![]() |
২৫শে মার্চ ২০০০, শনিবার রাত দেড়টা।
আজই প্রথম নাইট ডিউটি পড়েছে। মাত্র চারদিন হল মহাবালেশ্বরে ছবির মতো এই হোটেলটায় ভোকেশনাল ট্রেনিং করতে এসেছি। মাসখানেক থাকতে হবে। গত তিনদিন সার্ভিস বিভাগে কাজ করলাম। আজ প্রথম ফ্রন্ট অফিসে ডিউটি পড়ল, তাও রাতের শিফ্টে। রাতের ডিউটিতে ফ্রন্ট অফিস বলতে রিসেপশন কাউন্টার। টেলিফোন বোর্ড, রেল-কাউন্টার ইত্যাদি সবকিছু তখন রিসেপশনের জিম্মায় থাকে। যা হোক কাউন্টারে এই হোটেলের পুরনো কর্মী আজিজভাই ছিল, আমাকে যে ওর বেশ পছন্দ হয়েছে তা ওর চোখ মুখ বলে দিচ্ছিল।
রাত এগারোটার পরই গেষ্ট-এর ভীড় কমে গেল, হোটেল প্রায় নিঃঝুম হয়ে এল। আজিজভাই ওর মুম্বাই মার্কা হিন্দী আমাকে বলল, তুমি কাউন্টারে বসো। আমি পেছনের ঘরে ছোট্ট করে ঘুমিয়ে নিচ্ছি। রাত তিনটে নাগাদ ওকে ডেকে দিলে আমি খানিকক্ষণ ঘুমোতে পাব। আজ রাতে কোনো নতুন গেষ্ট আসার আগাম বুকিং নেই। অতএব কাজের চাপ নেই বললেই হয়। চুপচাপ একা বসে থাকা ভারি একঘেঁয়ে। ভিজিটারস এরিয়ার সেন্টার টেবিল থেকে একগুচ্ছ ম্যাগাজিন তুলে এনে সেই থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পড়ছিলাম এতক্ষণ। বিশাল লাউঞ্জের বেশিরভাগ আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আলো-ছায়ায় জমকালো লাউঞ্জটাকে এখন কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। বাঁ দিকের মেন দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নেপালি দারোয়ান প্রেম বাহাদুর ওভারকোট, টুপি আর মাফলার জড়িয়ে টুলে বসে ঢুলছে। রাতের দিকে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। আগাগোড়া কাঁচের তৈরি দারোয়ান-কুঠুরিতে না বসে বাহাদুর কেন যে ঠাণ্ডায় বাইরে বসে রয়েছে তা বুঝলাম না। যাকগে আমার মাথা ঘামানোর কোনো মানে হয় না।
কুরুর... কুরুর..., নৈঃশব্দ ভেঙে টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন কনসোলে ২০৩ নম্বরে আলো জ্বলছে, অর্থাৎ ২০৩ নম্বরের গেষ্ট ফোন করছে। রাতে যখন রুম সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় তখন সব ফোন রিসেপশনেই আসে, এটাই নিয়ম। শুনেছি অনেক বেয়াড়া গেষ্ট অসময়ে কিম্বা রাতবিরেতে এটা-সেটা চেয়ে বিষম ঝামেলায় ফেলে। এত রাতে ২০৩ নম্বরের অতিথির কি প্রয়োজন হল কে জানে! ফোন তুলে তাড়াতাড়ি সাড়া দিলাম।
-গুড ইভিনিং, ফ্রন্ট অফিস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ ?
গুড ইভিনিং বলে ফেললাম। ঘড়িতে বাজে রাত দেড়টা। আমেরিকানদের মতো রাত বারোটার পরই গুডমর্নিং বলাটা আমার অভ্যাস হয়নি। এই অতিথি যা ভাবে ভাবুক।
কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। ওপ্রান্ত থেকে কোনো সাড়া নেই। তবে কি ভুল করে... ? বললাম, হ্যালো।
-দোশ তিন মে এক কাপ চায়, খসখসে শীতল কোনো মহিলা কণ্ঠ।
-ওকে ম্যাডাম, আই অ্যাম জাস্ট সেন্ডিং।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে মনে হল, দুম করে বলে তো ফেললাম, কিন্তু এত রাতে কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে। চা পাঠাব কিভাবে! ভারি মুস্কিল হল। অর্ডার দিয়ে জিনিস না পেলে অতিথি চটে যাবে এবং সেটা হলেই হোটেলের বদনাম। নিরুপায় হয়ে আজিজভাইয়ার ঘুম ভাঙালাম।
-২০৩-এর গেস্ট চা চাইছে, এত রাতে।
-কৌন সা রুম নম্বর কহা ?
-টু জিরো থ্রি।
-ফরগেট ইট।
-সে কি ! গেস্ট চা চাইছে অথচ ...।
-কহা না ভুল যাও, আজিজভাই-এর গলায় মাছি তাড়ানোর নির্লিপ্ততা। ফের শুতে যাওয়ার উদ্যোগ করে। তবে তার আগে আমাকে আঙুলের ইশারা করে বলে, ও দেখ ‘কি-বোর্ড’ পর।
বলাবাহুল্য তৎক্ষণাৎ চাবি রাখার কুঠুরির দিকে আমার নজর স্থির হল। আর সেদিকে চোখ পড়ামাত্র একটা ঠাণ্ডা স্রোত আমার শিরদাঁড়া দিয়ে যেন নীচে নামতে থাকল। ২০৩ নং ঘরের চাবি শান্তভাবে হুকে ঝুলছে, যার অর্থ ২০৩ নম্বর ঘরে কোনো অতিথি নেই। তবে! কে ফোন করল ? আমি যে পরিস্কার দেখলাম কনসোল ২০৩ নম্বরে আলো জ্বলতে!
আমার বিমূঢ় অবস্থা দেখে আজিজভাই হেসে ফেলে, বলে, ২০৩ নম্বর রুম খালি থাকলে মাঝে-মাঝে ওরকম ভূতুড়ে ফোন আসে। তিন সাল আগে এক শুটিং পার্টি এই হোটেলে এসে উঠেছিল। মুম্বই থেকে এরকম শুটিং পার্টি হামেশাই আসে। ওই শুটিং পার্টির সঙ্গে এসেছিল এক উঠতি হিরোইন। তিনদিনের মাথায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছিল ওই অভিনেত্রীর ২০৩ নং ঘরে। পুলিশ যদিও ঘটনাটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়েছিল, হোটেলের অনেক কর্মীই আড়ালে দাবী করত ওটা আসলে ছিল খুন। খুন কিম্বা আত্মহত্যা যাই হয়ে থাকুক না কেন, ওই ঘটনার পর থেকে রাত দেড়টায় মাঝে মধ্যে এরকম ফোন আসে। তবে ঘরে গেস্ট থাকলে সব চুপচাপ। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আজিজভাই ফের ঘুমোতে চলে গেল পিছনের ঘরে।
ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আজিজভাই-এর কথা ঘুরে ফিরে মনে আসতেই ফের টেলিফোনটার দিকে নজর চলে গেল। টেলিফোনকে দেখে এত ভয় আগে কখনো পাইনি।
২৭শে মার্চ ২০০০, সোমবার, রাত তিনটে।
কাল থেকে ২০৩ নম্বরে একটি পরিবার এসেছে। স্বামী-স্ত্রী আর একটা বাচ্চা মেয়ে। আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, রুমে ভূতের উপদ্রব আছে বলে গেস্ট নির্ঘাৎ অভিযোগ করবে। আজিজভাই কিন্তু নির্বিকার। ভাবখানা এমন যেন ২০৩ নম্বরে কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই বা কখনো ছিলও না। হতাশ হলাম কিছুটা, যখন দেখলাম রাতেরবেলা ওরকম কোনো ফোন এল না। ২০৩ -এর গেস্টও কোনো কমপ্লেন করেনি। তাহলে বোধহয় ভূত পালিয়েছে।
২৯ শে মার্চ ২০০০, বুধবার রাত ১-৩০ মিনিট।
সব ম্যাগাজিনগুলো আদ্যোপান্ত পড়া হয়ে গেছে। আর পাতা-টাতা ওল্টাতেও ইচ্ছে করছে না। ভিতরের ঘরে আজিজভাই অনেকক্ষণ আগেই টান-টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। রিসেপশনের ভেতরে রাখা ছোট্ট রঙিন টিভিটা ভল্যুম কমিয়ে চালু করলাম। একটা রদ্দি মার্কা ইংরাজী ছবি হচ্ছে টি.ভি-তে। ‘ধ্যুৎ’ বলে টিভিটা বন্ধ করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল। কুরুর... কুরুর... চকিতে আমার চোখ চলে গেল চাবির বোর্ডে। ২০৩ নম্বরের চাবি শান্তভাবে ঝুলছে। তাড়াতাড়ি সামনের রেজিষ্ট্রেশন বইটা খুললাম। ২০৩-এর গেস্ট আজই বিকেল পাঁচটায় চেক-আউট করে গেছে। টেলিফোনের কনসোলে ২০৩ নম্বরটা জ্বলছে। কুরুর... কুরুর... শব্দে টেলিফোনটা অসীম ধৈর্য্যে বেজেই চলেছে। তুলব না ভেবেও কখন কানে তুলে নিয়েছি।
সেই ঠাণ্ডা খসখসে মহিলা কণ্ঠ, দোশ তিন মে এক কাপ চায়।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ