![]() |
মা ঘরে ঢুকতেই গুড্ডু আধো-আধো গলায় বলে উঠল, ‘দা দা।’
প্রথমটায় চমকে উঠলেন মা। তারপর লাফিয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি গুড্ডুকে কোলে নিয়ে চুমোয় ভরিয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘আবার বল, আবার বল।’
গুড্ডু আবার বলল, ‘দা দা।’
আনন্দ যেন আর ধরে রাখতে পারছেন না মা। কিন্তু সেকথা কাকে আর বলবেন ? বাড়িতে তো এখন অন্য কেউ নেই। তাই গুড্ডুকেই বললেন, ‘গুড্ডু সোনা, আজ যে আমার কত্ত আনন্দ হচ্ছে, তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।’
মায়ের কথার উত্তরে গুড্ডু শুধু বলল, ‘দা দা।’
ওকে আবার চুমো খেয়ে মা বলেন, ‘আচ্ছা সোনা এবার মা বল তো, ম্ম্মা।’
গুড্ডু বলল, ‘দা দা।’
মা হাল ছাড়েন না। বলেন, ‘বাবা বলো, বাবা, বা-বা।’
গুড্ডু তবুও বলল, ‘দা দা।’
একটু দমে গেলেও আবার আগের খুশিতেই ফিরে গেলেন মা, ‘দাদা বলতে ভাল লাগছে তোমার ? ঠিক আছে, তুমি তাই বলো। দা-দা, দা-দা।’
গুড্ডু বলতে লাগল, ‘দা-দা, দা-দা, দা-দা।’
মা অবাক হয়ে দেখলেন গুড্ডুর মুখটা কেমন কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল। মা ভাবলেন, কি জানি বাবা, বাচ্চাদের মেজাজ মর্জি বোঝা দায়।
বাবা অফিস থেকে ফিরতেই মা বললেন, ‘জানো আজ গুড্ডু কথা বলেছে!’
খবরটা শুনে বাবাও খুব খুশি, ‘বাঃ দারুণ খবর। তা কি-কি কথা বলল গুড্ডুবাবু ?’
‘না বেশি কিছু বলেনি, শুধু দাদা, দাদাই করছে।’
বাবা একটুও হতাশ না হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, কথা বলতে শুরু করেছে যখন, আর চিন্তা নেই। ডাক্তারবাবু তো বলেইছেন, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে ওর একটু অসুবিধা হচ্ছে। একবার সেটা ভেঙে গেলেই ও ঠিক কথা বলবে।’
মা বলেন, ‘হ্যাঁ এই দিনটার জন্যেই তো ধৈর্য ধরে বসেছিলাম আমরা।
বাবা অভয় দেন, ‘ধৈর্য হারিও না। আজ একটা কথা বলেছে। ধীরে-ধীরে দুটো-তিনটে করে বাড়বে। তবে তুমি কিন্তু ওকে একদম জোর করবে না। তাহলে ও ভয় পেয়ে যেতে পারে।’
বাবা-মা মাস চারেক আগে গুড্ডুকে একটা আশ্রম থেকে এনেছেন। তখন গুড্ডুর বয়স ছিল এক বছরের থেকে কিছু বেশি। তাহলে হিসেব মতো এখন ওর বয়স প্রায় দেড় বছর। সারাদিন পায়রার মতো বকম-বকম করার কথা ওর। অথচ মুখে মোটেই শব্দ করে না। আর চোখে মুখে যেন বিষাদ মাখানো। কিছুদিন যেতেই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন বাবা-মা।
সব দেখে-শুনে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘দেখুন, ছেলেটা এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে এসেছে। মানিয়ে নিতে একটু তো সময় নেবে। তাছাড়া একেবারে সদ্য জন্মানো শিশু তো নয়। একবছরে ওর অনেক স্মৃতি তৈরি হয়ে গেছে। সেগুলো ভুলতেও সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না। আপনাদের ভালোবাসা ঠিক একদিন ওকে আগের অবস্থা থেকে বার করে আনবে। ধীরে-ধীরে ও আপনাদেরকেই বাবা-মা বলে মেনে নেবে। তবে আপনারা কিন্তু একদম তাড়াহুড়ো করবেন না। খুব ধৈর্য ধরে নিজেদের কাজ করে যান। আর ওর সামনে প্রচুর কথাবর্তা বলুন। গানটান করুন।’
এই ক’মাস ধরে ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলেছেন বাবা-মা। অবশেষে আজ তার ফল পেলেন। তবু মায়ের মন যেন একটু খুঁতখুঁত করে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু বাচ্চারা তো প্রথমে মা-বাবা বলে তাই না ?’
বাবা হেসে বলেন, ‘তার কোনো মানে নেই। আসলে তুমি মা ডাক শোনার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছ। তাই ওরকম ভাবছ। বাচ্চারা কিন্তু অনেক সময় কোনো মানে হয় না এমন সব আবোল-তাবোল শব্দ দিয়েও কথা বলা শুরু করে।’
তারপর দিন গুড্ডু সারাদিন কেবল ‘দাদা, দাদা’-ই করল। তারপরদিনও তাই। পরেরদিন, পরের পরেরদিন, টানা সাতদিন ‘দাদা’ ছাড়া অন্য কোনো কথা বা শব্দ গুড্ডুর মুখ থেকে বার হল না। মা হতাশ হয়ে পড়লেন। বাবা কিন্তু হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। উৎসাহ দিতে লাগলেন মাকেও। এভাবে কেটে গেল আরো কিছুদিন। গুড্ডু তখনো ‘দাদা’তেই আটকে আছে। তবে ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখে উৎফুল হয়ে উঠলেন বাবা-মা। মনের বিষাদ কাটিয়ে খুব হাসিখুশি হয়ে উঠতে লাগল গুড্ডু। বাবা-মা যে সব খেলনা, গাড়ি-টারি কিনে দিয়েছিলেন, এতদিন ও সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাত না। এখন সেগুলো নিয়ে খেলছে, হাসছে, নাচছে, ছুটোছুটি করছে। আর সমানে বলে চলেছে, ‘দাদা, দাদা, দাদা।’ বাবা মা বলাবলি করেন, ‘দেখো দেখো, গুড্ডুর কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, ও যেন সত্যিই ওর কোনো দাদার সঙ্গে খেলা করছে।’
সেদিন দুপুরে আচমকা মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। পাশে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি, আরে গুড্ডু কোথায় ? ও কি ঘুমের মধ্যে খাট থেকে পড়ে গেল ? ধড়ফরিয়ে খাট থেকে নেমে এলেন মা। না, গুড্ডু নেই। খাটের তলায় উঁকি মেরেও ওকে দেখা গেল না। ঘরের কোত্থাও নেই। খুব ভয় পেয়ে গেলেন। অবাকও হলেন। কেউ না ধরলে নিজে-নিজে খাট থেকে নামতে পারে না গুড্ডু। ঘরের চৌকাঠ পেরনো তো পরের কথা। তাহলে গুড্ডুর কি হল ? ভয়ে দুঃশ্চিন্তায় মায়ের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কাঁদতে-কাঁদতে ডেকে উঠলেন, ‘গুড্ডু-উ- উ।’
ঠিক তখনই বাগানের দিক থেকে গুড্ডুর হাসি শোনা গেল। ছুটে বাগানে চলে গেলেন মা। দেখেন টগর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মনের আনন্দে দুহাতে তালি দিতে-দিতে ঘুরে-ঘুরে নাচছে গুড্ডু। আর হাসছে খিলখিল করে। ওকে কোলে তুলে জাপটে ধরেন মা। আতঙ্কের গলায় বলে, ‘সোনা, তুই একা-একা খাট থেকে নেমে, ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে, বারান্দার দুখানা সিঁড়ি পেরিয়ে বাগানে চলে এলি কি করে ? যদি পড়ে যেতিস!’
ওপরের আর নিচের পাটির মাড়িতে সবে দুখানা করে কচি-কচি দাঁত গজিয়েছে গুড্ডুর। সেই দুধের দাঁতগুলো দেখিয়ে হেসে গুড্ডু বলল, ‘দাদ্দা।’
কাঁদতে-কাঁদতেই ওকে চুমো খেয়ে মা বলেন, ‘আর কখ্খনো এমন করে একা ঘর থেকে বেরোবে না বুঝেছ ? নাহলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব।’
অফিস থেকে ফিরে সব শুনে বাবা-মাকে বললেন, ‘এবার থেকে দুপুরে ঘরের দরজা বন্ধ করেই ঘুমোবে। এই বয়সের বাচ্চারা রোজই কিছু না কিছু শেখে। আর সেগুলোই বারবার করতে চায়। ওদের তো ভয় বোধ থাকে না। তাই বড়োদেরকেই সতর্ক থাকতে হয়।’
কিন্তু পরদিন দুপুরে ওদের আর ঘুম হল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে মা গুড্ডুকে নিয়ে যেই শুয়েছেন, ওমনি গুড্ডু কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে বায়নার কান্না। এটা-সেটা, খেলনা, পুতুল দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করলেন মা। কিন্তু ও শান্ত হল না। মা গল্প বললেন, গান শোনালেন। নাঃ তাও কিছু হল না। তাহলে হয়তো পেট ব্যাথা করছে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারবাবুর দেওয়া পেট ব্যথার ওষুধ খাওয়ালেন মা। কিন্তু গুড্ডুর কান্না বেড়েই চলল। মনে হচ্ছে ও যেন কি একটা বোঝাতে চাইছে। কিন্তু ও তো ‘দাদা’ ছাড়া কিছুই বলতে শেখেনি। মা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানারকম প্রশ্ন করছেন। কিন্তু ওর সেই একই উত্তর ‘দাদা-দাদা’। খুব অসহায় বোধ করছেন মা। ইস্ কবে যে গুড্ডু কথা বলতে শিখবে!
ক্রমশঃ গুড্ডুর গলায় জেদ বাড়তে লাগল। চিৎকার করে কাঁদছে ও। মুখ লাল হয়ে গেছে। গলার কচি শিরাটা মনে হচ্ছে ছিঁড়েই যাবে। মা অনেকরকমভাবে ওকে ভোলানোর চেষ্টা করছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। উল্টে এতক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করে গুড্ডুর গায়ে জ্বর এসে গেল। ওষুধ খাইয়েও জ্বর কমলো না। বরং বেড়েই চলল। খুব ভয় পেয়ে গিয়ে বাবাকে ফোন করলেন মা। বাবা শুনে বললেন, ‘চিন্তা কোরো না, বাচ্চাদের অনেকরকম অসুখ-বিসুখ হয়। আবার সেরেও যায়। ডাক্তারবাবু তো বিকেলে চেম্বারে থাকবেন। তুমি বরং ওকে নিয়ে রিক্সা করে ওখানে চলে যাও। আমিও অফিস থেকে চলে যাব। ডাক্তারবাবু টেস্ট করলেই বুঝবেন ওর কি হয়েছে।’
বাবার কথায় মা খানিকটা ভরসা পেলেন। তবু এতটুকু বাচ্চা একনাগারে এমন কাঁদলে মায়ের মনে তো কষ্ট হয়।
সময় মতো গুড্ডুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মা। রিক্সা করে যেতে-যেতে গুড্ডুর কান্না থেমে গেল। হয়তো রিক্সার দুলুনি, চারপাশের গাড়ি-ঘোড়া, লোকজন ওর ভালো লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেম্বারের সামনে পৌঁছে গেল রিক্সা। গুড্ডুকে কোলে নিয়ে রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিতে গেলেন মা। তখনই কাণ্ডটা ঘটল।
গুড্ডু কোনো দিন যা করে না, তাই করে বসল। খুব জোরে কামড় বসাল মায়ের কাঁধে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন মা। কাঁধ থেকে গুড্ডুর মুখটা সরাতে চেষ্টা করলেন এক হাত দিয়ে। ঠিক তখনই তাঁর মনে হল, হাত আলগা হয়ে যেতেই কে যেন কোল থেকে গুড্ডুকে ছিনিয়ে নিল। অথচ কাছাকাছি রিক্সাওলা ছাড়া কেউ নেই। সেও তো নিজের সিটে বসে আছে। গুড্ডু আনন্দে কলকল করছে, ‘দাদা দাদা।’ মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুড্ডু পৌঁছে গেছে বড়ো রাস্তায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর পিছনে হামলে পড়ল একটা লরি। মা আর্তনাদ করে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে একটানে সরিয়ে আনলেন গুড্ডুকে। আচমকা এমন ঘটনায় খুব ভয় পেয়ে গুড্ডু কেঁদে উঠল, ‘মা-আ-আ।’ ওকে বুকে জাপটে ধরলেন মা। ওর মুখে ‘মা’ ডাক শোনার জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু এমন অবস্থায় শুনলেন যে খুশি প্রকাশ করতে পারছেন না। ওদিকে লরিটা সরে যেতেই ওপাশ থেকে একটা আট-নয় বছরের ছেলেকে দেখতে পেলেন মা। ছেলেটা পিছন ফিরে ওঁদের দিকে দেখতে-দেখতে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, ওর চোখে জল। মা অবাক হয়ে ভাবছেন, ওকি গুড্ডুর এমন বিপদ হতে যাচ্ছিল বলে কাঁদছে ? কিন্তু ও কে ? মা তো ওকে কোনোদিন দেখেননি!
ইতিমধ্যে চারপাশ থেকে লোকজন হৈ-হৈ করে ছুটে এসেছে। তাদের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ছেলেটা। গুড্ডুকে কোলে নিয়ে মা তখনও রাস্তার ওপরে বসে আছেন। আতঙ্কে দিশাহারা। পাশেই ডাক্তারের চেম্বারে আরো অনেকের সঙ্গে বাবাও ছিলেন। গোলমাল শুনে সকলেই ছুটে বেরিয়ে এলেন। সব দেখে-শুনে বাবা বিরক্তি চেপে রাখতে পারলেন না। বলে উঠলেন, ‘ছেলেকে একটু সাবধানে রাখতে পারো না ?’
অসহায়ভাবে মা বলেন, ‘বিশ্বাস করো আমি সাবধানেই ছিলাম। কিন্তু কে যেন ওকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল।’
অনেকে মিলে একসঙ্গে জানতে চাইল, ‘কে লোকটা, কোনদিকে পালালো ?’
হতাশ মুখে মাথা নাড়েন মা, ‘আমি কাউকে দেখতে পাইনি।’
সেদিন রাতে গুড্ডুর আর জ্বর আসেনি। ডাক্তারবাবুর দেওয়া ওষুধ দরকার হল না। তবে বিকেলের ঘটনাটা ভুলতে পারেনি। একটু এদিক-ওদিক হলেই যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে যেত, সেটা বোধহয় ওইটুকু ছেলেও বুঝতে পারছিল। ভয়ে কাবু হয়ে আছে বেচারা। মা চোখের আড়াল হলেই ‘মা-মা’ করে কেঁদে ভাসাচ্ছে। বাবা-মায়ের কোল থেকে নামতেই চাইছে না। আঁকড়ে ধরে রাখছে ওঁদের গলা।
বাবা-মা কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না। শুধু ভেবেই চলেছেন, গুড্ডুকে মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিতে চাইছিল কে ? মা-বাবা, কাছে থাকা রিক্সাওলার চোখে সে পড়ল না কেন ? আরো আশ্চর্যের বিষয় গুড্ডুর ব্যবহার। ও হঠাৎ মাকে কামড়ালো কেন ? মাকে অসাবধান করে দেওয়ার জন্যই কি ? কিন্তু তাতে ওর লাভ কি ? তাহলে গুড্ডুও চাইছিল মাকে ছেড়ে যেতে! কিন্তু এত ভেবে কাজ করা ওর পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। তাহলে ওকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছিল ? ঘুরে ফিরে সেই প্রশ্নটাই সামনে এল, সে কে ?
যে আশ্রম থেকে গুড্ডুকে আনা হয়েছিল, পরদিন সকালেই ওকে নিয়ে সেখানে চলে গেলেন বাবা-মা। সেখানকার সুপার ম্যাডামের কাছে জানতে চাইলেন গুড্ডুর আসল পরিচয়। গুড্ডুকে অবশ্য আয়াদিদিদের জিম্মায় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে রেখে এসেছেন। খানিক চুপ থেকে সুপার ম্যাডাম বললেন, ‘দেখুন যেসব বাবা-মায়েরা এখান থেকে কাউকে দত্তক নেন, তাঁদের কখনই ওই বাচ্চাদের আগের পরিচয় জানানো হয় না। তাঁরা যাতে প্রথম থেকেই ওদেরকে নিজের সন্তান মনে করতে পারেন, তাই ওদের বিষয়ে সবকিছু গোপন রাখা হয়। কিন্তু কয়েকদিন ধরে আমি ভাবছিলাম, আপনাদেরকে বোধহয় সবকিছু জানানো উচিত। কারণ, আমার মনে হচ্ছে ওর সামনে খুব বিপদ।’
বাবা-মা চমকে উঠলেন কথাটা শুনে। তারপর আগেরদিনের ঘটনার কথা ম্যাডামকে বললেন। শুনে নিজের মনেই ম্যাডাম বলেন, ‘তারমানে ও আপনাদের কাছে পৌঁছে গেছে!’
‘কে, কার কথা বলছেন আপনি ?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুড্ডুর কথা বলতে শুরু করলেন সুপার ম্যাডাম, ‘গুড্ডু ওর বাবা-মা আর আট বছরের দাদার সঙ্গে থাকত টালিগঞ্জে। দাদা ওকে খুব ভালোবাসত। স্কুলে যাওয়া ছাড়া বাকি সবসময় ওকে নিয়ে থাকত। খেলা, গল্প করা, খাওয়া, ঘুমানো সব একসঙ্গে। মাসছয়েক আগে একদিন বাড়ির সবাই মিলে গাড়ি করে দীঘায় বেড়াতে যাচ্ছিল। হাইওয়েতে একটা লরি এসে মুখোমুখি ধাক্কা মারে ওদের গাড়িটাকে। গুড্ডুর বাবা-মা আর দাদা সঙ্গে-সঙ্গে মারা গেল। ওকে উদ্ধার করে পাঠিয়ে দেওয়া হল এই আশ্রমে।’
বাবা বলেন, ‘ তাই গুড্ডু প্রথমদিকে কোনো কথা বলতো না!’
‘হ্যাঁ, বাবা-মা আর প্রিয় দাদাকে হারিয়ে বলতে গেলে বোধটাই হারিয়ে ফেলেছিল বেচারা। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আবার বাবা-মায়ের ভালোবাসা পেলে ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আপনারা ওকে দত্তক নেওয়ায় আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আর শেষ রক্ষা হল না।’
‘একথা বলছেন কেন ? আমরা তো ওকে খুব ভালোবাসি। আমরা নিশ্চয়ই ওর আগের দুঃখ ভুলিয়ে দেব।’
‘সেই ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ওর বিপদটা অন্যদিকে।’
‘আপনি দয়া করে সব খুলে বলুন। না হলে ওকে বাঁচাব কী করে ?’
‘মাস দেড়েক আগে হঠাৎ আশ্রমের এখানে-সেখানে সাত-আট বছরের একটা ছেলেকে দেখা যেতে লাগল। কিন্তু কেউ ডেকে কথা বলতে গেলেই উধাও হয়ে যায়। শুনে আমি বিশ্বাস করিনি। বড়োদের ধমকে বললাম এসব বলে যেন ছোটোদের ভয় দেখানো না হয়। ক’দিন বাদে এই অফিসঘরে আমি নিজে দেখলাম ওকে। সন্ধের মুখে, অন্ধকার হয়নি তখনো। তবে আলো জ্বালানো হয়নি। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি, টেবিলের উপর ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে ছেলেটা। পিছনের আলমারির পাল্লা খোলা। চোর ঢুকেছে ভেবে আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ধরতে গেলাম ওকে। করুণ মুখ তুলে আমাকে দেখল ছেলেটা। তারপর চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। তখনই চোখে পড়ল টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় পড়ে আছে গুড্ডুর ফাইলটা। সব বুঝতে পারলাম আমি। গুড্ডুর খোঁজে ওর দাদা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ওইদিনের পর আর ওকে দেখা যায়নি।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন গুড্ডুর দাদাই কালকের ঘটনাটা ঘটাচ্ছিল ?’
‘হ্যাঁ, ভেবে দেখুন ওরাও কিন্তু লরির ধাক্কাতেই মারা গিয়েছিল। আর গুড্ডুর আচরণগুলো খেয়াল করলেই দেখা যায় দাদাকে ও দেখতে পাচ্ছিল। তাই কামড়ে দিয়ে মায়ের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ও দাদার কাছে চলে যেতে চাইছিল।’
‘ঠিক বলেছেন, দাদা-দাদা বলে আনন্দে লাফাচ্ছিল গুড্ডু।’ বলতে-বলতে উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মা, ‘আপনি বলছিলেন না, দেড় মাস আগে বেশ কয়েকদিন ওর দাদাকে এখানে দেখা গিয়েছিল! কিন্তু গুড্ডুর ঠিকানা পাওয়ার পরে আর ওকে পাওয়া যায়নি। তার কারণটা বোধহয় আমি বুঝতে পারছি। আসলে ও তখন আমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। গুড্ডু তার মানে ওকে দেখত। তাই হঠাৎ দুঃখ ভুলে হাসিখুশি হয়ে উঠল তখন থেকেই। সারাদিন শুধু দাদা-দাদা করে, অথচ ভুলে একবারও বাবা অথবা মা বলে না।’
‘বোঝাই যাচ্ছে দাদাই গুড্ডুকে আপনাদের আপন ভাবতে দিচ্ছে না। আপনাদের থেকে ছাড়া-ছাড়া থাকলেই গুড্ডুকে নিয়ে যেতে ওর দাদার সুবিধে।’
বাবা বলে ওঠেন, ‘তার মানে সেদিন গুড্ডু একা-একা বাগানে চলে যায়নি। ওর দাদাই নিয়ে গিয়েছিল!’
মা শিউরে উঠলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি, কাল তাহলে ওকেই কাঁদতে-কাঁদতে চলে যেতে দেখেছি। ভাইকে না পাওয়ার দুঃখেই কাঁদছিল বোধহয়।’
এরপর থেকে বাবা-মা গুড্ডুকে খুব সাবধানে রাখতে লাগলেন। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করেন না। দেখতে-দেখতে অনেক দিন, অনেক মাস কেটে গেল। গুড্ডু এখন বাবা-মা, কাকা-কাকি, ফুল-পাখি অনেক কথা বলতে পারে। তবে সেই দুর্ঘটনার পর থেকে একবারও ‘দাদা’ বলেনি।
এখন গুড্ডুকে নিয়ে প্রায়ই এখানে-ওখানে যান বাবা-মা। কিন্তু বাড়িতে বা বাইরে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা আর ঘটে না। বাবা-মা কখনো-কখনো ব্যাপারটা বলাবলি করেন। মা বলেন, ‘সেদিন ছেলেটা গুড্ডুকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েই বোধহয় কাঁদতে কাঁদতে একেবারে চলে গেল, তাই না ?’
বাবা বলেন, ‘এমনও হতে পারে গুড্ডু যেই মা বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, সেই মূহূর্তে ও আমাদের হয়ে গেল। ওর দাদাও বুঝে গেল ও আর কোনোদিন গুড্ডুকে ছুঁতে পারবে না। তাই চলে গেল।’
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২
অলংকরণ- অমর লাহা
0 মন্তব্যসমূহ