বিশ্বাস করো, সত্যি-সত্যি দুটো বাচ্চা ভূত ছিল। নেহাত বাচ্চা একেবারে। সবে ওরা একটু-একটু খনাখনা গলায় কথা বলতে শিখেছে। বাচ্চাকাচ্চা ছেলেপুলেদের একটু ভয় দেখাতে শিখেছে। হাত-পাগুলো এখন ইচ্ছে মতন একটু লম্বা করতে পারে। চোখগুলো খানিকটা ভাঁটার মতো লাল করতে পারে। মুখ দিয়ে মাঝে-মাঝে আগুন বার করতে পারে। অন্ধকারে সাদা-সাদা দাঁত বার করে হি-হি করে হাসতে পারে এখন।
কিন্তু নেহাত বাচ্চা তো, তাই এখনো ওরা গাছের মগডালে চড়তে ভয় পায়। ভাঙ্গা বাড়ির কার্নিশে ঝুলিয়ে বসতে ভয় পায়। বেশি রাতে পেঁচার ডাক শুনে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। ধেড়ে লোকের গলা শুনে আঁতকে ওঠে। বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে চোঁ-চোঁ করে ছুটতে পারে না। হঠাৎ সামনে থেকে বেমালুম হাওয়া হতে পারে না। এমনকি, ওদের যে রাম নাম করতে নেই, সে কথাটা পর্যন্ত জানে না। খোট্টা সেপাইদের গান শুনে ওরাও দিব্যি দুলে-দুলে গাইতে থাকে- রামা হো-হো-ও-ও।
এসব কে শেখাবে ওদের ? আহা রে! ওদের যে কেউ কোথাও নেই! বাবা নেই, মা নেই, দাদা-কাকা-মামা-মেসো কিছু না! বাচ্চা দু'টোকে ফেলে কে কোথায় কেটে পড়েছে, কোথায় আবার মানুষ হয়ে জন্মে পড়েছে, কে জানে! বাচ্চা দুটোর একটু নাম পর্যন্ত দিয়ে যায়নি। কি যে করবে ওরা! নামের অভাবে ওরা খালের ধারে বাঁশবনে গোদাভূতের পাঠশালায় ভর্তি পর্যন্ত হতে পারছে না।
খুব নামকরা পাঠশালা গোদা ভূতের। কত কি শেখায় সেখানে! পচা পুকুরে ডুব দিয়ে কুঁচো কাঁকড়া ধরতে শেখায়। ভাঙ্গা হাঁড়ি-কলসি বাজিয়ে ভুতুড়ে আওয়াজ করতে শেখায়। শেয়ালের ডাক শুনে রাত কত হল, বুঝতে শেখায়। দরকার মতো গরু-ছাগল বা কালো কুকুরের রূপ ধরতে শেখায়। গেরস্তের রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজা চুরি করতে শেখায়। ভূতের ওঝাকে বোকা বানানোর কতরকম ফন্দি শেখায়। বরফের মতো ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলে মানুষকে অজ্ঞান করে দিতেও নাকি শেখায় সেখানে!
কিন্তু হলে হবে কি, গোদা পণ্ডিত সোজা ভাগিয়ে দিয়েছে ওদের। বলেছে, তোদের নামই যখন নেই, আসল ভূতই নোস তোরা। যা- ভুতোসাহেবের কাছ থেকে আগে ভূত বলে সর্ট্টিপিট নিয়ে আয়।
ভুতোসাহেব কিন্তু মোটেই সাহেব না, কালো কুলো খাঁটি স্বদেশী ভূত একেবারে। সাহেবদের কবরখানা থেকে একবার একজোড়া পুরনো কোট-প্যান্ট কুড়িয়ে পেয়েছিল। সেগুলো পরে সাহেব সেজে থাকে সবসময়। অনেকক্ষণ ধরে সেই ছেঁড়া কোট-প্যান্টের এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে শেষকালে একটা কাগের ঠ্যাং খুঁজে পেল ভুতোসাহেব। সেটাই বাগিয়ে ধরে পেন্সিলের মতো কয়েকবার জিভে ঠেকিয়ে ভুতোসাহেব বলল, এ্যাই তোদের নাম বল। কি নামে সাট্টিপিট দেব ?
এঁজ্ঞে, কোনো নাম নেই আমাদের।
আঁ-আঁ! নাম নেই কিরে! তাহলে কি নামে সাট্টিপিট লেখব ? আচ্ছা, তোদের বাপের নাম বল।
আমাদের বাপ-মাও নেই, সাহেব। তুমি আমাদের বাপ-মা, সাহেব।
বলিস কি রে! শুনে তো ভুতো সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। কাগের ঠ্যাং দিয়ে কান চুলকাতে-চুলকাতে বিরক্ত হয়ে বলল, যত্ত ঝামেলা! কোত্থেকে দুটো আলতু-ফালতু ভূত এসে জুটেছিস। ঠিক আছে, ওই দুটো নামই দিলুম তোদের। তুই ডান দিকেরটা হলি আলতু আর বাঁ দিকেরটা হলি ফালতু- বুঝলি ?
হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ, বলে বাচ্চা ভূত দুটো এমন জোরে ঘাট নাড়ল যে তাদের ঘাড়ের হাড়গুলো খটখট করে উঠল। তা করুক। নাম পেয়ে তো খুব খুশি ওরা। যেন নতুন খেলনা পেয়েছে। নামগুলো অমনি নামতার মতো মুখস্ত করতে শুরু করে দিল দুজনে-
আমার নাম আলতু! আলতুর ভাই ফালতু!
আমার নাম ফালতু! ফালতুর ভাই আলতু!
এ ওকে খালি ডাকতে লাগল, এই আলতু- তার ডাকে সাড়া দিয়ে ও বলতে লাগল, কি রে ফালতু-
ভারী মজা লেগে গেছে ওদের! ডাকাডাকি যেন আর থামতেই চায় না। শুনে-শুনে ভুতোসাহেবের কান তো ঝালাপালা একেবারে। শেষকালে সাহেব জোর ধমক লাগাল একটা, এ্যা-ই, তোরা থামবি ? নাম পেয়েছিস, যা- বাড়ি যা এবার।
এঁজ্ঞে, কোন বাড়ি ?
তার মানে ? ভুতোসাহেব তো শুনে অবাক। জিজ্ঞেস করল, বলি- থাকিস কোথায় তোরা ?
কোথাও না, এঁজ্ঞে।
সেকিরে! তোদের থাকার জায়গাও নেই ? এতসব ঝোপ-ঝাড় বন-জঙ্গল আছে, তার কোনো একটা গাছে-টাছে থাকতে পারিস না ?
ভুতের সাহেবের গলাটা বেশ নরম নরম। আলতু সাহস পেয়ে বলল, যা সব বড়ো বড়ো পেল্লায় মার্কা গাছ। ওগুলোতে আমরা উঠতে পারি না তো।
ফালতু বলল, আর ঘুমোতে ঘুমোতে যদি পড়ে যাই ?
আহা-রে! বাচ্চা দুটোর কথা শুনে ভুতোসাহেবের মনটা খুব গলে গেল। মাথার মস্ত খুলিটা চুলকোতে-চুলকোতে সাহেব বলল, দাঁড়া- তোদের বাসার জন্য খপরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিচ্ছি। অতি খুদে দুটো বাচ্চা ভূতের থাকিবার জন্য কোনো ছোটখাটো পেঁপে পেয়ারা বা বেগুন গাছের মাথা ভাড়া চাই। ভাঙ্গা পুরনো গোয়াল ঘরের মাচা বা একতলার ফাটা চিলে ছাদ হইলেও চলিবে। কি রে, এরকম হলে তোদের চলবে তো ?
খুব চলবে! শুনে তো আলতু খুশিতে ডগোমগো।
ফালতু বলল, কিন্তু ভাড়ার পয়সা পাব কোথায় ?
সে ভার আমার। তবে যদ্দিন না ভাড়া পাওয়া যায়, তোরা আমার এই কোর্টের দু-পকেটে থাকতে পারিস।
এই বলে ভুতোসাহেব লম্বা-লম্বা দু-হাত ঢোকালো তার ছেঁড়া কোটের দু-পকেটে। বলল, এই ডান পকেটটা আলতুর বাসা আর বাঁ পকেটটা ফালতুর।
কি মজা! আলতু-ফালতু তো ঝপাঝপ ঝাঁপিয়ে পড়ল কোটের উপর। টপাটপ ঢুকে পড়ল কোটের দু-পকেটে। কিন্তু ওমা, পকেটের তলাগুলো ফুটো যে! ওপর দিয়ে যেই ঢুকল, তলার ফুটো দিয়ে অমনি গলে পড়ল টুপ-টুপ করে। মাটিতে পড়ে বেজায় গড়াগড়ি!
ভুতোসাহেব দুঃখ করে বলল, ইস্- পকেটগুলোর দফারফা একেবারে। তাই পকেটে যা রাখি, কিচ্ছু খুঁজে পাই না।
আলতু-ফালতুর কিন্তু খুব ফূর্তি। ওরা ফুটো পকেটগুলোর এদিক দিয়ে একবার ঢুকেছে, ওদিক দিয়ে আবার পড়ছে। লুকোচুরি জুড়ে দিয়েছে দুজনে।
ভুতোসাহেব অমনি হাঁহাঁ করে উঠল, ওরে- দোহাই তোদের, কোটটার আর বারোটা বাজাসনি। চল, তোদের পাঠশালায় ভর্তি করে দিয়ে আসি।
ভুতোসাহেবের পকেট ধরে ঝুলতে-ঝুলতে পাঠশালায় পড়তে চলল দুজনে। গিয়ে দেখে কি, পাঠশালা বন্ধ। গোদাপণ্ডিত হন্ত-দন্ত হয়ে বেরোচ্ছে কোনখানে। ভুতোসাহেব জিজ্ঞেস করল, অত ব্যস্ত হয়ে চললে কোথা, পণ্ডিত ? পাঠশালা ছুটি নাকি ?
আর বলো কেন, দাদা! পাগলের মতো এখানে-ওখানে কি খুঁজতে-খুঁজতে গোদাপণ্ডিত বলল, এ জন্মের মতো পাঠশালা ছুটি। আমার বদলির অর্ডার এসেছে।
অ্যাঁ- ভুতোসাহেব শুনে অবাক। বদলি আবার কোথায় ?
কোথায় আবার! সেই আগের জায়গায়। এখন আবার সেই মানুষগিরি করতে হবে। মানুষ-জন্ম নিয়ে সেখানে নতুন পাঠশালা খুলতে হবে। ওখানে ভালো পণ্ডিতের খুব অভাব কিনা!
তা এখানে কি হবে ? আলতু-ফালতুর মাথায় হাত দিয়ে ভুতোসাহেব বলল, আমি যে তোমার দুটো ছাত্তর নিয়ে এলুম। এদের কি গতি হবে ? সারাজীবন গো-মুখ্যু থেকে যাবে এরা ?
তবে চলুক আমার সঙ্গে। ওখানেই একটা পাঠশালায় ভর্তি করে দেব ওদের। কিন্তু কি মুশকিল, গত জন্মের টিকিটা যে কোথায় রাখলুম! কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
বলতে-বলতে হারানো টিকি খুঁজতে বেজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল গোদাপণ্ডিত।
মানুষ হয়ে গোদাপণ্ডিত কোথায় পাঠশালা খুলেছে কে জানে! আলতু-ফালতু কোথায় ভর্তি হয়েছে, কোন কেলাসে পড়ছে- তাও জানি না। তোমার ইসকুলের বন্ধুদের একটু জিজ্ঞেস করে দেখো তো- তোমাদের কারুর সঙ্গে ওরা পড়ছে কি না!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮
0 মন্তব্যসমূহ