![]() |
বর্ধমান জেলার ভেদিয়া গ্রামে ভেদো বামুন নামে এক পেটুক বামুন থাকত। পুজো-আর্চার বিশেষ কিছুই সে জানত না। তবুও এর-ওর বাড়ি অং নমো বং নমো করে পুরুতগিরি করত। তাতেই কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যেত তার।
ভেদিয়া ছিল তখন বনময় অজ গ্রাম। চারদিকে ঝোপ-ঝাড় বড়ো-বড়ো গাছপালায় ভর্তি। পাকা বাড়ি একটাও ছিল না। যা ছিল তা মাটির ঘর, খড়ের চালা, ছিটেবেড়া ইত্যাদি। ভেদো বামুনের একটাই রোগ ছিল বিনা নিমন্ত্রণে লোকের বাড়ি খেতে যাওয়া। কার বাড়ির ছেলেমেয়ের অন্নপ্রাশন, কার উপনয়ন, বিয়ে বাড়ি, শ্রাদ্ধ বাড়ি কোনো কিছুই বাদ দিত না সে। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাতেই গিয়ে হাজির হত।
তখনকার মানুষজনও ছিল অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং অতিথি বৎসল। তাই ভেদো বামুনের আবির্ভাবে নিজেদের ধন্য মনে করত তারা। এখনকার দিনের মতো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না তখন। বিনা নিমন্ত্রণেও কেউ এলে তাকে যথেষ্ট সমাদর করে খেতে বসতে বলত।
ভেদো বামুন একবার কার মুখে যেন খবর পেল গুসকরার বাবুদের বাড়ি বিরাট এক ভোজের আয়োজন হয়েছে। জমিদারবাবুর একমাত্র ছেলের বিয়ে, তাই সবার আমন্ত্রণ। যদিও গ্রামান্তর, তবুও ভেদো বামুন ভর দুপুরে ছাতি মাথায় দিয়ে চলল বিয়েবাড়ির ভোজ খেতে।
সময়টা গ্রীষ্মকাল। তাই খাটো ধুতি পরে গায়ে জীর্ণ একটা ফতুয়া চড়িয়ে খালি পায়েই চলল সে ভোজ খেতে। অনেকদূর যাবার পর একটা ছায়াঘন পাকুড় গাছের নীচে বসল সে বিশ্রাম নিতে।
খানিক বিশ্রাম নেওয়ার পর মনে হল কে যেন তার টাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ভেদো বামুন একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেখল। কিন্তু কিছুই সে বুঝতে পারল না। ভাবল নিশ্চয়ই কোনো বাতাসের প্রভাব অথবা কোনো কাঠবিড়ালির লেজের প্রভাবে এমনটা হয়েছে। তবে এদিক-সেদিক তাকিয়ে সে কিছুই বুঝতে পারল না।
এরপর যখন উঠি-উঠি করছে ঠিক তখনই তার মাথায় একটা চাঁটি। কে যেন বলল, ‘এই ব্যাটা ভেদো, কোথায় যাচ্ছিস রে এই ভরদুপুরে ?’
ভেদো বামুন উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকিয়েও কাউকেই দেখতে পেল না। তবে গলার আওয়াজটা খুব পরিচিত বলে মনে হল। কাউকেই দেখতে না পেয়ে ভেদো বামুনের গলার স্বর চড়ল, ‘কে বটে রে ?’
অমনি উত্তর এল, ‘আমি রে, আমি। আমি নেপো। একবার ওপরদিকে তাকিয়ে দেখ।’
নেপো ! মানে নেপাল ভট্চায। একই গ্রামের মানুষ দুজনে। বছর তিনেক আগে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে গলায় দড়ি দিয়ে মরে। সে এখানে আসবে কী করে ? তবু ওপর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল লম্বা চেহারার একটা কেলে ভূত বসে আছে গাছের ডালে। কিন্তু এ কী চেহারা তার ? আগের সঙ্গে তো মিলছে না। আগে কেমন গোলগাল নাদুস-নুদুস চেহারা ছিল নেপোর। দুজনে একসঙ্গে লোকের বাড়ি কোনো অনুষ্ঠান হলে ভোজ খেতে যেত। তবে নেপোর একটা দোষ ছিল হাতের কাছে যেখানে যা পেত তাই নিয়েই সটকে পড়ত। ছিঁচকে চোর যাকে বলে ঠিক তাই। কেউ ওকে দেখতে পারত না।
ভেদো বামুন বলল, ‘তুই নেপোই হোস আর যেই হোস এখানে কী করছিস ?’
‘কী আবার করব ? ভূত হয়ে গাছের হাওয়া খাচ্ছি। কিন্তু তুই এখন যাচ্ছিস কোথায় ? নিশ্চয়ই কোনো ভোজ বাড়ির গন্ধ পেয়েছিস ?’
‘পেয়েছিই তো। সেজন্যই তো যাচ্ছি। এই আমি চললুম।’ বলে চলা শুরু করতেই নেপো বলল, ‘তবে আম্মো যাব তোর সঙ্গে। অনেকদিন বিয়ে বাড়ির ভোজ খাইনি। আজ দুজনে একসঙ্গে বসে খাব।’
ভেদো বামুন বলল, ‘সাধ মন্দ নয়। তোকে আমি নিয়ে গেলে তো যাবি।’
নেপো অমনি গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে নেমে ভেদো বামুনের গলা জড়িয়ে ধরে তার পিঠে চেপে বসল।
ভেদো বামুন রেগে বলল, ‘পিঠে চাপলি যে ? নাম বলছি। না হলে কষে দুটো থাপ্পর দেব।’
‘দে না। ওতে আমার কিচ্ছু হবে না। কান মলে দে, ঝ্যাঁটার বাড়ি মার, মাথায় পেরেক গেঁথে দে। লাগবেই না আমার।’
ভেদো বামুন বলল, ‘তোর ব্যবস্থা আমি করছি দাঁড়া।’
‘কী ব্যবস্থা করবি ?’
‘গয়ায় গিয়ে তোর নামে পিণ্ডি দিয়ে আসব।’
নেপো হ্যা-হ্যা করে হেসে বলল, ‘তোর মতো বিটলে বামুনের হাতে পিণ্ডি আমি খেলে তো ? তুই যখন পিণ্ডি দিবি আমি তখন মুখে কচুপাতা চাপা দিয়ে বসে থাকব।’
এমন সময় ওরা দেখতে পেল আশেপাশেরই গ্রামের কয়েকজন লোক একটি মড়া নিয়ে কোথায় যেন পোড়াতে যাচ্ছে। তাই দেখে নেপো বলল, ‘যা তবে তুই। আমি এখন ওই মড়ায় গিয়ে ভর করি। ওদের কাঁধে চেপে দোল খেতে-খেতে যাই। কী আনন্দ। বেশ মজা হবে। তবে একটা কথা, তুই ব্যাটা কস্মিনকালেও গয়ায় যাবি না। আমিও চাই না তোর হাতে পিণ্ডি খেতে। নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার সময় আমার জন্য বরং ভালোমন্দ খাবার কিছু তোর ওই গামছায় বেঁধে নিয়ে আসবি।’
ভেদো বামুন বলল, ‘ওসব আমার দ্বারা হবে না হে। তোর জন্য ভালোমন্দ কেন কিছুই আমাকে দেবে না কেউ।’
‘আহা, ওরা দেবে কেন ? খেতে-খেতেই যা পাবি টুকটাক করে গামছায় বেঁধে নিবি। আমি তো আমার গিন্নির জন্যে ওইভাবেই ভোজ বাড়ি থেকে খাবার বেঁধে আনতাম। অথচ সেই গিন্নিই একদিন আমাকে এমন ঝ্যাঁটাপেটা করলে যে মনের দুঃখে আমি এসে গলায় দড়ি দিলুম।’
ভেদো বামুন বলল, ‘তুই হচ্ছিস ছ্যাঁচড়া বামুন তাই ওই সব বাজে কাজ করে এসেছিস সারাজীবন। আমি যা কখনো করিনি আজও তা করব না। কিছুই আনব না তোর জন্য।’
‘বেশ তাহলে যা ভালো বুঝিস তাই কর। আমারও নাম নেপো। তুই যখন খেতে বসবি আমি তখন তোর ওপরই ভর করব। তারপর খাওয়া কাকে বলে দেখাব। কথায় বলে ভূতের খাওয়া। এমন খাওয়া খাব যে ওরা তোকে কান ধরে তুলে দিতে পথ পাবে না।’
ভেদো বামুন নিজের মনেই গজগজ করতে-করতে এগিয়ে চলল গুসকরার দিকে। আর নেপো গিয়ে মড়ার খাটিয়ায় চেপে বসল।
সন্ধের আগেই গুসকরায় গিয়ে পৌঁছল ভেদো বামুন। সে কী এলাহি ব্যাপার সেখানে। জমিদারবাবুর একমাত্র ছেলের বিয়ে। সেদিন তার বৌভাত। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে শয়ে -শয়ে লোক এসেছে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। খাওয়া-দাওয়ার তাই বিশাল আয়োজন। একটি বড়ো মাঠে চার পাঁচ জায়গায় রান্না হচ্ছে। না হলে সামাল দিতে পারবে কেন ?
মস্ত সামিয়ানার নীচে হ্যাজাকের আলোয় খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হয়েছে চার পাঁচ জায়গায়। সন্ধে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই জমিদারের লোকেরা এসে অতিথিদের আহ্বান জানালেন, ‘এবার আপনারা এক-এক করে এসে আসন গ্রহণ করতে পারেন।’
অতিথিরা তাই আসনে বসে ভাঁড়ে দেওয়া জলে কলাপাতা ধুয়ে পরিবেশন হওয়ার অপেক্ষায় রইলেন। তখনকার দিনে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা ছিল না। মাটিতে আসন পেতে বসেই খেতে হত। আর কোনো কাজের বাড়ির অনুষ্ঠানে মাংসের চল ছিল না। লুচি, ভাজা, ডাল, তরকারি ও অপর্যাপ্ত পুকুরের মাছই ছিল প্রধান পদ। এছাড়া বোঁদে, পানতুয়া, সন্দেশ, রসগোল্লা, দরবেশ ও দই ছিল মিষ্টিমুখের জন্য।
খাওয়ার ডাক পড়তেই ভেদো বামুনও আসন গ্রহণ করে বসে পড়ল এক পাশে। সে কী দারুণ ভোজ। দু’তিনশো লুচি, সাদা তরকারি, বড়ো-বড়ো দু’তিন কড়া মাছ ভেদো বামুন একাই খেয়ে শেষ করল। এরপর মিষ্টি খাওয়া। দশ-বারো সের বোঁদে, সাত আটশোর মতো পানতুয়া যখন নিমেষে খেয়ে ফেলল, তখন মহাভোজের আসরে দারুণ চঞ্চলতা দেখা দিল। সবাই নিজেদের খাওয়া ফেলে ভেদো বামুনের ভোজন বিলাস দেখতে লাগল বড়ো-বড়ো চোখ করে।
খবর গেল জমিদারবাবুর কাছে। খবর শোনামাত্র হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জমিদারবাবু। শুধু জমিদারবাবু নন, নায়েব, দেওয়ান এবং সম্ভ্রান্ত অনেকেই এলেন। কেন না সবার মুখেই তখন ছড়িয়ে পড়েছে কোথা থেকে এক নররাক্ষসের আবির্ভাব হয়েছে এখানে।
জমিদারবাবু এসে করজোড়ে ভেদো বামুনকে বললেন, ‘কে আপনি প্রভু ? কোথা থেকে এসেছেন ?
ভেদো বামুনকে তখন চিনতে পেরেছে দু’একজন। তাদেরই একজন বলল, ‘এ তো ভেদিয়ার ভেদো। যেখানে যত কাজকর্মের বাড়ি হয় সেখানেই যায় ও। কিন্তু এমন খাওয়া এর আগে আর কখনও খেয়েছে বলে তো শুনিনি।’
অপর একজন বলল, ‘আমার মনে হয় ভেদো বামুনের চেহারা নিয়েই কোনো প্রেত এসে খেতে বসেছে এখানে। এখনই কোনো ওঝা-গুণিন ডেকে এর ব্যবস্থা করা উচিত।’
জমিদারবাবু বললেন, ‘কী লজ্জার কথা। একজন ব্রাহ্মণ মানুষ। আজকের দিনে তাঁর আমি অসম্মান করি কী করে ? উনি আর কত খাবেন ওঁকে জিজ্ঞেস করুন।’
জমিদারের গোমস্তা একজন প্রবীণ মানুষ। তিনি এসে ভেদো বামুনকে দেখে বললেন, ‘সত্যি সত্যিই এই মানুষটা নিজে খাচ্ছেন না। ওঁর খাওয়া ভূতে খাচ্ছে। কেন না স্বাভাবিক মানুষের চোখমুখের ঘোর এমন হয় না।’ বলে তিনি ভেদো বামুনের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘মহাশয়, শুনছেন ?’
ভেদো বামুন বললেন, ‘শুনছি বৈকি।’
‘আপনি কি ভেদিয়ার সেই ভেদো বামুন ?’
‘আমি নেপো। ভোজ বাড়িতে খেতে এসেছি। আমার পেট ভরানোর খ্যামতা তোমাদের কারও নেই।’
এমন সময় ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন বললেন, ‘আমার আছে রে হতচ্ছাড়া। তোর কী অবস্থা আমি করি এবার তুই দেখ।’
সবাই তাকিয়ে দেখলেন গুণিনের সেরা গুণিন শঙ্করী আচার্যি মড়ার মাথার খুলি, হাড় এবং আরও কী সব নিয়ে যেন রুদ্রমূর্তিতে হাজির হয়েছেন সেখানে।
আচার্যিকে দেখেই ভেদো বামুনকে ছেড়ে পালালো নেপো। ভেদো বামুনও তখন মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারাল।
অনেক পরে সকলের সেবা শুশ্রুষায় জ্ঞান ফিরল ভেদো বামুনের। সকলে জানতে চাইল, ‘নেপো কে ? আর অমন অমানুষিক খাওয়া এই বয়সে তুমি খেলেই বা কী করে ?’
ভেদো বামুন তখন আগাগোড়া ব্যাপারটা খুলে বলল। এও বলল, ‘ওই নেপোর ভূত আমাকে ভর করায় আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না। আমার মুখ দিয়ে যে খাবার আমি খেয়েছি তা ওই নেপোয় খেয়েছে।’
সে রাতে আর গ্রামে ফেরা হল না ভেদো বামুনের। পরদিন সকালে সামান্য কিছু প্রণামী ও এক হাঁড়ি মিষ্টি দিয়ে জমিদারবাবু তাঁর দুজন লোকের সঙ্গে ঘুর পথে ভেদিয়ায় পাঠালেন ভেদো বামুনকে।
সেদিনের পর থেকে ভেদো বামুন আর কখনো কোনো কাজের বাড়িতে খেতে যায়নি।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ডিসেম্বর ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ