Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আকুতি ।। দেবাশিস রায়


গানের ক্লাসে যেতে আর ভালো লাগছে না। রোজ সেই এক ব্যাপার। আসো, যাও। চুপচাপ বসে থেকে শোনো সবার গান। কে কেমন গাইছে। কেউ ভুল ধরে ধমক খাচ্ছে। কারো কপালে বাহবা। নিজে সেই চুপচাপ বসে থেকে ব্যাঙের মতো তাকিয়ে থাকা।

আজই শেষ দিন। সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে সুমন ভাবছিল। আর আসবে না। নাড়ুগোপাল হয়ে বসে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না। নামটা মনে পড়তে তার বেশ হাসি পেল। নাড়ুগোপাল। ওদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে সৌমেন অঙ্ক স্যারকে যমের মতো ভয় পায়। ওই ক্লাসটিতে সে একেবারে শান্ত হয়ে বসে থাকে। নিপাট ভালো ছেলে। কিচ্ছুটি জানে না। অঙ্ক স্যারও ভালো করেই জানেন সৌমেন কি জিনিস। ওর এই চুপটি করে বসে থাকাটা বেশ উপভোগ করেন। মুচকি-মুচকি হেসে গোঁফের তলা থেকে আলতো করে হাঁক দেন, নাড়ুগোপাল। আর সৌমেনের সে কি তটস্ত অবস্থা। আস্তে-আস্তে সুমনও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। চুপ করে বসে থাকে গানের ক্লাসে। যুবুথুবুভাবে। স্যার ওকে গাইতে বলেন না। তাকানও না একবারও ওর দিকে।

মাকে বলেছিল সুমন। মা তেমন গুরুত্ব দেননি। বলেছিলেন, যেতে থাক। দেখবি ঠিক একদিন উনি তোকে ডেকে পাশে বসাবেন। গান গাইতে বলবেন। শেখাবেন সবকিছু। উনি খুব নমস্য মানুষ রে। ওনার কাছে গিয়ে তোর হয়ে বলার সাহস আমার নেই।

অগত্যা কি আর করা। বাধ্য ছাত্রের মতো যায় গানের ক্লাসে আর ফেরত আসে। মায়ের বলা দিনটা আসেনি এখনো।

গান শেখানোর ঘরটা বিরাট বড়ো। চারদিকে বড়ো-বড়ো জানালা। দেওয়ালে টাঙানো গানের বড়ো-বড়ো গুরুজিদের ছবি। সবাইকে ও চেনেও না। তেমনভাবে কেউ চিনিয়ে দেয়নি ওকে। মায়ের কাছেই কয়েকজনকে চিনেছে। শুনেছে ওনাদের কথা। স্যার খুব রাগী। একবার ক্লাস চলার সময় কথা বলেছিল বলে দুজনকে স্যার বের করে দিয়েছিলেন। আর শেখাননি ওদের। সেই থেকে সুমন ভয়ে কাঁটা। ক্লাস থেকে বেরিয়েও কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগে। কেবলই মনে হয় আজকের দিনটাও বৃথা গেল। গান শেখা শুরুই হল না আজও। বেরোনোর সময় স্যারকে প্রণাম করবার রেওয়াজ এখানে। প্রতিদিন আসবার সময় স্যারকে প্রণাম করবার পরে ওর খুব কান্না পায়। একটা জমাট বাঁধা দুঃখ ওর গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে। বড্ড অসহায় লাগে। কোনোমতে প্রণাম করে সুমন ছুটে বেরিয়ে আসে। বাইরের খোলা বাতাসে ছড়িয়ে দেয় ওর দীর্ঘশ্বাস।

আজ ভেতরে ঢুকে সুমন বেদিটার সামনে বসল। গানের ঘরটার এক কোণায় একটা বড়ো ডায়াস মতো করা আছে। সেখানে রাখা আছে যন্ত্রসঙ্গীতের বিভিন্ন উপকরণ। সেতার, মাদল, গিটার, বেহালা, পাখোয়াজ, রুদ্রবীণা আরো কত কি। সব চেনে না সুমন। তবলা, হারমোনিয়ামও কত রকমের। সুমন গান শোনার ফাঁকে-ফাকে উদাস চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিল খুঁজে পায় ওদের সঙ্গে নিজের। ওদেরকে কেউ কখনো বাজিয়েছে কিনা কে জানে! ওরাও তার মতোই চুপচাপ গান শোনে। গানের অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায় না। আজ এসে সুমন ওদের সামনে বসবার জায়গা বেছে নিল। হয়তো খানিকটা আত্মীয়তা বোধে।

বড়ো ঘরটা জুড়ে শতরঞ্চি পাতা। দু-চারজন  ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। গানের খাতা খুলে ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে গান নিয়ে কথা বলছে। ওরা সুমনকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। উদাস চোখে সারা ঘরটায় চোখ বুলিয়ে সুমন তাকালো ওর সেই কাঙ্খিত আসনটির দিকে। স্যারের বিশাল হারমোনিয়ামটার সামনে একটা বড়োসড়ো কাঠের জলচৌকি রাখা। মেঝের সঙ্গে লেপ্টে আছে। পাশে একটা ছোট্ট হারমোনিয়াম। তার সামনে সুন্দর কাপড়ের একটা আসন। যাকে স্যার গান গাইতে ডাকেন, সে ওই কাপড়ের আসনে বসে ছোটো হারমোনিয়ামে সুর তোলে। আজকাল কানে সুরগুলো ঢোকে ঠিকই কিন্তু মন অবধি পৌঁছয় না। টনসিলে ভোগা বাচ্চা যেভাবে আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে থাকে, এই মুহূর্তে সুমন ঠিক সেই দৃষ্টি নিয়ে শিক্ষার্থীর আসনটির দিকে তাকিয়ে আছে। কবে সুযোগ আসবে ওখানে বসার! কিছু না পাওয়ার কষ্টটা আবার গলায় জমাট বাঁধছে। পাশের যন্ত্রানুসঙ্গের দিকে তাকিয়ে একটু সান্ত্বনা পেল সে। ওরাও যে তারই মতো।

আস্তে আস্তে বড়ো হলঘরটা ভরে গেছে কখন, সুমন খেয়াল করেনি। একটা চাপা গুঞ্জন হচ্ছিল ঘরটায়। আচমকা সেটা থেমে যেতে সুমন বুঝতে পারল স্যার আসছেন। পর্দা সরিয়ে স্যার হল ঘরটায় ঢুকতে ছাত্রছাত্রীরা সবাই শতরঞ্জিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। সুমনও করল। খানিকটা যন্ত্রবৎ। কাঠের জলচৌকিতে বসে স্যার হাত ওঠালেন। সবাই আরো কাছাকাছি সরে এসেছে। সবার মেরুদণ্ড সোজা। কাকে ডাকবেন স্যার! স্যার ডাকলেন একজনকে। সে গিয়ে বসল কাপড়ের আসনটিতে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে সেদিকে। স্যার ছেলেটিকে বললেন, আলহিয়াবিলাত্তাল ধরতে। ছেলেটি হাত উল্টে-উল্টে বোল ধরল, সা রে গা রে গা পা ধা নি ধা সা...। সা নি ধা পা ধা নি...। স্যার চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। হাতের ইশারায় থামতে বললেন। ছেলেটি ভয়ে জড়োসড়ো। স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, এই নি টা কি এত ওপরে হবে ? ছেলেটি মাথা নাড়ল। স্যার মৃদু স্নেহের সুরে বললেন, অবরোহে যখন নামবে, এই নি টা কোমল হবে। মনে থাকবে ? নাও, শুরু করো আবার প্রথম থেকে।

ছেলেটি আবার প্রথম থেকে শুরু করল। হারমোনিয়ামের ওপর হাতের তাল ঠুকে-ঠুকে। একরাশ ব্যথা ভরা চোখে সুমন জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। শরতের সন্ধে নেমে আসছে বাইরে। শিউলি ফুটতে শুরু করেছে। ওদের বাড়ির উঠোনের পাশে একটা গাছ আছে। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে একটা মিষ্টি গন্ধ পুরো চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। ছেলেটির মিষ্টি গলায় বোলগুলো এবার হারমোনিয়ামের সঙ্গে বেজে উঠল। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধের মতো একটা মিষ্টি আমেজ ওর চেতনায় ছড়িয়ে পড়েছে। আজ যেন সুর তাল বোল ওর হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। জানলার আকাশে ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলায় সুমন ভেসে যেতে লাগল।

একে-একে বেশ কয়েকজনকে দিয়ে স্যার আলহিয়াবিলাত্তাল গাওয়ালেন। তারপরে ধরলেন ভীমপালশ্রী। বলে যেতে লাগলেন, গা আর নি টা কোমল গাইবি। আরোহে নি সা গা মা পা নি সা। অবরোহে সা নি ধা পা মা গা রে সা। মনে রাখিস গা আর নি টা কোমল হবে।

শ্রুতি বলে একটা মেয়ে স্যারের কাছে খুব বাহবা কুড়োলো। শ্রুতিকে ও চেনে। ওর মা একজন খুব বড়ো শিল্পী। সুমনের মনে-মনে খুব ইচ্ছে করছিল স্যারের পাশে বসে ভিমপালশ্রী গাইতে। একবার যদি স্যার ওকে ডাকতেন। মায়ের সঙ্গে বসে কিছুটা শিখেছিল। ভীষণ ইচ্ছে করছে শ্রুতির মতো গাইতে। স্যারের কাছ থেকে প্রশংসা বাণী শুনতে। কিন্তু ও জানে, স্যার ওকে ডাকবেন না। কেন, তা জানে না। আবার সুমন জানলা দিয়ে উদাস হল। মেঘের ভেলা। সবুজ পাতার নাচানাচি। পাশে রাখা যন্ত্রগুলো ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে নাকি! জানে না, সুমন জানে না। জানলা থেকে চোখ সরিয়ে যন্ত্রগুলোর দিকে তাকাল। ওরা যেন আরো বেশি উদাস। স্যার বলছেন, আশাবরী, দুর্গা, দেশ...। কার সঙ্গে  কার কোথায় তফাৎ। মাঝে-মাঝে একটু বড়োদেরও দিয়ে গাওয়াচ্ছেন। ছোটোরা মন দিয়ে শুনছে। স্যার বলছেন, কান তৈরি কর তোরা আগে। আগে কান পরে গলা। বড়ো শিল্পী হতে গেলে ভালো শ্রোতা হতে হবে আগে। মন দিয়ে শোন কে কি গাইছে। কেমন ভাবে গাইছে। বোঝার চেষ্টা কর কোথায় ঠিক হচ্ছে, আর কোথায় ভুল হচ্ছে।

আচ্ছা, সুমন শুনছে না কেন ? ও কি আদৌ গান শেখার উপযুক্ত নয় ? মন দিতে পারছে না কেন ? আর কতদিন এভাবে শুধু শুনে যাবে ? এই আসনে বসবে কবে ? ভীষণ-ভীষণ মন খারাপ করছে ওর। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছে পুরো ক্লাসটা। পরের দিকটায় কিছুই শোনেনি ও। নিজের কষ্ট অন্যমনস্ক হয়ে চাপবার চেষ্টা করছিল। হুঁস্ ফিরল যখন, দেখতে পেল ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। একে-একে সবাই গুরুপ্রণাম করে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। আস্তে-আস্তে অত বড়ো হল ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা সাদা-কালো চুলের মানুষটিকে সবাই প্রণাম করছে। উনি তাদের পিঠে হাত রেখে আশীর্বাদ করছেন। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার মধ্যে দিয়ে স্নেহের দৃষ্টি ঝরে পড়ছে। ওনার দিকে তাকালেই শ্রদ্ধায় যে কারো মন ভরে যেতে বাধ্য। সুমন দেখেছে ওর মা কি ভীষণ শ্রদ্ধা করেন ওনাকে। এই মুহূর্তে আর কেউ নেই হল ঘাটায়। সুমন শেষ বিদ্যার্থী যার এখনো গুরুপ্রণাম বাকি আছে। ধীর পায়ে উঠে গিয়ে সুমন স্যারের পায়ে হাত দিল। পিঠে স্যারের ছোঁয়া পাচ্ছে। সুমন আজকে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। স্যারের পা দুটোর ওপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পায়ে অশ্রুবিন্দুর ছোঁয়া পেয়ে স্যার সস্নেহে ওকে দু-হাতে টেনে ওঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, কাঁদছিস কেন ?

স্যার, আমি গান শিখতে চাই। আমাকে শেখাবেন না ? এতদিন হয়ে গেল। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে স্যার। আপনি আমাকে যা বলবেন, আমি তাই করব। সত্যি বলছি স্যার, আমার খুব কষ্ট হয়।

স্যার সস্নেহে ওর চোখের জল মুছে দিলেন। চেপে ধরলেন বুকের মধ্যে। মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে বললেন, এবার শেখাব তোকে। তোর এই আকুতিটার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিলাম রে। আমি জানি তুই আমার সেরা ছাত্র হবি। তুই জানিস না। আমি একদিন চুপিচুপি তোর গান শুনে এসেছি, তোদের বাড়িতে গিয়ে। তোর মা-বাবা জানত। ইচ্ছে করে তোকে জানানো হয়নি। তুই জানিস ? তোর মা আমার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল ? তুই যখন খুব ছোট্ট ছিলি, খুব ভুগতি। তোর যত্ন নিতে গিয়ে তোর মা গান ছেড়ে দিয়েছিল। লুকিয়ে-লুকিয়ে কাঁদত গানের জন্য। তোর বাবা একদিন দেখতে পেয়ে আমায় এসে বললেন। আমি তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম, তোকে আমি নিজের হাতে, নিজের মতো করে তৈরি করব। তারপরে তোর মায়ের কান্না থেমেছিল। এতদিন ধরে তোকে সেই তৈরি করবার কাজটাই আমি করছিলাম। আজ এই যে তুই কাঁদলি, বুঝতে পেরেছি কেন। তুই তৈরি হয়েছিস এবার। জানিস তো, না পাকলে ফল গাছ থেকে পড়ে না। তোর ভেতরের ইচ্ছেটা আজ পূর্ণতা পেয়েছে বলেই তুই কাঁদলি। আজ থেকে তুই আমার ছাত্র হলি। শোন, ভীমপালশ্রীটা শুনেছিস তো আজ কিছুটা ? পরেরদিন তৈরি হয়ে আসবি। মায়ের কাছে বসিস একটু। তারপর তো আমি আছি। তোকে দিয়েই শুরু করব পরদিন, ঠিক আছে ?

এক ছুটে সুমন বেরিয়ে এল বাইরে। মেঘের ভেলায় ভাসতে-ভাসতে বাড়ির সামনে এসে নামল আর খোলা দরজায় ছুটতে-ছুটতে ঢুকে পড়বার সময় ওর ভেতর থেকে একটা বিরাট জোরে আওয়াজ বেরিয়ে এলো মা...।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ