিনও।

চতুর্থ দিনেও বড়ার হাঁড়ি নিয়ে বুড়ো আসতেই গাঁয়ের লোকরা বিনিপয়সার বড়া নেওয়ার জন্য ভিড় করে এল। হঠাৎ ভারি ভদ্র গলায় কে যেন বলল, -মশাই, এই যে আমার এক পয়সা। আমাকে একটা বড়া দেবেন ? সবাই তো শুনে অবাক! আচ্ছা বোকা তো ? তিনটে বড়া তো এমনিই পাওয়া যায়। এ আবার পয়সা দিয়ে মাত্র একটা বড়া কিনছে কেন ? কে এ ?

সবাই তাকিয়ে দেখল,  -নেহাৎ অল্প বয়সি একটি ছেলে। মুখখানা মায়া মাখানো। বড়াওয়ালা বুড়োও বলল, -তুমি ঠিক শুনেছ তো ? আমি যে বললাম, -তিনটে বড়া তুমি বিনেপয়সাতেই পাবে।

-আমি ঠিকই শুনেছি। ছেলেটি বলল, -আমি তো কদিন হলই দেখছি এই বিশাল হাঁড়িটা আপনি রোজ মাথায় করে নিয়ে আসেন, আর বিনেপয়সায় বড়াগুলো বিলেয়ে দেন। আমার তো মনে হয় এই কদিনে আপনি একটা পয়সাও পাননি। আমার সত্যি ভারি খারাপ লাগত দেখে। তাই আজ আমি আপনাকে কিছুতেই খালি হাতে ফিরতে দেব না।

ছেলেটির কথা শুনে গাঁয়ের অন্য মানুষরা লজ্জায় মাথা নীচু করে রইল। তারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখল বুড়ো মানুষটি এগিয়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, -আমি এই পর্বতের দেবতা। বহু দূর দূর দেশ ঘুরে আমি আমার একজন উপযুক্ত শিষ্য খুঁজছিলাম। অবশেষে এতদিন পরে তোমাকে পেলাম। তারপর গাঁয়ের লোকদের দিকে তাকিয়ে সেই পর্বতের দেবতা বললেন, -এই কদিন ধরে তোমরা কী খেয়েছ জানো ? ওই পাহাড় খুঁড়ে নেওয়া কাদা আর মাটির গোল্লা।

সবাই অবাক হয়ে পাহাড়টার দিকে তাকাল। সত্যি তো! কী কাণ্ড! সেই প্রথমদিন লেজি লি যেমন বলেছিল, -আধখানা পাহাড় একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছে। পাহাড়ের দেবতা তাঁর শিষ্যকে নিয়ে সেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। গ্রামের সব মানুষ তখন এসে জড়ো হল সেই মাঠে। সবাই মিলে শপথ নিল। নাঃ, আমাদের নিজেদের শোধরাতে হবে। আর আমরা লোভ করব না। আর এই শপথের কথা যাতে কেউ ভুলে না যায়, সে জন্য সেই পাহাড়ের নাম রাখা হল- বান-পিন-শান, -আধমুখো পাহাড়। সেই পাহাড়ের এই নাম আজও আছে।

 

তাইওয়ানের লোককথা

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া১৪১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ