Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

টাইটানিক- শম্ভু ভান্ডারী

টাইটানিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রথম ও বড়ো জলযান। গ্রীক পুরাণের বিশ্বকর্মা দেবতার নাম 'টাইটনি'। তার নাম উৎসর্গ করে এই জাহাজের নাম রাখা হয় 'টাইটানিক'। এর পুরো নাম ছিল 'আর. এম. এস. টাইটানিক' অর্থাৎ 'রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক'। জাহাজটি তৈরি শুরু হয় ১৯০৭ সালে। সারা দেশের বাঘা-বাঘা বিজ্ঞানী এই জাহাজের নকশা তৈরি করেছিলেন। সেই নকশা মতো কাজ শুরু হয়। এই কাজটি করেন গ্রীকের বিখ্যাত কোম্পানি 'হোয়াইট স্টার লাইন'-এর কয়েক হাজার কর্মী। প্রায় ছ-বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে ১৯১২ সালে শেষ হয় জাহাজ তৈরির কাজ।

'টাইটানিক' জাহাজটির দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮৩ ফুট, প্রস্থ ৯২ ফুট ৫ ইঞ্চি। আর ওজন ছিল প্রায় ৬০ হাজার টন। যেন একটা ছোটো শহর। তখনকার দিনে এই জাহাজের প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩১০০ ডলার আর ডেকের ভাড়া ছিল ৩২ ডলার।

১৯১২ সালে ১০ এপ্রিল  সাউদাস্পটন বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করল। ২২০০ জন যাত্রী নিয়ে পাড়ি দিল আটলান্টিকের নীল জলে। সেদিন সারা দেশের খবরের কাগজের পাতায় ছিল টাইটানিকের খবর। টাইটানিকের যাত্রী কিছু দূরেই নিউইয়র্ক নামে জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে-লাগতে কোনোরকমে রেহাই পেল। জাহাজ তার নিজের গতিতে ছুটে চলল সমুদ্রের নীল জলে। কদিন যাত্রীদের বেশ মজা করেই কাটল।

তারপর এল সেই অভিশপ্ত মুহূর্ত। তখন রাত ১০টা ২৩। মিনিট হঠাৎ প্রচণ্ড এক আওয়াজ। জাহাজে বিরাট ফাটল ধরল হিমশৈলে ধাক্কা লেগে। জাহাজ থরথর করে কেঁপে উঠল।

'হিমশৈল' বা 'আইসবার্গ' হচ্ছে সমুদ্রের বুকে ভাসমান বরফের পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় যে বরফ জমে তা অনেক সময় ভেঙে সমুদ্রে পড়ে যায়। জলের থেকে বরফ হালকা। তাই বরফ জলে ভাসে। আর সেটাকেই বলে হিমশৈল। হিমশৈল ছোটো-বড়ো নানারকম হয়। বড়ো হিমশৈলগুলির উচ্চতা প্রায় ১০০০ মিটারও হয়ে থাকে এবং যাদের ওজন প্রায় ১৮ কোটি টন। বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী হিমশৈলগুলোর ন-ভাগের মধ্যে আট ভাগ জলের নিচে ডুবে থাকে। আর এক ভাগ জলের ওপরে থাকে। এই বিশাল-বিশাল হিমশৈলগুলো বছরের পর বছর ভেসে থাকে জলে। টাইটানিকের সঙ্গে যে হিমশৈলের ধাক্কা লেগেছিল সেটা তিন বছর ধরে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

জাহাজে ফাটল ধরায় হিংস্র দানবের মতো জল ডুকছে হু-হু করে। ঘন্টা বাজিয়ে কর্মীরা জানিয়ে দিল বিপদ সংকেত। যেখানে ফাটল ধরেছিল সেখানে মোটা পাতের ইমারজেন্সি গেট ফেলে আটকানোর চেষ্টা করেছে জাহাজের কর্মীরা। যতক্ষণ প্রাণ আছে চেষ্টা তো করতেই হবে। ক্যাপ্তেন নির্দেশ দিলেন, কেউ ভেতরে থাকবেন না। কাপ্তেন ই. জে. স্মিথ, যার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। ৪০ বছর ক্যাপ্তেনের কাজ করেছেন তিনি। সেই ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তখনো জাহাজের ম্যাপটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে চলেছেন। যদি কোনোভাবে বাঁচানো যায় ২২০০জন যাত্রীকে। কিন্তু না, আর কোনো উপায় নেই। জাহাজের নিচের তলায় আস্তে-আস্তে জল ভরে উঠছে। যাত্রীরা প্রাণভয়ে জাহাজের ডেকে গিয়ে হাজির হয়েছে সকলে। টাইটানিকের লাইফবোট ছিল ষোলটা। চারটে ভাঁজ করা লাইফবোট। বোটগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ ফুট। এক-একটাতে ৬৪জন যাত্রী বহন করতে পারত। সেই লাইফবোটে ওঠার জন্য মারামারি ঠেলাঠেলি। ক্যাপ্তেন নির্দেশ দিয়েছিলেন, আগে মহিলা ও শিশুদের লাইফবোটে তোলা হবে, তারপর অন্য সবাই।

একটা সময় জাহাজের সামনের অংশ আলাদা হয়ে গিয়ে জলের তলায় ডুবে গেল। বাকি অংশটার মাথাটা আস্তে-আস্তে উপরের দিকে সোজা হতে থাকল। জাহাজের ভাঙা অংশটি খাড়া হয়ে যাওয়ায় মানুষ পিঁপড়ের মতো গড়িয়ে-গড়িয়ে জলে পড়তে লাগল। জলে তখন প্রচুর মানুষ জাহাজের ভাঙা ভেসে যাওয়া কাঠ ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। ধীরে-ধীরে জাহাজের বাকি অংশটাও জলের তলায় তলিয়ে গেল। কত মানুষ সেই জলের তলায় চাপা পড়ল।

২২০০ জন যাত্রী এবং প্রায় ১০০০ জন কর্মীর মধ্যে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিল ১৬৮৭ জন। বাকি ১৫১৩ জন যাত্রী সাগরের হিমশীতল জলে চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল। ৬ বছর কতো শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল টাইটানিক নামের ছোটখাটো শহরটা মাত্র দু-ঘন্টার মধ্যে সাগরের গভীরে তলিয়ে গেল। আর সেই দৃশ্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে রইল প্রকৃতি।

 

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ