![]() |
কাল থেকে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ে চলেছে বৃষ্টির
ধারা। তার উপর মাঝে-মাঝে বিদ্যুতের ঝলক আর মেঘের গর্জন। সেই গর্জনে বুকটা চড়াৎ করে
উঠে অনেক্ষণ ওঠা-নামা করে। মাঝে-মধ্যে দমকা বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ছটা ঢুকে পড়তে
চায় দাওয়ায়। ঢুকতে পারে না। পলিথিনের ঝাঁপে আটকে যায়। সেখানে আওয়াজ তোলে।
মজা লাগে ছেলেটার। আগে কখনো এভাবে বৃষ্টি দেখেনি সে। থাকে তো শহরে। ফ্ল্যাটে। সেই চার দেওয়ালের মধ্যে জীবন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা পায় আধখানা আকাশ। দু-চার ফোঁটা বৃষ্টি। তবে স্কুলে যাওয়ার পথে দেখেছে রাস্তায় জমে থাকা এক হাঁটু জল। তার কাছে বর্ষাকাল তেমনভাবে ধরা দেয়নি।
হঠাৎ দাদু অসুস্থ হওয়াতে মা ওকে নিয়ে এসেছে মামার বাড়ি। দাদুকে দেখতে। স্কুল-টেস্ট হয়ে গেছে। সে কারণে দু-চারদিন থাকবে। মামার বাড়ি আসতে এবং থাকতে রাজার ভালো লাগে। সারা দিন ভুলোদার সঙ্গে খেলা-ধূলা করা যায়। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো যায়। বেশ আনন্দে কাটে। ভুলোদা ওকে খুব ভালোবাসে। সব সময় সঙ্গে থাকে। ওকে পেয়ে সেও খুব খুশি। দুজনের খুব ভাব।
সুন্দরবনের মাতলা নদীর চর থেকে কিছুটা দূরে মামার বাড়ি। চারিদিকে গাছ-গাছালি। মাটির বাড়ি। খড়ের চাল। পিছনে বাঁশঝাড়। সব সময় ক্যাঁচর-কোঁচর শব্দ হয়। সন্ধে থেকে সে শব্দ বাড়ে। এখনো এখানে ইলেক্ট্রিক আসেনি। হ্যারিকেন ও কেরোসিন ল্যাম্পের আলো। সেই আলো-আঁধারী পরিবেশে কেমন যেন ভয়-ভয় করে। তার উপর বৃষ্টি। সে যেন এক ভৌতিক পরিবেশ। তাই সে সব সময় ভুলোদার পাশে-পাশে থাকে। মামারবাড়ির আশে-পাশে যেন গল্পে শোনা ভূতগুলো ঘুরে বেড়ায়।
রাজা এইটে পড়ে। বড়ো হয়ে উঠছে। তবু যেন সন্ধ্যার পর ভূতের ভয় মন থেকে তাড়াতে পারে না। আবার সে শুনতে ভালোবাসে ভূতের গল্প। এদিকে আবার সকাল হলে তাকে ধরে কে! ভুলোদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে মেঠো পথ ধরে মাঠের দিকে। ধানক্ষেতের দিকে। ভুলোদা ঘুনি ঝেড়ে মাছ বার করে। সেগুলো ধরে-ধরে মাটির হাঁড়িতে রাখে। কত মাছ। কতরকমের মাছ।
একটা অ্যাকোরিয়াম আছে রাজার। তাতে অনেকরকমের মাছ আছে। তাদের সে নাম জানে। কিন্তু, ভুলোদা যে মাছগুলো ঘুনি ঝেড়ে-ঝেড়ে বার করে, তাদের নাম জানে না। তবে ভুলোদার কাছ থেকে জেনে নেয়। কোনটার কি নাম। কয়েকটা মাছে হাত দিতে বারণ করে। কারণ, কিছু মাছের কাঁটা আছে। ফুটে গেলে যন্ত্রণা হবে। সেগুলো ভুলোদাই হাঁড়িতে তুলে রাখে।
মাছ নেওয়া হয়ে গেলে হাঁটা দেয় বাড়ির পথে। দুজনের মাথায় তালপাতার সারসি। সকালের দিকেও ঝিরঝির করে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে চলছে ঝোড়ো বাতাস। এখানকার বেশিরভাগ লোক বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় সারসি দেয়। ছাতা নেই বললেই চলে। তবে সারসি মাথায় দিয়ে হাঁটতে রাজার বেশ ভালো লাগে। মাথা থেকে পিছনের দিকে পা পর্যন্ত প্রায় ঢাকা পড়ে যায়।
কিসের একটা শব্দ শুনে ভুলোদা দাঁড়িয়ে পড়ল। কি যেন বোঝার চেষ্টা করে। ভুলোদা জানে কোনটা কিসের শব্দ। কোনটা সাপে ব্যাঙ ধরার শব্দ। কোনটা ঝিঁঝিঁর শব্দ। কোনটা সোনা ব্যাঙের, কোনটা কুনো ব্যাঙের। কোনটা কোন পাখির ডাক। কয়েক মিনিটের মধ্যে জানাল, ঝোপের মধ্যে কোন পাখির ছানার শব্দ। ঝোপের উপর দিয়ে একটা পাখি উড়ছে আর ডাকছে। তার বুঝতে অসুবিধা হল না ঝোড়ো বাতাসে পাখির বাসা ভেঙে পাখির ছানাগুলো পড়ে গেছে ঝোপের মধ্যে। আর মা পাখি তাদের তুলতে না পেরে কাঁদছে।
রাজাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভুলোদা ঝোপ-ঝাড় থেকে বার করে আনলো পাখির ছানাগুলো। পাখির বাসার মতো একটা বাসা তৈরি করে গাছের দুটো ডালের মাঝখানে রেখে দিল যাতে বাসাটা সেখান থেকে আর পড়ে না যায়। যেখানে জল না পড়ে। তারপর ছানাগুলোকে সেই বাসায় তুলে দিল। যেখানে মা পাখি ছানাদের খাওয়াতে পারে। ডানা দিয়ে আড়াল করে রাখতে পারে।
ভুলোদাকে রাজা দেখে আর ভাবে। যে ছেলেটাকে কেউ ভালোবাসে না। সে কিভাবে ভালোবাসতে জানে অন্যদের। গাছ-পালা, পশু-পাখি-প্রজাপতিদের। যে স্কুলের পড়া ভুলে যায় বলে নাম হয়ে গেছে ভুলো। অথচ, সে তো মনে রাখতে পারে মাছেদের নাম। পাখিদের নাম। গাছ-গাছালির নাম। ফুলেদের নাম। ভূতের গল্প। রূপকথার গল্প। গ্রামের পাঁচালি গান। রামায়ণী সুর। রামলীলার গান।
ভুলোদার সঙ্গে মেঠো পথ ধরে জল-কাদা মেখে হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে। বেশ তো সব মনে রাখে। তবে সকলে ভুলো বলে ডাকে কেন! কেন তাকে এক ক্লাসে বার-বার থাকতে হয়! ওর তো একটা ভালো নাম আছে! সে নাম ধরে কেউ ডাকে না কেন! রাজা জানতে চাইল ভুলোদার ভালো নামটা। তার উত্তরে পেল, সে নামে তো কেউ তাকে চেনে না। অতএব সে নাম জেনে আর কি হবে। শুনে রাজার দু-চোখ থেকে নেমে এল বর্ষার জল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ