Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

চোর ধরবে চেঙ্গিস খান ।। শুভজিৎ বরকন্দাজ



ক্লাস ফাইভের সি সেকসানে চোরের উপদ্রবে শেষ পর্যন্ত আমাদের টেকা দায় হয়ে উঠল। বলা নেই কওয়া নেই ব্যাগের ভেতর থেকে জলজ্যান্ত টিফিনগুলোই হাফিস হয়ে যাচ্ছিল প্রতিদিন। প্রতিদিনই এক টিত্তির। যেই না বাক্স খুলেছি দেখি, বাক্স পড়ে- টিফিনটাই কেবল চিচিং ফাঁক।

কাল হাপিস হয়েছিল পল্টুর। পরশু গিয়েছিল বীরেশ্বরের। আর আজকেরটা তো বিজয় পাল সিং এর। কোনো কোনো দিন একাধিক চুরিও হচ্ছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! এমন যন্ত্রণা! সকলেরই নজর কড়া। তবু সেই তিন পিরিয়ডের পরে গিয়ে ব্যাস, টিফিন হাওয়া। তবে কি ভুতে খেয়ে যাচ্ছে টিফিনগুলো!

আমাদের ক্লাস মনিটর গোকুল। সবাই এবার গোকুলকেই ধরলাম। গোকুলের খুব ভূতের ভয়। আমরা বলতেই ও তুতলে বলল, ও-ও-ওরে বাবা, ভু-ভু-ভুতের সঙ্গে আ-আ-আমি কি পা-পা-রি! আমরা ধমক দিয়ে বললাম, ধ্যাৎ-তেরিকা! তোকে কি ভূতের সঙ্গে লড়াই করতে বলছি, তুই গিয়ে স্যারদের কাছে রিপোর্ট কর না। গোকুল গোবেচারা গিয়ে স্যারদের কাছে রিপোর্ট করল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। তারা তো পাত্তাই দিল না কেবল বললেন, নিজেদের টিফিন নিজেরা দেখে রাখতে পারিস না, আমরা কী তোদের টিফিন পাহারা দেব ? যা এখান থেকে।

গোকুল মুখ কাঁচুমাচু কের ফিরে এল। আমরা খুব নিরাশ হলাম। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকছি, কাল কারটা যাবে কে জানে!

পরেরদিন শুভ্র পাইকের বাক্স ফাঁকা। একটা জিনিস আশ্চর্য হয়ে দেখছি চোরের পছন্দ কেবল য্যুৎসই খাবারগুলোর দিকেই। যাদের ব্যাগে রুটি-তরকারি, কি চানাচুর-মুড়ি থাকবে চোর সেদিকে মাথাও গলাবে না। কিন্তু যাদের ব্যাগে ডিম-টোস্ট, অমলেট-কারি কিংবা ম্যাগি-নুডুলস চোরের লক্ষ্য সেই গুলোই। দিব্যি সুড়ুৎ করে কোনফাঁকে যে সেটাকে সাবড়ে দিয়ে যাবে, তা কারোর ঠাকুরদাও টের পাবে না। কি যে জ্বালা। চোরের জ্বালায় আমরা একটু ভালো-মন্দ খেতেও পারব না!

অনেক ভেবে চিন্তে শেষটায় আমরা খুব সাহস করে সবাইমিলে গিয়ে ধরলাম আমাদের গেম স্যারকে। কাল খেলার পর আমরা আমাদের জার্সি ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম আর রুম পরিস্কার থাকায় এ সপ্তাহে আমরা ফার্স্ট হয়েছি বলে, গেম স্যার আমাদের বকলেন না। গালে হাত দিয়ে মনোযোগ সহকারে আমাদের কথা শুনলেন। তারপর চিন্তিত মুখে বললেন, বলিস কি রে রোজ-রোজ চুরি করে খায় ?

-হ্যাঁ স্যাররো- ও- জ। আমরা সকলে সুর করে কাঁদো কাঁদো মুখে বললাম।

গেম স্যার মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, এটা তো মোটেই ঠিক কাজ নয়। ভুতের মোটেই এটা উচিত হচ্ছে না। তোরা এইটুকুন টুকুন দুধের পোলাপান, তোগো টিফিন কিনা ভূত চুরি করে খাবে! এটা মোটেই ভালো কাজ নয়। ঠিক হ্যায়, আজকেই আমি তোদের ক্লাসে যাতা হ্যায়। দেখতা হ্যায চোর ক্যায়সে তোদের টিফিন খাতা হ্যায়। সমঝ গিয়া না- আব তুম লোগ ক্লাসমে যাও। স্যার কোনো কাজে উৎসাহ পেলে এমন হিন্দি, বাঙাল ভাষা যা মনে আসে সেই ভাবে কথা বলেন।

আমরা খুব খুশি হয়ে ক্লাসে ফিরে এলাম। ছয় পিরিয়ডে গেমস স্যার আমাদের ক্লাসে এলেন। এসেই আজকে যাদের টিফিন চুরি গেছে তাদের কথা মন দিয়ে শুনলেন। সব শুনে টেবিল চাপড়ে স্যার বললেন, আামি বলা তো চোর জরুর পাকড়া যায়েগা। চোর ইসি ঘরমে হ্যায়।

আমরা এ- ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। স্যার বলে কি! চোর আমাদের ক্লাসেই! তাই আবার হয় নাকি! আমাদের ঘরের চোর হলে তো আমরাই ঠিক চোর ধরে ফেলতাম। হঠাৎ স্যার আবার টেবিল চাপড়ে বললেন, চেঙ্গিস খান।

আমাদের সকলে চোখের বৃষ্টি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল ভজনের দিকে। কারণ গেম স্যার ভজনকেই চেঙ্গিস খান বলে ডাকেন। তবে কি শেষ পর্যন্ত ভজন!

ভজন ঢোঁক গিলে উঠে দাঁড়াল। গলার নালী ছুঁয়ে বলল, মা কালীর দিব্যি স্যার, বিদ্যা ছুঁয়ে বলছি স্যার, আমি টিফিন চুরি করিনি। আপনি বলুন, আমি কি টিফিন চুরি করতে পারি ?

স্যার চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ালেন। আর ইশারা করে ভজনকে কাছে ডাকলেন। ভজন কাকুতি-মিনতি করতে-করতে স্যারের টেবিলের দিকে মা কালীর দিব্যি স্যার, বাবা লোকনাথের দিব্যি স্যার,বলতে- বলতে এগোলো।

আমরা সবাই হো-হো করে হাসছি। স্যার আবার এক  রাম থাবড়া দিলেন টেবিলে আর বললেন, চুপ রহো! সবলোগ শুনো, চোর ধরবে চেঙ্গিস খান। এবার ভজনের দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন, কি ঠিক বললাম না ?

আমরা সবাই আবার হো হো করে হেসে উঠলাম। চেঙ্গিস খানের মুখেও হাসি ফুটল। কয়েকজন তখন সুর করে ছড়াও কাটল, চোর ধরবে চেঙ্গিস খান...

পরদিন ফাস্ট পিরিয়ডের আগে আমাদের ক্লাস টিচার শ্রাবণী ম্যাডাম তখনো ক্লাসে আসেননি। আমরা সবাই হই-হট্টগোল করছি। এমন সময় চেঙ্গিস খান বইয়ের ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে ঢুকল ঘরে। ঢুকেই টেবিলে এক চাপ্পড় মেরে সবাইকে চুপ করাল। তারপর চেঙ্গিস খানের মতোই হাব-ভাব নিয়ে বলল, সবাই শোন, স্যার আমাকে একটা বিরাট দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই আজ থেকে যে যা টিফিন আনবি, সব আমাকে আগে থেকে দেখিয়ে রাখবি এই বলে দিলাম।

আমরা চেঙ্গিস খানের কথায় রে-রে করে উঠলাম।  ইস-স মামার বাড়ির আবদার! কে রে তুই আব্দুল মাঝি! তোকে টিফিন দেখাতে যাব কোন দুঃখে শুনি!

তখন চেঙ্গিস শান্ত গলায় বেশ ধৈর্য্য ধরে আমাদের বোঝালো। ব্যাগ, চোর তো রোজ ভালো-ভালো টিফিনগুলোই খায়, তাই আমি যদি আগে থেকে একবার জানতে পারি তবে আমার চোর ধরা কেউ আটকাতে পারবে না বুঝলি ? কারণ চোরকে তো আমি তখন চোখের পাতায়-পাতায় রাখব।

-কেন রে ব্যাটা, তুই কি চোর নাকি ? পল্টুর কথায় আমরা হেঁসে উঠলাম। চেঙ্গিস খান তো প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তক্ষুনি স্যারকে বলতে যায় আর কি! আমরা কজন মিলে ওকে শান্ত করলাম। ও এবার এক-এক করে সবার টিফিন বক্স চেক করে নিরস মুখের পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসল।

আমাদের তিন পিরিয়ডে কম্পিউটার ক্লাস। নতুন কম্পিউটার এসেছে স্কুলে। তাই আমাদের আগ্রহটা ওটার প্রতি একটু বেশিই। তারওপর কম্পিউটার টিচার পিনাকি স্যার বলেছেন আজ কম্পিউটারে গেম খেলাবেন। দ্বিতীয় ক্লাস শেষ হতে না হতেই তাই সবাই পড়িমড়ি করে দৌড় লাগিয়েছি কম্পিউটার রুমে। মাত্র তো দুখানা কম্পিউটার, তাই যে আগে যাবে তার সিট আগে।

কম্পিউটার রুমে সবাই আমরা গেম নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ তখন গেম স্যার ঢুকলেন ওই রুমে। তলব করলেন, কইরে চেঙ্গিস খান ? কাঁহা গয়া চেঙ্গিস খান ? চোর ধরা পড়ল ? গোকুল, স্যারকে জানাল, চেঙ্গিসের পেটে ব্যথা করছে, তাই সে কম্পিউটার না করে ক্লাসে গিয়ে বসে আছে।

গেম স্যার এবার ভ্রু কোঁচকালেন। বটে! কই চল তো দেখি। হঠাৎ আমরা সবাই নতুন উৎসাহে কম্পিউটার ছেড়ে স্যারের পিছু নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার একদম শেষমাথার ঘরটাই আমাদের। রীতিমতো প্যারেড করতে-করতে আমরা ঘরের সামনে পৌছালাম। দেখি দরজা ভেজানো।

গেম স্যার এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমরাও থমকে গেলাম। তারপর ক্লাসের শেষ বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ও হরি! বেঞ্চে আট-দশটা টিফিন বাক্স সাজিয়ে দিব্যি দুপুরের ভোজন সারছে চেঙ্গিস খান।

পাঁচ-ছটা বাক্স ততক্ষনে খালি হয়ে গিয়েছে। এরমধ্যে আমার টিফিন বাক্সটা দেখে বুকের মধ্যে ছ্যাঁক করে উঠল। কালই বর্ধমান থেকে আমার ছোটোমামা এসেছে সীতাভোগ আর ল্যাংচা নিয়ে। সেটাই ছিল আমার আজকের সাধের টিফিন। হামলে গিয়ে পড়লাম। সীতাভোগের নাম -গন্ধও নেই, কেবল দেখি আমাদেরকে দলবল সমেত জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখে হাঁ হয়ে থাকা চেঙ্গিস খানের মুখে তখনো কিছুটা আটকে রয়েছে ছোটমামার আনা আমার অতি সাধের শক্তিগড়ের ল্যাংচা।

সেই লজ্জায় ভজন প্রায় দিন ১৫   স্কুল মুখো হয়নি। এরমধ্যে গেম স্যারকে খুঁচিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, চেঙ্গিস  খানই যে টিফিন হাফিস করে দেয় সেটা আপনি এত সহজে ধরলেন কি করে ? আর ওকেই চোর ধরার কথা বললেন কেন ?

স্যার বেশ বুক ফুলিয়ে বলতে শুরু করলেন, তোরা যেদিন প্রথম আমায় টিফিন হাফিসের কথাটা বললি, উসি দিন আমি তোদের ক্লাসমে গিয়া থা, ইয়াদ হ্যাঁয় না ?

আমরা সবাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। স্যার বললেন, উস দিন চেঙ্গিস খান  কো ইসি লিয়ে পুকারা কিউকি ও সেদিন গেম ক্লাস মে নেহি গিয়া। কিন্তু ও ভাবল, আমি বোধহয় ওকেই চোর ভেবে ডেকেছি। তাই ও যখনই মা-কালীর দিব্যি, বাবা লোকনাথের দিব্যি বলে আমাকে বোঝাতে চাইল যে ও টিফিন চুরি করেনি। তখনই আমার সন্দেহ হয়।

তারপর সেদিন যখন ও পেট ব্যথার অজুহাত দিয়ে কম্পিউটার ক্লাসে গেল না, তখনই আমি শিওর হলাম যে ওকে তাহলে এখনই হাতে-নাতে ধরা যাবে। ব্যাস প্রবলেম সলভ।

 

অলংকরণ অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ