Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সুপারকিড ।। তৃষ্ণা বসাক

 



ইতিহাস বলছে, নার্সারি ওয়ানে ক্লাস শুরুর দুদিন আগে কাঁচি দিয়ে মাথার চুলে বেশ একটা ডিজাইনার ছাঁট দিয়েছিল টুঙ্কা। তাই দেখে টুঙ্কার মা রাগে, দুঃখে এবং ভয়ে নিজের মাথার চুল ছিঁড়েছিলেন। তারপর মেয়ের ওই চুলেই প্যাচওয়াচ করে তিনি কিভাবে তাকে সভ্য-ভব্য করে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, সেই গোপন টিপস্ সংগ্রহ করতে পারলে হাবিব'স-এর চেয়েও মারকাটারি সেলুন খুলতে পারে কেউ। নার্সারি ওয়ান থেকে নার্সারি টু, তারপর ট্রানজিশন ক্লাস ওয়ান, শেষ পর্যন্ত ক্লাস টু-তে টুঙ্কার উত্থান বিজ্ঞানের ভাষায় এত ঘটনাবহুল, এতটাই রোমাঞ্চকর যে ভদ্রমহিলার মাথায় ছেঁড়ার মতো বিশেষ চুল অবশিষ্ট রইল না।

কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভাষাতেই যখন অংকে অবিশ্বাস্য রকমের কম নম্বর নিয়ে টুঙ্কা বাড়ি ফিরল, তখন ওই প্রায় নির্মূল মাথাতেই বরফ দেওয়ার প্রয়োজন হল। এমন নয় যে নম্বরের এই অধঃপতনের সঙ্গে তিনি পরিচিত নন এইতো সেদিন গলায় ফেনা তুলে জি. কে মুখস্থ করার পর টুঙ্কা খাতায় মণিমুক্তো ছড়িয়ে এল। যথা- জহরলাল নেহেরু কে বাচ্চারা চিলড্রেন্স ডে বলে ডাকে! ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম পাগলু! জল ফোটালে স্নেকস মারা যায়!- ইত্যাদি ইত্যাদি।

টুঙ্কা এরকম এক-একটা ঘটনা ঘটালেই, টুঙ্কার বাবার আবার তার খেই ধরে নিজের ছেলেবেলার সমজাতীয় ঘটনা মনে পড়ে। টুঙ্কার জি. কে-এর উত্তর শুনে তার যথারীতি মনে পড়ল, তিনিও ছোটোবেলায় মেষ মাঠে চরে, না লিখে মেসো মাঠে চরে লিখেছিলেন। আর বাবা চা করে আনলেন-এর ট্রান্সলেশন করেছিলেন ফাদার ওয়াজ আ সারভেন্ট!

তা, টুঙ্কার বাবা এমন লিখতেই পারেন। ময়নাগুড়ির কাছে অখ্যাত এক গ্রামের টালির চালের পাঠশালায়তার তাঁর লেখাপড়া। মাঠ, গাছ, ঝর্ণার ডাকে তাঁর তো অর্ধেক দিন স্কুল যাওয়াই হত না। কিভাবে যে ওখান থেকে বেরিয়ে এত নামকরা ডাক্তার হলেন, ভগবানই বলতে পারবেন। কিন্তু টুঙ্কা! অনেক কাঠ, খড় ও টাকা পুড়িয়ে তাকে কলকাতায় সেরা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মা তাকে নিজে পড়ানোর জন্যে অর্ধেক দিন নিজের ক্লাসটাই নিয়ে উঠতে পারেন না- তার কেন এরকম হবে ?

সে প্রশ্নের উত্তর পেতে না পেতেই, অংকের সুনামি এসে টুঙ্কার সাজানো সৈকত তছনছ করে দিল। অঙ্কে চার। কুড়ির মধ্যে চার! নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলছে, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। এক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিপরীত হলেও ঠিক সমান হল না। অংকের নম্বরের প্রেক্ষিতে টুঙ্কার মায়ের রক্তচাপ দ্বিগুণ, চতুর্গুণ বেড়ে গেল। মাথায় আইসব্যাগ চেপে তিনি ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন, কি করে পারলি রে ?

মার উত্থানরহিত অবস্থা দেখে মহানন্দে টুঙ্কা একটা বাটিতে লাল রঙ গুলছিল- বার্বির চুল রং করবে। মা দেখে ফেললে মহাবিপদ। সে তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র (ক্রাইম একিজবিটস) আলমারির তলায় চালিয়ে দিয়ে ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলল, কি মা ? ফ্রিজ থেকে আর আইসক্রিম বার করে দেব ?

-ওঃ এটাকে কেউ দয়া করে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাবে ? ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় চিৎকার ঠিক বিড়ালের কান্নার মতো শোনাল। পাশের ঘর থেকে বাবা ছুটে এলেন। মায়ের বাক্যরোধ হওয়ায় তাঁরও খুব আনন্দ হয়েছে, তা তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এসেই গোটা পরিস্থিতিটা চিকিৎসক সুলভ টেকনো পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝতে পারলেন, সাধারণ ওষুধে হবে না। এন্টিবায়োটিক লাগবে। তিনি টুঙ্কাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, এত কম কি করে পেলি রে ?

এসব প্রশ্নের উত্তরে টুঙ্কা সচরাচর বি.পি.এলের মতো একটা তালিকা পেশ করে। তাতে থাকে ক্লাসের কারা-কারা ওর চেয়েও কম নম্বর পেয়েছে, থিওরি অফ রিলেটিভিটি না পড়েও জগতের সবকিছুই আপেক্ষিক। এই তালিকাটি দেখিয়ে সে প্রমাণ করার চেষ্টা করে তুলনামূলকভাবে সে কত ভালো অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই তালিকাটা সে আজ হাজির করল না। উল্টে, বেশ খানিকটা অভিমানের সুরে বলল, আমাকে তোমরা কোনদিন সুপারড্রিঙ্ক খাইয়েছ, যে ভালো নম্বর পাবো।

- সুপারিড্রঙ্ক! একটা পরিষ্কার আর একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা পাশাপাশি বেজে ওঠে বিস্ময়ে!

- হ্যাঁ সুপার ড্রিঙ্ক। সোহম কোলে খায়, বিদ্যুৎ বর্ণা বাসু খায়, আন্তরিকা মুন্সি খায়... এবার একটা নতুন তালিকা। তাতে ক্লাস টু-এ সেকশনের প্রায় নব্বই ভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের নাম।

- হরলিক্স, বোর্নভিটা, পিডিয়াসিওর, মিল্কশেক সবই তো খাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।

বাবা হাসি-হাসি মুখে বোঝাতে চাইলেন টুঙ্কাকে।

-উঁহু,  ওসব হবে না। সুপারড্রিঙ্ক খেলেই সব সাবজেক্টে হায়েস্ট মার্ক।

এবার বাবার মুখের হাসি মুছে যায়। চোয়াল ঝুলে পড়ে। মা উত্তেজনায় বসার চেষ্টা করেন। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলাতেই বলে ওঠেন- বেশি চালাকি করো না টুঙ্কা। একে কম নম্বর পেয়েছ, তার ওপর মিথ্যে কথা বলছ! কি ভাবো, আমরা খুব বোকা ?

এবার, যা টুঙ্কাজিনত নয়, তেমন একটি কাণ্ড করে বসে টুঙ্কা। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে আর কাঁদতে কাঁদতেই বলে- বোকাই তো। বোকা ছাড়া কেউ এক-একটা স্টোরির জন্য সেভেন্টি-টু টা কোয়েশ্চ মুখস্ত করায়। দু'নম্বরের মেক সেন্টেন্সের জন্যে  টোয়েন্টি ফাইভটা সেনটেন্স প্র্যাকটিস করায় ? অত কি আমি মনে রাখতে পারি ? কেউ পারে বুঝি ?

এবার বাবা ঠিকমতো সুরে প্রশ্ন করেন।

-তাহলে ওরা পারে কি করে টুঙ্কা ?

-সেই কথাটাই তো বলতে চেষ্টা করছি, তোমরা শুনছোই না। এটুকু বলেই ক্ষান্ত দেয় না টুঙ্কা। সে অবিকল মায়ের মতো করে বলে- এটাই তোমাদের নিয়ে প্রবলেম। তোমরা কেউ কিছু শোনো না!

বাবা-মা কাঠের পুতুলের মতো ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকেন টুঙ্কার দিকে। বেশ বোঝা যায়, কথা শোনার শিক্ষাটা ওঁরা এখনই গ্রহণ করতে উৎসুক।

-ওরা পারে, কারণ ওরা সুপারড্রিঙ্ক খায়। ছোট্টবেলা থেকে। তাই তো ওরা অংক, জি.কে, লিটারেচার-সব সাবজেক্টেই রোবটের মতো নিখুঁত। রিয়েলিটি শো'র লিটল চ্যাম্পও ওরাই।

ওর মা এবার আকুল হয়ে বলে উঠল- কোথায় পায় সুপারড্রিঙ্ক, বল ? আজই এনে খাওয়াব তোকে।

টুঙ্কা এবার রহস্যময় গলায় বলে- কোনো এমনি দোকানে তা কিনতে চাইলেই কেনা যায় বুঝি ? ঝোলায়  সুপারড্রিঙ্ক নিয়ে ম্যাজিশিয়ান ঘুরে বেড়ায়। যখন বোঝে, এরা কেনার জন্য তৈরি, তাদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, কিনবেন ? খুব সস্তায় করে দেব।

টুঙ্কার মা সম্মোহিতের মতো বলেন- কিনব, কিনব।

-উঁহু। তোমাদের দেখে ম্যাজিশিয়ান বোঝে তোমরা কেনার লোক নও। তাই ধারে কাছে ঘেঁষে না। তোমাকে যদিও বা পছন্দ হয়, বাবাকে একদমই নয়। বাবার গায়ে সেই ঝর্ণা, জঙ্গল স্কুল-পালানোর গন্ধ আছে না!

মা অমনি চোখ কটমট করে ওর বাবার দিকে তাকান। উঃ, লোকটা সারাজীবন চালাচ্ছে- এই রকম একটা ভাব ফুটে ওঠে তাঁর চোখে।

ওর বাবা, বিপদ বুঝে অন্যদিকে কথা ঘোরাতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কি আছে এই সুপারড্রিংকে ?

-সুপারকিড হবার ফর্মুলা। বলেই মিচকি হাসে টুঙ্কা। ওর বাবাও মিচকি হাসেন ওর নকল করে। তারপর আচ্ছা করে টুঙ্কার কান মুলে দেন। হাল ছেড়ে মাকে বলেন, টেক ইট ইজি। কয়েকটা দিন তুমি গান-টান শোনো, সিনেমা দেখ, শপিং করে রাত করে ফিরো। মাসখানেক টুঙ্কাকে আমিই পড়াব। জানো তো, টেনশন লেনে কা নেহি, দেনে কা হ্যায়।

-কি বলছ, টেনশন করব না ? এই নম্ব! চিঁ-চিং করে বলেন মা।

-টেনশন নয়, গর্ব করবে। সুপারড্রিঙ্ক না খাইয়েও সুপারকিড বানাতে পেরেছি। এই বয়সে এরকম গল্প বানাতে শিখিয়েছে যে মেয়ে, তাকে নিয়ে ভয় ?

টুঙ্কার বাবার হাসির গমকে দরজা জানলা কেঁপে ওঠে। টুঙ্কা এই সুযোগে আলমারির তলা থেকে ঝটিতে রঙের বাটি, বার্বি, ব্রাশ বার করে এক ছুটে ঘরের বাইরে।

 

অলংকরণ অমর লাহা

প্রকাশিতচিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ