Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

রিন্টি ও ম্যাজিশিয়ান- সুমন মাইতি



গত কয়েকদিন থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজও সকাল থেকে একইরকমভাবে ঝরে চলেছে।

রিন্টির মর্নিং স্কুল। অন্যদিন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যেতে বড্ড একঘেয়েমি লাগে রিন্টির। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ওর মনটা বেশ চনমনে। কারণ আজকে ইস্কুল হবার পর ওদের রেনি ভ্যাকেশন শুরু হয়ে যাবে। স্কুলের শেষ দিনে আজ নাকি আবার এক ম্যাজিশিয়ান আসবে, ওদের ম্যাজিক দেখাতে। রিন্টি তাই স্কুল বাসে চেপে স্কুলে চলে আসে। স্কুলে গিয়ে সে দেখে যে হলঘরের মঞ্চটাকে চমৎকারভাবে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। রিন্টির বয়স সবে ছয়। এর আগে সে কোনোদিন ম্যাজিক দেখেনি। সে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছে যে, ম্যাজিশিয়ানরা নাকি খুব চালাক হয়। আর জাদুবলে তারা সবকিছু করতে পারে।

ঝলমলে পোশাক পরে, টুপি মাথায় আর হাতে একটা ম্যাজিক স্টিক নিয়ে ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাতে ওঠেন মঞ্চে। সবাই তাকে দেখে হাততালি দিতে শুরু করে। কখনো তিনি একটা বল উপরে ছুঁড়ে দিয়ে ভ্যানিস করেন। কখনো আবার রুমালকে জাদুবলে ফুল বানিয়ে দেন, আবার তাঁর ফাঁকা ঝোলাটি থেকে চকলেট বের করে সবাইকে দেন। রিন্টিরা আনন্দে হাততালি দিতে থাকে।

বাড়ি ফিরে রিন্টি মাকে জিজ্ঞেস করে, মা, ম্যাজিশিয়ানরা থাকেন কোথায় ? রিন্টির মা বুঝতে পারে যে, তার ম্যাজিকের ঘোর এখনো কাটেনি। তাই তার সঙ্গে মজা করার জন্য বলে, ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে থাকেন।

-মা, ম্যাজিক পাহাড় কোথায় ? আমি সেখানে যাব!

-সেখানে তুমি যাবে কিভাবে ? সে হল অনেক দূরে! সেখানে যেতে হলে বড়ো একটা নদী পার হতে হয়! সেখানে তুমি যেতে পারবে না!

রিন্টির কেমন যেন জেদ চেপে গেল। সে সেখানে যাবেই, সেখানে যাবার জন্য সে মায়ের কাছে কাঁদতে লাগল। রিন্টির মা তো কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারে না।

রিন্টি এবার ভাবল, বর্ষাকালে তো তাদের শহরের রাস্তাঘাট সব জলে ডুবে যায়। সেই সময়ে সে যদি জল থইথই রাস্তা দিয়ে একটা নৌকা নিয়ে ভেসে-ভেসে বড়ো নদীটার কাছে পৌঁছতে পারে, তাহলে সে নদীটা পার হয়ে ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যেতে পারবে।

রিন্টি তাই মনে-মনে বলতে থাকে, যেন প্রচুর জোরে বৃষ্টি হয়, সব রাস্তাঘাট যেন জলে ডুবে যায়।

পরদিন সকাল থেকে জোরে বৃষ্টি নামে, আর সারা শহরের রাস্তা ডুবে যায়। রিন্টির খুব আনন্দ হয়। সেভাবে এইভাবে, এইবার সে নৌকাতে চেপে ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু নৌকা পায় কোথা থেকে। সে মায়ের কাছে গিয়ে বলে, মা আমাকে একটা নৌকা এনে দাও না! আমি ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাব।

মা বকুনি দিয়ে বলে, ম্যাজিক দেখে তোর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে! যাঃ পড়তে বোস।

রিন্টি দেখল, যে উপায় নেই। সে তাই একটা কাগজের নৌকা করে জলে ভাসিয়ে দিয়ে বলল, যা তুই ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যা।

সন্ধেবেলা মা তাকে পড়াতে বসালে তার পড়াতে মন থাকে না। সে ম্যাজিক পাহাড়ের দেশের কথা ভাবতে থাকে। তার নৌকাটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই সেখানে পৌঁছে গেছে। অন্যমনস্ক দেখে মা তাকে বকুনি দেয়।

রাত্রিতে বিছানাতে শুয়ে রিন্টি আবার ভাবতে থাকে। ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে সবাই ম্যাজিক জানে। সেখানে সে যদি যেতে পারত সেও তাদের কাছ থেকে ম্যাজিক শিখতে পারত। আর তারপর সে যা খুশি করতে পারত। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাবার জন্য মায়ের বকুনি খেতে হত না। আন্টিকে এ,বি,সি,ডি মুখস্ত বলতে হত না। ভাবতে-ভাবতে রিন্টি কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতে হঠাৎ একটা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। বলছে, রিন্টি বাইরে এসো। যেন কেউ আদর মাখানো গলায় বলছে, ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাবে না ? এ-এ-সো-

ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাবার কথা শুনে রিন্টি বিছানা থেকে উঠে মা-বাবার অজান্তে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে বারান্দায় আসে। দেখে খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাটা জলে ডুবু-ডুবু। বারান্দার সামনে জল এসে গেছে। বারান্দার সামনের জলে ভেসে আছে তার ভাসিয়ে দেওয়া কাগজের নৌকাটা। কিন্তু কাগজের নৌকার ওপর কি ওঠা যায়! রিন্টি তার ঘুম চোখ দুহাত দিয়ে একবার রগড়ে নিল। দেখতে পেল একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে নৌকাটার ওপর। ছোটো একটা মানুষ। নৌকাটার সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। এত ছোটো আকারের মানুষও হয় তাহলে! রিন্টির যেন ঘোর কাটছিল না, সে বারান্দার সামনে ঝুঁকে ভালো করে দেখতে থাকল। হ্যাঁ, একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তার কাগজের ছোটো নৌকাটার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ে ঝলমলে পোশাক, মাথায় একটা পাগড়ীওয়ালা টুপি, হাতে একটা ছোটো সরু লাঠি। রিন্টির মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন তিনি। আশ্চর্য এক ভালোবাসা মাখানো গলায় তিনি বললেন, ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাবে না ? আমি ম্যাজিক পাহাড়ের দেশেরই এক ম্যাজিশিয়ান। তোমার পাঠানো নৌকাতে করে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

রিন্টি কি একটা বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার কথাটা যেন মুখ থেকে বেরল না। খানিকটা ইতস্তত করে সে বলল, এইটুকু কাগজের নৌকাতে আমি উঠি কেমন করে!

ম্যাজিশিয়ান বললেন, ওটা কোনো ব্যাপার নয়। এসো ঠিক যেতে পারবে।

রিন্টির এবার হাসি পেল। বলে কি লোকটা। ওইটুকু কাগজের নৌকোতে চেপে বসলে বারান্দার সামনে রাস্তার ওই এক কোমর জলে নির্ঘাত নৌকা সমেত সে ডুবে যাবে।

-এসো! তিনি ডাকলেন।

-কিন্তু বারান্দার গেটে তো চাবি দেওয়া। যাবো কি করে!

এইবার ম্যাজিশিয়ান তাঁর হাতের লাঠিটা তুলে বারান্দার গ্রিলের ভেতর দিয়ে গলিয়ে রিন্টির গায়ে ছোঁয়ালেন।

কেমন এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে গেল রিন্টির গায়ে। মুহূর্তের মধ্যে ছোটো হয়ে গেল। রিন্টি তার নিজের দিকে বারবার দেখল। এখন সে যেন তার খেলার পুতুলটার মতো হয়ে গেছে। রিন্টি এবার ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকাল, দেখল, তাঁর চোখে-মুখে স্নিগ্ধ হাসি। সে এবার সহজেই বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে গলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর নৌকাতে চেপে বসল।

বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ আশ্চর্য যে রিন্টির গায়ে তার ছিটেফোঁটাও লাগছে না। আর তার কাগজের নৌকাও কোনোরকম নড়াচড়া না করেই তরতর করে সামনে এগিয়ে চলেছে। নিজের তৈরি নৌকোতে চেপে রিন্টি তো ভীষণ আনন্দিত ও বিস্মিত।

-আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান তুমি ইচ্ছে করলেই যা খুশি করতে পারো ?

-তা পারি বৈকি! তা নাহলে তুমি এভাবে যেতে পারতে! ম্যাজিশিয়ান হেসে আরো বলল, শুধু আমি না, আমাদের দেশে সবাই তাদের ইচ্ছেমতো যা-খুশি করতে পারে। তবে তারা কেউ কারো ক্ষতি করে না। সবাই সবাইকে ভালোবাসে।

-আচ্ছা সত্যিই কি সেখানে কোনো ম্যাজিক পাহাড় আছে ?

-নিশ্চয়ই আছে। সেই পাহাড়ই তো আমাদের সব। সেই পাহাড় ছুঁয়ে তুমি যাকিছু চাইবে সব পেতে পারো। এই যে আমার হাতে যে জাদুকাঠি দেখছ এটা সেখান থেকেই কুড়িয়ে এনেছি। চল না সেখানে গেলেই সব বুঝতে পারবে।

ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে রিন্টির ভাব জমে উঠেছে। নৌকা ভাসতে-ভাসতে এবার রাজপথের এপর থামল। রাজপথ জলে ডুবে গেছে। রিন্টির মনে হচ্ছিল, তাদের নৌকো কোনো নদীর ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।

-জানো ম্যাজিশিয়ান, আমাদের শহরের লোকেরা না বড্ড পাজি। তারা যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলে রাস্তাঘাট নোংরা করে। আমাদের স্কুলের আন্টি বলেন, বর্ষাকালে সেইসব ময়লা-আবর্জনাতে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায় বলে রাস্তাঘাট এরকম জলে ডুবে যায়।

-একদম ঠিক বলেছ। ম্যাজিশিয়ান মাথা নেড়ে রিন্টির কথায় সায় দিলেন।

রাজপথ জুড়ে হালকা অন্ধকার। লোডশেডিং চলছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের দাপটও বেড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে ফ্ল্যাটগুলো এখুনি ভেঙে পড়বে। রিন্টি এবার ভয় পায়, যদি তাদের নৌকো উল্টে যায়! কিন্তু না, তাদের নৌকো অদ্ভুত জাদুবলে একইভাবে এগিয়ে চলেছে। অজস্র আবর্জনা ভেসে চেলেছে জলের ওপর দিয়ে। রাস্তার ধারের গাছগুলো মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। রিন্টির মনে পড়ে গেল, আন্টি ক্লাসে একদিন বলেছিলেন, একটি গাছ একটি প্রাণ। আরো বেশি করে গাছ লাগাতে হবে আমাদের। তাই এভাবে গাছ ভেঙে পড়তে দেখে খুব কষ্ট হল তার। সে ম্যাজিশিয়ানকে বলল, ম্যাজিশিয়ান তুমি গাছগুলো বাঁচিয়ে দাও। গাছ ছাড়া আমরা কেউ বাঁচব না।

রিন্টির কথা মতো ম্যাজিশিয়ান তাঁর জাদু লাঠিটা গাছেদের ডালে ছোঁয়াতে লাগলেন, আর কি আশ্চর্য! সঙ্গে-সঙ্গে গাছগুলো সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল, যেন কিছুই হয়নি। ঝড়ও আস্তে-আস্তে কমে যেতে থাকে।

রিন্টিদের নৌকো এবার একটা ফ্লাইওভারের নিচে এল। ফ্লাইওভারের নিচে কোমর জলে ফুটপাতে থাকা মানুষজন ছুটোছুটি করছে একটু বাসস্থানের আশায়। রিন্টির এবার খুব কষ্ট হল। এই ঝড়-বৃষ্টিতে ওদের কত কষ্ট, থাকার একটু জায়গা নেই। অথচ অন্যরা এখন নিজেদের সুন্দর ঘরে নিশ্চিন্তে আছে। নৌকা আরেকটু এগোতে রিন্টি দেখতে পেল, দূরের স্ট্রীট লাইটটার নিচে সিমেন্টের বেদীতে শুয়ে আছে একটি শিশু আর সে চিৎকার করে কাঁদছে। তার আশেপাশে কেউ নেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেদীটা জলে ডুবে যাবে। তখন ওই বাচ্চাটাও যদি ডুবে যায়!

রিন্টি এবার কেঁদে ফেলল। বলল, ম্যাজিশিয়ান আমি ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যেতে চাই না। তুমি শহরের পথ-ঘাট থেকে সব জল ঝরিয়ে দাও।

-সত্যিই তুমি ম্যাজিক পাহাড়ে যাবে না ?

-না, আমি যেতে চাই না।

-বেশ। এই বলে ম্যাজিশিয়ান তাঁর জাদুলাঠিটা রাস্তার ওপর ঠেকালেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে রাস্তার জল কমতে থাকল। যেই বেদীটার এপর শিশুটা শুয়েছিল সেটার চারপাশ থেকেও জল কমে যেতে লাগল।

ম্যাজিশিয়ান বললেন, চলো সব জল শুকিয়ে আসার আগে আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিই।

কাগজের নৌকো করে বাড়ি ফিরে এসে রিন্টি আবার বারান্দার গ্রিল গলে ভেতরে ঢুকল। তারপর ম্যাজিশিয়ান জাদুলাঠিটা তার গায়ে ঠেকাতে সে আবার আগের মতো হয়ে গেল।

ম্যাজিশিয়ান অল্প হেসে রিন্টিকে বললেন, তুমি কাল বলেছিলে, বৃষ্টির জলে সারা শহর যেন ডুবে যায়, অথচ দেখলে তো বৃষ্টিতে শহর ডুবে গেলে মানুষ কষ্ট পায়। কত গাছপালা ভেঙে যায়। এতে পরিবেশের কত ক্ষতি হয়। আর কোনোদিন ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাবার জন্য বায়না করবে না। কেমন।

-না, আমি আর কখনো ম্যাজিক পাহাড়ের দেশে যাবার জন্য কাঁদব না।

-তাহলে আমি এবার আসি। এই বলে ম্যাজিশিয়ান কাগজের নৌকো চেপে চলে গেল। রিন্টি হাত নেড়ে তাঁকে বিদায় জানাল।

ম্যাজিশিয়ান চলে যাবার পর রাস্তার সব জল শুকিয়ে গেল। রিন্টি নিঃশব্দে বাবা-মার পাশে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ