ভ্যানচালক বলল, ‘যদি পথে আরো দু’চারজন প্যাসেঞ্জার পেয়ে যাই, তবে যা ভাড়া তাই দেবেন। নইলে কিন্তু বাবু পনেরোটা টাকা দিতে হবে নিউদীঘা মোড়!’
দ্বিধা না করে উঠে বসলাম। প্রায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে আছি দীঘা রিক্সা-স্ট্যাণ্ডে। ভ্যান-রিক্সাও প্রচুর। কিন্তু আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় যাত্রী কেউ নেই এই কুড়ি মিনিটে। তাই কেউ যেতে রাজি নয়। মধ্য জুলাইয়ের বর্ষণ-মুখর রাত। ঘড়িতে সাড়ে ন’টা। বিকেল থেকে হঠাৎ নেমেছে বৃষ্টি। দু’এক পশলা মাঝারি ধারাপাতের পর এখনো ঝরে চলেছে টিপটিপ। সঙ্গে সমুদ্রতীরের হু-হু করা তীব্র বাতাস।
খুব একটা ভীড় নেই এখন দীঘায়। নিউ দীঘাতে তো আরো নয় ! তীব্র দাবদাহে জ্বলছে দক্ষিণবঙ্গ। জুন পেরিয়ে জুলাই। জুলাই-ও শেষের পথে। বর্ষার দেখা নেই। এই কারণে পর্যটকও কম। আমি এসেছি এক বন্ধু-কন্যার বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। নিউদীঘার চাঁপাবনী গ্রামে সেই বন্ধুর বাড়ি। উঠেছি অমরাবতী লেকের কাছে সেই গ্রামে যাওয়ার পথের পাশেই এক গেস্ট হাউসে। বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে গতকালই। বর-কনে রওনা হয়ে গেছে বেলা থাকতে। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। মন ভালো নেই কারো। এই অবসরে আমি বেরিয়ে পড়েছি নিজের মতো করে।
এই অঞ্চলে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব। দীর্ঘ দিনের যাতায়াতের সূত্রে ও চাকরী সূত্রে পরিচিত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা নিয়ে বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে আসি গেস্ট হাউসে। বন্ধুকে জানিয়ে রাখি- আজ তার গৃহে রাতে আর আসছি না। দেখা হবে আগামীকাল।
গেস্ট হাউস থেকে তৈরি হয়ে বেরোবার আগেই নেমেছিল কাঙ্খিত বৃষ্টি। ছাতা সঙ্গে নিতে তাই ভুল করিনি।
নিউ দীঘা মোড় থেকে ভ্যান-রিক্সায় প্রথমে যাই কিয়াগড়িয়ার দিকে, দীঘা চেকপোস্টে, কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিসার প্রবীর আচার্যর কাছে। প্রবীর গায়ক। তখন বৃষ্টি ধারা অঝর। জমে যায় গানের আসর। তন্ময় হয়ে শুনি তার গান। শুনতে-শুনতে ঘন্টা দেড়েক যে কিভাবে কেটে যায় বুঝতেই পারি না। পরের দিন আবার আসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন উঠছি, তখন ঘড়িতে আটটা। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ। কিন্তু উথাল বাতাস। রাস্তা ফাঁকা। ভ্যানের দেখা নেই। দীঘা যাব শুনে প্রবীর জানায়- ‘এখুনি হলদিয়ামুখী একটি বাস যাবে দীঘা হয়ে। আসবে উড়িষ্যার বর্ডার ছেড়ে।’
মিনিট দু’য়েকের মধ্যে বাসটি পেয়ে দশ মিনিটে পৌঁছে যাই দীঘায়। নেহরু মার্কেটের গেটে রামবাবুর ম্যাগাজিনের দোকানে বসে গল্প করতে-করতেই বেজে যায় ন’টা। লক্ষ্য করি ফাঁকা-ফাঁকা চারিদিক। এই আবহাওয়ায় দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ঝটপট। অগত্যা উঠে পড়ি। দিবাকর রেস্টুরেন্ট থেকে দু’টি চিকেন চাপ আর আটটা রুমালি রুটি প্যাক করে নিই চটপট। দিবাকরের টোনিবাবুর সঙ্গে আড্ডায় মাতলাম না আর আজ। মনে পড়ে গেল গেস্ট হাউস কেয়ার টেকার ঝা-বাবুর ছোট্ট ছেলে সনাতনের কথা। বিয়েবাড়ির চিকেনহীন আয়োজন মোটেই ভালো লাগেনি তার। বলে এসেছিলাম আজ রাতে তাকে চিকেন খাওয়াবো। ছোট্ট ছেলে, ঘুমিয়ে পড়ার আগেই ফিরতে হবে, মাথায় রয়েছে তা-ও।
বাজারের বিপরীতে স্টেটবাস স্ট্যান্ডে দু’চার মিনিট সময় কাটালো ভ্যানচালক। নিস্ফল প্রয়াস। যাত্রী মিলল না মোটেই। এবার আমি তাড়া দিলাম, ‘তোমার চিন্তা নেই ভাই, পনেরো টাকাই তোমাকে দেব আমি! এবার রওনা দাও।’
বলতে না বলতেই মুষলধারায় বৃষ্টি এল আবার।
বেশ কয়েকবছর ধরেই এই অঞ্চলের ভ্যানরিক্সায় গঠনগত পরিবর্তন হয়েছে। আগে বসতে হতো পাটাতনের উপর। এখন দু’দিকে লম্বালম্বি বেঞ্চ। পেছন দিক ছাড়া তিনদিক এবং উপরদিকে কাঠ দিয়ে খাঁচার মতো। ঠিক মফস্বলের ছোটোদের স্কুল-রিক্সা ভ্যানের মতো। বর্ষা সমাসন্ন বলে সমস্তটাই পলিথিন চাদরে আচ্ছাদিত। একমাত্র পেছন দিকটা খোলা। রিক্সাচালক ভ্যান থামিয়ে পলিথিন চাদরগুলো ঠিকঠাক করে বেঁধে দিল। আমি ছাতাটি দিতে চাইলে সে আপত্তি জানাল, ‘এক হাতে ছাতা ধরে অন্য হাতে ভ্যান চালানো যাবে না বাবু! তার ওপর প্রচণ্ড বাতাস। ছাতাও উল্টে যাবে।’
আমি ইতস্ত করলাম, ‘এই বৃষ্টিতে ভিজে যাবে ?’
‘ও কিছু হবে না। এটাই শেষ টিপ। আপনাকে পৌঁছেই বাড়ি চলে যাবো।’ বলেই সে পেছন দিকে এসে দাঁড়াল। -‘কিছু মনে করবেন না বাবু, এই বিড়ির বাণ্ডিল আর দেশলাইটা রাখছি ভেতরে। নইলে ভিজে যাবে।’
‘নিশ্চয়! নিশ্চয়!’
সে হাত বাড়িয়ে সেগুলো রাখলো উলটো দিকের বেঞ্চের উপর। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আপনি নিউ দীঘা মোড়ে নেমে, যাবেন কোথায় ?’
জানালাম, ‘অমরাবতী পার্কের মূল ফটক পার হয়ে পার্ক শেষ হতেই যে চৌমাথা, সেখানেই।’ আমার গেস্ট-হাউসের নামও জানালাম।
‘ও, তবে আপনাকে গেস্ট-হাউসের গেটেই নামিয়ে দিচ্ছি বাবু। ও পথেই যেতে হবে আমাকে, দক্ষিণ শিমূলিয়া গ্রাম।’
‘তবে তো খুবই ভালো হয়!’
থানার কাছাকাছি আসতেই ঝপ্ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারিদিক।
‘ব্যাস, হয়ে গেল!’ বলল ভ্যানচালক, ‘এখানে এটাই বিপদ। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলেই কারেন্ট গায়েব। এমনটা থাকবে সারারাত। এবার কখন কারেন্ট আসে দেখুন!’
বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ে আরো। পলিথিন চাদরের ওপর বৃষ্টির ফোঁটার তীব্র শব্দে চালকের কথা শোনা যায় না আর।
ঘন অন্ধকারে ঢাকা চারিদিক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উড়িষ্যাগামী এই দীঘা রোড। মাঝে-মধ্যে দ্রুত বেগে ছুটে চলা দূরপাল্লার বাস বা ট্রাকের হেডলাইটের তীব্র আলোয় বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টির ও বাতাসের তীব্রতা। তারপর আবার অন্ধকার।
নিউ দীঘার দিকে যতই এগোচ্ছে গাড়ি, ততই ধীর হচ্ছে তার গতি। এদিকটা একটু ফাঁকা। বাতাসের প্রাবল্যও তাই বেশি। চালককে অতিক্রম করতে হচ্ছে এই প্রতিকূলতা!
বাতাসের ধাক্কায় পেছন দিকে দিয়ে ভেতরে ঢুকছে জলরেণু। ভিজছে আমার খাবারের ঠোঙা। ভিজছি আমিও।
ঠিক এই সময় আমার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। -‘বাবা, তুমি কোথায় ?’ আমার মেয়ের কণ্ঠস্বর।
‘দীঘা থেকে গেস্ট-হাউসের দিকে, ভ্যানরিক্সায়! জানিস এখানে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘এখানেও! সন্ধে থেকে।’
‘তার ওপর এক্ষুনি চলে গেল কারেন্ট।’
‘এখানেও, এইমাত্র।’
হেসে উঠলাম। -‘তারপর বল, কি ব্যাপার ?’
‘বাবা, টি.ভি-র খবরে বলল, কালকেই বেরোচ্ছে রেজাল্ট।’
আমার মেয়ে এবারের উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। রেজাল্ট বেরোবার টেনশনে তাকে বিয়েবাড়ি আনা যায়নি কিছুতেই। অগত্যা থেকে যেতে হয়েছে তার মা-কেও।
অভয় দিলাম, ‘ভালো তো! ইন্টারনেটে রিলিজ হচ্ছে কখন ?’
‘সকাল দশটায়।’
‘এক কাজ কর! বারোটার মধ্যে বেরিয়ে হাওড়া থেকে বাসে চেপে পড়। এখানে পৌঁছে যাবি পাঁচটার ভেতর। তারপর হইহই করে ওদের সঙ্গে বৌভাতবাড়ি!’
‘ও, তুমি এখনও তামাশা করছ ?’
‘কোথায় তামাশা করছি ?’
‘জানো, কি প্রচণ্ড টেনশন করছি ?’
‘মিথ্যে টেনশন। তুই পাশ করবি-ই!’
‘বলছ ?’
‘নিশ্চয়! আর যদি না করিস ? কী হবে ? পরের বছর সুযোগ আসবে না ?’
‘আবার ভয় দেখাচ্ছ ? দ্যুৎ!’
‘মোটেই ভয় দেখাচ্ছি না। সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে বলছি।’
‘এখন ছাড়ছি। কাল আবার ফোন করব। সকাল দশটার পর।’
‘হ্যাভ এ গুড ড্রিম।’
ফোন ছাড়তেই অনুভব করলাম ভ্যানটা চলছে না, দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। খেয়াল করিনি থেমেছে কখন! মনে হচ্ছে রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে গেছি। দূরে সমুদ্রের দিকে দু’চারটি লজে বোধহয় জেনারেটর চালানো হয়েছে। ক্ষীণ ও সরু আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। মোমবাতি বা হ্যারিকেনের আলো চোখে পড়ল পথ-পাশের দু’একটা দোকান থেকেও।
চালক আর আমার মাঝে তো পলিথিন চাদরের দেওয়াল। তাকে দেখার উপায় নেই। একটু উশখুশ করছি। এমন সময় আবার চলতে শুরু করল ভ্যান। এবার যেন একটু দ্রুতগতিতে। অথচ বাতাসের প্রতিকূল গতি এখানে আরো বেশি! আর বৃষ্টি তো আকাশভাঙা!
আরো কিছুটা সোজা চলার পর এবারে ডান দিকে বাঁক নিচ্ছে গাড়ি। আন্দাজে বুঝেছি নিউ দীঘা মোড় থেকে ঢুকছি অমরাবতী পার্কের মূল দরজা ঘেঁষা পথে। পরিচিত রাস্তা, অথচ ঘন অন্ধকারে চেনার উপায় নেই। বন্ধ হয়ে গেছে দু’পাশের ছোটো-ছোটো গুমটি দোকানগুলি।
ভ্যানের কোয়াক-কোয়াক হর্ণের শব্দে বুঝতে পারলাম আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। এটি হল গেস্ট-হাউসের ভেতরের লোককে জানান দেওয়ার শব্দ। ভ্যানটিকে ঘুরিয়ে ভ্যানের পেছন দিকটা একেবারে গেটের সঙ্গে লাগিয়ে দিল চালক। আমাকে যাতে কোনোভাবেই না ভিজতে হয়।
দেখতে পেলাম হ্যারিকেন হাতে ছুটে এসেছেন ঝা-বাবু। গেট খুললেন তিনি। আমার এক হাতে খাবারের ঠোঙা, অন্য হাতে ছাতা। পকেট থেকে টাকা বের করতে হবে ভাড়া দেওয়ার জন্য। অন্ধকারে তা-ও অসম্ভব।
ভ্যান থেকে নামলাম। বুঝলাম, চালক সামনের দিকে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে ভ্যান। নইলে আমি নামতে গেলেই উল্টে যাবে। ছাতা সামলাতে গিয়ে ভিজে গেল খাবারের ঠোঙা। খোলা ছাতা একটু পেছনে হেলিয়ে কাঁধ আর চিবুকের সাহায্যে ভারসাম্য রেখে একটি হাত ক্ষণিকের জন্য মুক্ত করলাম। কোনোক্রমে সেই হাতে পকেট থেকে বের করে আনলাম দশটাকার দু’টি নোট। বাড়িয়ে ধরলাম চালকের উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে তার ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি বললাম এই কারণে যে ঝা-বাবুর হ্যারিকেনের আলো আমার শরীরে বাধা পেয়ে সামান্যতমও আলোকিত করতে পারেনি তাকে। ফলে অস্পষ্ট তার অবয়ব। টাকাটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করছে সে। আমি বললাম, ফেরত দেওয়ার দরকার নেই। পুরোটাই তোমার প্রাপ্য। এই দুর্যোগে যেভাবে পৌঁছে দিয়েছ, ভাবাই যায় না!’
ঝা-বাবুর সহায়তায় ভেতরে ঢুকলাম। ভেজা ঠোঙা সরিয়ে খাবারগুলো থালায় সাজিয়ে ফেলেছে তখনই ছোট্ট সনাতন। ভেজা ছাতা একতলায় মেলে দিয়েছেন ঝা-বাবু। হ্যারিকেন হাতে পৌঁছেও দিয়ে গেলেন আমাকে তিনতলায়।
জামা-কাপড় বদলাতে-বদলাতে বাজ পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন-ঘন। পরে-পরেই মেঘের ক্রমাগত গর্জন। বৃষ্টিও অঝর।
একটা জানালা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। সে পথে জল আসছে কিনা দেখার জন্য গিয়ে দাঁড়াতেই বিদ্যুৎ চমকের আলোয় চোখে পড়ল, চলে যাচ্ছে ভ্যান-রিক্সাটি জাতিমাটি গ্রামের দিকে। মসৃণভাবে। অবশ্য বাতাসের অনুকূলে। কিন্তু আশ্চর্য! চালকহীন!
তবে কি, পেছন থেকে ঠেলে সে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটাকে ?
আবার বিদ্যুৎ চমকাতেই লক্ষ্য করলাম পেছন দিকটায়। নাঃ, কেউ নেই পেছনে!
নীচে খেতে নেমে ঝা-বাবুকে জানালাম ব্যাপারটা। ঝা-বাবুও একটু আশ্চর্য হলেন। একটু ভেবে নিজেই একটা ব্যাখ্যা দিলেন, ‘এদিক থেকে উত্তরের পথটা কিন্তু বেশ ঢালু। তাই বোধহয় বাতাসের ধাক্কায়-ই গাড়িটিকে গড়িয়ে যেতে দেখেছেন।’
ব্যাপারটায় তখনকার মতো ওখানেই ছেদ ঘটল বটে, কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঘন্টাখানেক পরের ঘটনায়।
বৃষ্টি তখন থেমে গেছে একেবারেই। আকাশে আবার তারার উঁকিঝুঁকি ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে। কে বলবে, একটু আগেই ঘটে গেছে অমন দুর্যোগ! বিদ্যুৎও ফিরে এসেছে এখন।
ঘরে বসে টিভি-র নিউজ শুনছিলাম। ঝা-বাবুর ডাকে নীচে নেমে এলাম। এসে দেখি সেই ভ্যান-রিক্সার চালক। সঙ্গে আরও দু’জন। সকলেই বেশ উত্তেজিত। আমাকে দেখে প্রশ্ন করল, ‘বাবু আপনি ঠিক মতো পৌঁছেছেন তো ? মানে কোনো অসুবিধা হয়নি তো ?’
‘না! কিন্তু কি ব্যাপার!’ -আমার বোধগম্য হয় না কিছুই।
‘কিন্তু বাবু, আমার গাড়িটা কোথায় ?’
‘মানে ? কি বলতে চাইছো ?’
তাকে থামিয়ে দিল আর একজন, ‘আমি বুঝিয়ে বলছি।’ ইতস্তত করে সে খানিকটা, ‘মানে স্যার! আপনি হয়তো ঠিক বিশ্বাস করবেন না! কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ঘটা ঘটনা, আমরা সবাই দেখেছি।’
আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। কিছুই ঢুকছে না মাথায়।
-‘তখন মোবাইলে কথা বলছিলেন আপনি।’ আবার মুখ খোলে ভ্যানচালক, -‘আমি আপনাকে জানিয়ে ভ্যান দাঁড় করিয়ে এদের দোকানে যাই বাড়ির টুকিটাকি দু’চারটে জিনিস কিনতে। আপনি হয়তো আমার কথা খেয়াল করেননি।’
‘তা হবে! ভ্যানটা তো দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ।’ জানাই আমি।
‘হ্যাঁ স্যার! হঠাৎ দেখি ভ্যানটা চলতে শুরু করেছে! বেশ তাড়াতাড়ি, ঠিক রাস্তা ধরেই এবং নিজে নিজে!’
‘কি বলছ তোমরা ?’ প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
‘হ্যাঁ সার, ভ্যানটির কোনো চালকই ছিল না!’
‘অসম্ভব!’
‘বাজে কথা!’ বলে উঠলেন ঝা-বাবু।
‘আমি এখানে দাঁড়িয়ে নিজে হাতে ভাড়া দিয়েছি তাকে!’ বললাম আমি, -‘কুড়ি টাকা। দু’টি দশ টাকার নোট।’
‘ঠিক!’ সমর্থন করলেন ঝা-বাবু। -‘আমি দেখেছি।’
‘আমাকে- ?’ প্রশ্ন ভ্যান চালকের, আকাশ থেকে পড়েছে যেন সে।
‘না।’ মাথা নাড়লেন ঝা-বাবু। -‘সেই লোকটির চিবুকে দাড়ি ছিল, আর পরনে একটা চেক-চেক লুঙ্গি। হ্যারিকেনের আলোয় এক পলকে যেটুকু দেখেছি।’
আমি হতবাক। কী বলব! আমি তো তার মুখই দেখতে পাই নি!
তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তাদের কথপোকথনে বুঝলাম প্রথম চালকের নাম হচ্ছে অবনী। অবনীর মুখ দেখলাম পাণ্ডুর।
সে আমতা-আমতা করে জানতে চাইল -‘ভ্যানটা কোনদিকে গেছে লক্ষ্য করেছেন বাবু ?’
‘হ্যাঁ, ওই বাইপাশের দিকে। কিন্তু চালকহীন।’
অবনীর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে তখন। অন্য দু’জনের অবস্থাও তথৈবচ।
রীতিমতো হেঁয়ালীতে পড়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি তখন। ব্যাপারটা কি -কিছুতেই মগজে ঢুকছে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে সাংঘাতিক ভৌতিক এক ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে, এই কিছুক্ষণ আগে।
ঝা-বাবু বিচক্ষণ মানুষ। প্রায় ধমকে তাড়াতে চাইলেন তিনি লোক তিনটেকে। ‘ঘটনা কি ঘটেছে তোমরা বোঝো! উনি এসেছেন, যে এনেছে তাকে ন্যায্য ভাড়াও দিয়ে দিয়েছেন। ঝামেলা খতম। যাও এবার তোমরা বিদায় হও।’
লোকগুলো বেজার মুখে বিদায়ই নিচ্ছিল। কিন্তু এমন সময় আমার বন্ধু উমাকান্ত এবং তার ভাই শ্রীকান্ত এসে হাজির। এদের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই এসেছি আমি। দুর্যোগের মধ্যে আমি ফিরেছি কিনা, কিংবা খাওয়া-দাওয়া করেছি কিনা, তা খোঁজ নিতেই সাইকেলে করে এসে উপস্থিত দু’জনে।
সব শুনে তারা ব্যাপারটা দেখছে বলে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেল।
সেই রাত অদ্ভুত এক অশান্তিতে কাটল আমার এবং ঝা-বাবুর। ভোর হওয়ার অপেক্ষা। সাতসকালেই গেস্টহাউস তালাবন্ধ করে সনাতনকে সঙ্গে করে তিনজনে হাজির হলাম বিয়েবাড়ি।
ততক্ষণে চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে ঘটনাটা।
উমাকান্ত ও শ্রীকান্তর মুখে যা শুনলাম তা হল এই- ওই ভ্যান-রিক্সাটা আসগর নামে পঞ্চাশোর্ধ এক বৃদ্ধের, যিনি মাস আটেক আগে গত হয়েছেন। সংসারে জীবিত একমাত্র তাঁর অসুস্থ স্ত্রী। আসগরের মৃত্যুর পর ওই ভ্যানটা তিনি চালাতে দেন অবনীকে, দৈনিক ত্রিশটাকা জমা দেওয়ার শর্তে। প্রথমটা অবনী তা মেনে চললেও ইদানিং নাকি একেবারেই তা মেনে চলছে না। টানা দশদিন টাকা দেওয়া তো দূরের কথা, অবনী দেখাই করেনি আসগরের স্ত্রীর সঙ্গে। একমাত্র অবলম্বন ভ্যান-রিক্সা জমার ওই দৈনিক টাকা না পেয়ে প্রায় চারদিন অনাহারে আছেন মহিলা।
অবনীকে শায়েস্তা করতেই অগত্যা আসরে নামতে হয়েছে আসগরকে! হ্যাঁ অনেকেই বলেছেন সেদিন দুর্যোগের শেষে ফরিদার বাড়ির উঠানে ভ্যান চালিয়ে যাকে তারা ঢুকতে দেখেছে সে আসগরই।
সেই রাতেই ফরিদার কাছে নাক-কান মলে অপরাধ স্বীকার করে নাকি দশদিনের তিনশো টাকা জমা দিয়ে এসেছে অবনী। ফরিদা ভাড়ার কুড়ি টাকা থেকে অবনীকে ফিরিয়ে দিয়েছে দশটি টাকা। তা নাকি আসগরেরই কথা মতো। অর্ধেক রাস্তা তো আসগরই ভ্যান টেনে পৌঁছে দিয়েছে সওয়ারি। সবটা তো অবনীর প্রাপ্য নয়!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ