Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পাহাড়ের গল্প ।। সমীরণ মুখোপাধ্যায়

পাহাড়ের ভূত, পাহাড়ের মজা, পাহাড়ের বিপদ, পাহাড়ের হিংস্র জীবজন্তু, পাহাড়ের দুঃখ, পাহাড়ের আানন্দ, পাহাড়ের আরো কিছু রোমহর্ষক কাহিনি। পাহাড়ের বিচিত্র সব ঘটনা নিয়ে 'পাহাড়ের গল্প'-

তাতাই, টুকাই, বুনি, তিমি, বলাকারা ঘিরে ধরেছে সমুদাকে। ওরা সকলে সমুদার কাছে পাহাড়ের গল্প শুনবে। আর পাহাড় মানে হিমালয়। সমুদা প্রায়ই হিমালয়ে চলে যায় কোনো না কোনো অভিযানে, তাই এই আবদার।

সমুদা এক কাপ চা খেয়ে শুরু করল-

পাহাড়ের সরলতা

শোন, গল্পটা শুনেছিলাম বিকাশকাকুর কাছে। বিকাশকাকু আজ অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু তখন তিনি সদ্য যৌবনে পা দিয়েছেন। কয়েকজন বন্ধু মিলে পা বাড়িয়েছেন সান্দাকফু ফালুট হয়ে সিঙ্গালালা পাসের পথে। পথঘাট তখন তেমন উন্নত হয়নি। পাহাড়ে জনবসতি তখন আরও অনেক কম ছিল, জঙ্গল ছিল আরও গভীর, বন্য পশুর যাতায়াত ছিল অবারিত।

দিন কয়েক চলার পর খারাপ আবহাওয়ার জন্য সেদিন তাদের বেরতে দেরি হয়ে গেল। গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সরু চড়াইপথ। শুরু হল তুষার-ঝড়। ঝড়ের ঝাপটে সবকিছু যেন লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যাবে, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রায় ঘন্টা পাঁচেক কোনোরকমে চলার পর কাকুদের চারজন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন দল থেকে। চলতে-চলতে হঠাৎ পথ মিলিয়ে গেল পাহাড়ের খাদে। ওঁরা বুঝলেন পথ হারিয়েছেন। ওঁরা পাগলের মতো পথ খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু যতই পথ খোঁজেন, গোলক ধাঁধার মতো পথ ততই হারিয়ে যায়। বাড়তে থাকে তুষার-ঝড়, এর ওপর আছে জংলি জানোয়ারের ভয়। শুধু টর্চের আলোর ওপর ভর করে চলল পথ খোঁজা। কিন্তু পথ পাওয়া গেল না। শেষে ঠিক হল ওঁরা গাছে উঠে কোনোরকমে রাত কাটাবেন। কিন্তু সমস্যা হল ওঁদের কাছে শীতের ভারী পোশাক, স্লিপিং ব্যাগ কিছুই নেই। শীতের প্রকোপে রাত পোহানোর আগেই ওঁরা মারা পড়বেন। হঠাৎ ওঁদের এক বন্ধু একটা ঝোপে বেশ কয়েকটা ছোটো লুঙদার অর্থাৎ চৌকোনা প্রার্থনা পতাকা দেখতে পেলেন। সেই বন্ধু লাফিয়ে উঠে বললেন- এই দ্যাখ লুঙদার! লুঙদার যখন আছে, কাছে-পিঠে জনবসতিও নিশ্চয় আছে!

আবার চলল খোঁজা। সেই প্রবল শীতে, ঝড়ের মধ্যে পাওয়া গেল একটা বাড়ি। আনন্দে ছুটে গেলেন ওঁরা বাড়িটার দিকে। বাড়িটার বিভিন্ন ফাঁক-ফোঁকড় গলে বেরিয়ে আসছে আলোর ছটা। বিকাশ কাকুরা বাড়িটার সামনে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন। কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। এবার চারজন মিলে দরজায় জোরে-জোরে ধাক্কা মারলেন, চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, বলতে লাগলেন, ‘আমরা পর্বতারোহী, আমরা তুষার ঝড়ে পথ হারিয়েছি, আমাদের বাঁচান। আমাদের খাবার দিন, আমাদের জল দিন...।

কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না। ওঁরা বুঝতে পারছেন যে ভেতরে লোক আছে এবং তারা জেগে আছে কিন্তু কেউ কোনো টু শব্দটি করছে না। শেষে পলিথিন সিট পেতে বরফ মেশানো অল্প জল সংগ্রহ করে সেটা গলায় ঢেলে বিকাশকাকুরা বাড়ির বারান্দায় ছেঁড়া চট পেতে কোনোরকমে শুয়ে পড়লেন।

সকাল হয়ে আসছে। পূবাকাশে লাল সূর্য উঠেছে। হঠাৎ কাদের আওয়াজে কাকুদের ঘুম ভেঙে গেল। দেখলেন প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধ হাতে ধূমায়িত চায়ের মগ নিয়ে ডাকছেন- সাব উঠিয়ে, চায় পিজিয়ে। পাশে তার বৃদ্ধা স্ত্রী ও যুবক ছেলে। গতরাত্রের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তাঁরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, আর বললেন- না, আমরা কিছুই খাব না। কাল আমরা মরতে-মরতে বাঁচলাম, আমাদের একটুও সাহায্য করলেন না। আর আজ এসেছেন আমাদের সেবা করতে ?

গৃহস্বামী অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন, হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন, আর বললেন- আপনারা আমার মেহেমান। আপনারা কিছু না খেলে আমার অকল্যাণ হবে। ঘরের অন্যান্যরাও অতি বিনয়ী ও নাছোড়। শেষে বাধ্য হয়েই কাকুরা চা খেলেন। চা খাওয়ার পরে এল চমরি গাইয়ের গরম দুধ, তারপর রুটি, ভেড়ার মাংস, বাঁধাকপির তরকারি ও চাটনি। খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হলে গৃহস্বামী নিজে পথ দেখিয়ে ওনাদের পৌঁছে দিলেন টুংলুতে। টাকা-পয়সা দিতে গেলে গৃহস্বামী কিছুতেই নিলেন না। বারবার বলতে লাগলেন- আপনারা আমার মেহেমান, মেহেমানের কাছে কী কখনো পয়সা নিতে হয় ?

চলতে-চলতে তাদের অতিথিসেবার অতিশয্য দেখে বিকাশকাকু জিজ্ঞাসা করলেন- আচ্ছা, আজ আপনারা এত খাওয়ালেন, এত যত্ন করলেন কিন্তু কাল আপনাদের এত ডাকলাম, এত চিৎকার করলাম, আপনারা একবারও বেরিয়ে এলেন না, টুঁ শব্দটি করলেন না। কেন বলুন তো ? আপনারা জেগেছিলেন, ঘরে আলো জ্বলছিল। আপনারা কেন এলেন না বলুন তো ?

গৃহস্বামী আমতা-আমতা করে বললেন- সাব, আমরা সব... জানতাম। আপনারা শীতে কষ্ট পাচ্ছেন, তুষার ঝড়ের মধ্যে দিয়ে এসেছেন, খাবার চেয়েছেন, জল চেয়েছেন, সব জানতাম। কিন্তু সাহস হয়নি উত্তর দিতে! ভয়ে বেরোইনি আমরা।

-সাহস হয়নি ? ভয়ে বেরোইনি ? মানে ?

গৃহস্বামী হাত-মুখ কচলে বললেন- সাব, আমরা ভয়ে দরজা খুলিনি। এখানে সাব বহুৎ ভূত-প্রেত-দানো আছে। ভূতের ভয়ে আমরা সন্ধ্যা হলেই দরজা-জানলা লাগিয়ে ঘরে ঢুকে যাই। এবার তিনি বড়ো-বড়ো চোখ করে বললেন- সাব, সন্ধ্যা হলেই ভূতেরা এখানে ঘুরে বেড়ায়। ওরা ঘরের সামনে এসে দরজায় ধাক্কা মেরে বাড়ির লোকজনেদের নাম ধরে-ধরে ডাকে। আর ভুল করে একবার সাড়া দিলেই ব্যাস! ভূতটা তখন তাকে পাহাড়ের আড়ালে ধরে নিয়ে গিয়ে সব রক্ত চুষে নেবে। বলে, গৃহস্বামী বারকয়েক সভয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে ইষ্ট দেবতার নাম স্মরণ করলেন।

সমুদার মুখ থেকে গল্পটা শুনে বুনি জিজ্ঞাসা করল- পাহাড়ে অপদেবতা থাকে, দেবতা থাকে না ?

পাহাড়ের দেবতা

হিমালয় দেবভূমি, সকল ধর্মের মানুষ হিমালয়কে দেবস্থান হিসাবে মানে। গাইড পোর্টটরা বলে হিমালয়ের তুষারাবৃত পর্বতে হিমালয়-কন্যা পার্বতী নাকি লাল পেড়ে শাড়ি পরে, এলোচুলে, ছোট্ট বালিকার বেশে ঘুরে-ঘুরে বেড়ান। ভাগ্যবান লোকেরা নাকি কখনো-কখনো দেখতেও পায়। আমি ভাগ্যবান নই। তবে হিমালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু পৌরাণিক উপাখ্যান।

পাহাড়ের পুরাণ

একটা ঘটনা বলছি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। ভীমের গদার প্রহারে ঊরু ভেঙে মারা গেছেন দুর্যোধন। জয়ী হল পাণ্ডবরা। বিজয়ী পাণ্ডবরা তাড়া করতে লাগল পরাজিত কৌরবদের। ভীত, পরাজিত কৌরব সেনাকুল পালাতে লাগল হস্তিনাপুরের দিকে কিন্তু সেখানেও নিস্তার নেই। ওরা ধরল যমুনার উজান। আগে পলায়মান কৌরবকুলের লোকজন, পেছনে পাণ্ডবরা। ওরা পালাতে-পালাতে যমুনেত্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গেল। প্রাণ ভয়ে কৌরবরা উঠে গেল পাহাড়ের ওপরে। পাণ্ডবরা রয়ে গেল পাহাড়ের নীচে। পাণ্ডবরা আর ওপরে উঠতে পারল না, কারণ পাহাড়ের ওপরে যারা থাকে যুদ্ধে তারাই এগিয়ে থাকে। আজও হর-কি-দুনএর পথে দেখা যায় এই কৌরব-পাণ্ডবদের উত্তরসূরীদের। সেখানে আজও আছে কর্ণ ও দুর্যোধনের মন্দির। রীতিমতো দেবতাজ্ঞানে পূজিত হন তাঁরা। ডাঁটমির, গঙ্গাড়, সীমা ও ওসলা, এই সমস্ত তমসা উপত্যকায়।

তাতাই গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল- শুনেছি, হিমালয়ে অনেক আপদ-বিপদ হয়!

পাহাড়ের বিপদ

-ঠিক বলেছিস। শোন, সেবার আমরা চলেছি রূপকুণ্ড-হোমকুণ্ড হয়ে রন্টি স্যাডেল। সকাল-সকাল পৌঁছে গেলাম রূপকুণ্ডে। রূপকুণ্ডে প্রচুর কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। রূপকুণ্ড নিয়ে কয়েকটা তথ্য ও গল্প প্রচলিত আছে। কথিত আছে রাজার অন্যায়ে খেপে গিয়ে মাতা নন্দা দেবী নাকি তুষার ঝড়ে সকল রাজকর্মচারীদের শুইয়ে দেন চিরতুষারের নীচে। এগুলো নাকি তাদেরই কঙ্কাল। আবার অন্য মতে পাহাড়ের উত্তর প্রান্ত থেকে আসা বিদেশী বাহিনীর সঙ্গে লড়তে গিয়ে মৃত সৈনিকদের দেহ এগুলো। তবে প্রতি বারো বছর অন্তর এখানে বড়ানন্দাজাত বলে বিশাল উৎসব হয়। এই উৎসবে হাজার-হাজার নারী-পুরুষ যোগদান করেন, যেতে হয় রূপকুণ্ড পেরিয়ে, জিওনার গলি কল অতিক্রম করে বড়াহোম কুণ্ডে। অনেকে যেতে পারেন, অনেকে পারে না। তবে এই সময়ে এই অঞ্চলে নাকি চার শিং-ওয়ালা একটি ভেড়ার জন্ম হবেই। এই ভেড়াটিকে উৎসর্গ করা হয় মা নন্দাদেবীর উদ্দেশ্যে এবং পূজাপাঠের পর বড়াহোম কুণ্ডে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।

তারপর এই ভেড়াটিকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় যায় কে জানে! আমরা জিওনার গলি কল অতিক্রম করে, শৈল সমুদ্র হিমবাহ পেরিয়ে দোদাং থেকে সেদিন যাত্রা শুরু করেছি। আমাদের গাইড বলল- সাব, আজকা মৌসম ঠিক নেহি হ্যায়। কিন্তু দলের প্রবীণতম সদস্য গিরিদা ভাবলেন, গাইড-পোর্টরা হয়তো এড়িয়ে যাবার ফন্দি আঁটছে। তাই গাইডের কথায় কান না দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম আগে। দূরে নন্দমুন্টির পাশে জমাট বাঁধা কালো মেঘ দ্রুত বড়ো হতে লাগল, চক্রাকারে বিস্তৃত হল দিগন্তে। আমরা অনুভব করলাম মেঘের গতি প্রকৃতি। দৈত্যরূপী মেঘ ব্লিজার্ডের আকারে দ্রুত ছুটে আসবে। আর সময় নষ্ট নয়, দ্রুত যাত্রা পথের মুখ ঘুরিয়ে আমরা ছুটতে লাগলাম পূর্বের পথ ধরে হিমবাহের ওপর দিয়ে। হাওয়ার দাপটে ছোটো-ছোটো পাথর উড়ে আসছে। সেদিন আমরা পাহাড়ে হাঁটিনি, দৌড়ে ছিলাম। তাই বেঁচে গিয়েছিলাম হিমালয়ের রুদ্ররোষ থেকে। নয়তো আমাদের দেহগুলো পড়ে থাকত বরফের নীচে।

আমরা বাঁচলেও বাঁচেননি ভাস্করদা। ২০০৭ সালের অক্টোবর মাস। দলনেতা ভাস্করদা সাতজন সঙ্গীসহ চলেছেন লাদাক হিমালয়ের পারাংলা অভিযানে। গাইড পোর্টারদের অসহযোগিতায় তাঁদের পারাংলা পৌঁছতে বিকাল চারটে হয়ে গেল। প্রকৃতির অবস্থা তখন খুব খারাপ। চারিধারে শুধু বরফ আর বরফ। এরই মধ্যে শুরু হল তুষার ঝড়। এই ভীষণ আবহাওয়ার মধ্যেও তারা এগিয়ে গেল পারাংলা-টপের দিকে। যেটা একদম ঠিক হয়নি। দলনেতা ও অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ভাস্করদা দলের সকলকে পারাংলা অতিক্রম করিয়ে দিলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে; শুধু পারলেন না তাঁর আর বাকি দুই সঙ্গীর জীবন বাঁচাতে। শেষে বেঁচে যাওয়া অভিযাত্রী ফিরে এসে জানায়, তুষার ঝড়ের এক দমকা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় ভাস্করদাকে। পরে উদ্ধারকারী দল তিনজনের দেহ উদ্ধার করে পারাংলা গিরিবর্ত্মে।

মৃত্যুর কাহিনী শুনে ছোটোগুলোর মন খারাপ হয়ে গেল, তাই সমুদা চট করে বলল- শোন, এবার একটা বিপদ-মুক্তির ঘটনা বলি।

পাহাড়ের বিপদমুক্তি

সেবার আমরাও চলেছি সান্দাকফু-ফালুট হয়ে সিঙ্গালীলা পাস অতিক্রম করে সিকিমের উত্তরে, গ্রামে। সময়টা জানুয়ারি মাস। সান্দাকফু পুরো বরফে মোড়া, সেখানে মাটি দেখা যাচ্ছে না। সান্দাকফু থেকে ফালুট একুশ কিলোমিটার, পুরো রাস্তাটা বরফে মোড়া। আমাদের গাইড অর্জুন ঘ্যানোর-ঘ্যানোর করতে-করতে অগ্রসর হল আগে, কিন্তু কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর আর যাওয়া গেল না। আরও আগে নাকি পাঁচ-ছয় ফুট বরফ পড়ে আছে, অতএব প্রত্যাগমনায়চ। সান্দাকফু ফিরে ঠিক হল, আমরা গুড়দুম, শ্রীখোলা হয়ে ফিরব ম্যানেভঞ্জনে। কিন্তু গুড়দমের রাস্তাই বা কম কিসে ? সেখানেও প্রচুর বরফ, তার ওপর ঘন জঙ্গল। প্রায়ই হামাগুড়ি দিয়ে, বুক ছেঁচড়ে চলতে হচ্ছে রাস্তায়। সামনে ঢালু রাস্তা, তার ওপর আবার আরম্ভ হল তুষারপাত। ছয়জন সঙ্গীর মধ্যে একজন ছিলেন খুব বয়স্ক স্থূলদেহী, তাই তাঁকে ধরে-ধরে নামানো হচ্ছিল। ওঁকে নামাতে সময় লাগছিল প্রচুর। উৎকণ্ঠিত অর্জুন শেরপা তাই ঠিক করল আমাদের মধ্যে একজন তার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে ট্রেকারহাট ও খাবার-দাবার ঠিক করে রাখবে।

দুজন এগিয়ে গেল। সামনে-পেছনে আমরা আরো পাঁচজন। হঠাৎ দেখলাম, বরফের ওপর কোনো পশুর সদ্য পায়ের ছাপ। পাঁচজনের একজন আবার পাহাড়ের মানুষ, সে বলল- এতো স্নো লেপার্ডের পায়ের ছাপ! আরও কয়েক পা যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম ছাপ চারটে নয় আটটা, অর্থাৎ পশু একটা নয় দুটো। সর্বনাশ, ওরা আবার আগের মানুষদুটোকে অনুসরণ করছে না তো ? পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে দুটো আমাদের থেকে বেশি দূরেও নেই। রাস্তার বাঁক অবিরত; রাস্তার বাঁক পেরোতে গিয়ে মনে হচ্ছে সে দুটো হয়তো ওৎ পেতে বসে আছে! যেকোনো সময় হালুম করে ঘাড়ে এসে পড়বে। যত এগোচ্ছি বরফের ওপর পায়ের ছাপ তত স্পষ্ট হচ্ছে। একটা সময় বরফের ছাপের ভেতরে বরফের কুঁচির নড়াচড়াও দেখতে পেলাম। সর্বনাশ! তাহলে উপায় ? রুকস্যাক থেকে কয়েকটা জামা-কাপড় ও দেশলাই বের করে হাতে রাখলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা খেয়াল এল, শ্বাপদরা দলবদ্ধ মানুষের চিৎকার পছন্দ করে না, ভয়ও পায়। অতএব শুরু হল চিৎকার ও বেসুরো খেয়ালি গান। কিন্তু বাঘ বাবাজীরা নাছোড়বান্দা, ওদের পায়ের ছাপ আমাদের আগে-আগে এগিয়েই চলেছে। শেষে বিপদ বুঝে থালা ও মগ বের করে বদখেয়ালি গানের সঙ্গে শুরু হল ঝমঝমাঝম্ মিউজিক অর্কেষ্টা। একসময় দেখি সেই ছাপগুলো আর নেই! তার মানে আমাদের বিচিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানে বাবাজীদ্বয় ভয় পেয়ে কেটে পড়েছে। আরও ঘন্টাখানেক চলার পর একটা বুনিয়াল অর্থাৎ তৃণক্ষেত্র পেলাম। সেখানে বরফ একটু কম। আমাদের অগ্রবর্তী সঙ্গীদের সেকথা বলতেই বলল- হ্যাঁ, হ্যাঁ; ঘন্টাখানেক আগে আমরা যখন জঙ্গল অতিক্রম করছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, পেছনে কিছু যেন অনুসরণ করছে। সে কথা আমি অর্জুন শেরপাকে বলেওছিলাম।

অর্জুন খালি বলল- জঙ্গলমে খতরা হ্যায়, জলদি চলিয়ে!

তিথি মিষ্টি সুরে বলল- ওফ্ঃ! চিতা দুটো কাছে এলে কি মজাই না হত।

পাহাড়ের মজা

সমুদা চোখ মটকে বলল- তাহলে একটা মজার গল্প বলি।

সেবার আমরা নেমে আসছি নীচে। আসলে পাহাড়ে তো ভালো খাবার পাওয়া যায় না, তার ওপর ট্রেকিং-এর শেষে খুব খিদে পায়। পথে একটা হোটেল পেয়ে সকলে ঢুকলাম। মাথা পিছু ত্রিশ টাকায় পেট চুক্তি খাওয়া। অর্থাৎ ওই টাকায় যত পারো খাও। শুরু হল কাজলদা ও স্বপনদার মধ্যে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এ যত ভাত খায় তো অন্য জন আরেকটু এগিয়ে যায়। উভয়ের চারবার ভাত নেওয়া হয়ে গেছে। যে খাবার দিচ্ছে সে একটা কিশোর। একবার সে খাবার দেয় আর মালিকের দিকে তাকায়। মালিকের কাঁদো-কাঁদো মুখ। কাজলদা ও স্বপনদার নির্বিকার মুখ থেকে খালি আওয়াজ উঠছে সুরুৎ... সুরুৎ...। পঞ্চমবার ভাত নেওয়ার পর বেচারা মালিক আর থাকতে পারল না। সে বলেই ফেলল- খাও, খাও, আউর খাও, লেকিন ইহাঁ ইয়ে রাক্ষস জ্যায়সা খানা নেহি মিলেগা! অ্যয়সে আর দু-চারটে মিলে তো হাম ভিখারী হো জায়েগা!

ছোটোগুলো হো-হো করে হেসে উঠল। হাসির রেশ শেষ হতেই সমুদা বলে উঠল- পাহাড়ে অন্য বিপদও আছে।

পাহাড়ের হিংস্র জন্তু

বহু বছর আগে এক ডাক্তারবাবু তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে চলেছেন গাড়োয়ালের ডোডিতালের দিকে, পথে গভীর জঙ্গল। ডাক্তারবাবুর আবার ফটোতোলার নেশা। হঠাৎ কোত্থেকে এক বিশালাকার ভাল্লুক এসে হাজির ডাক্তারবাবুর সামনে। ডাক্তারবাবু ভয় পাবেন কি, তিনি ভাল্লুকের ছবি তুলতে লাগলেন। ভাল্লুকমামা অপমান বোধ করলেন, তিনি মনে-মনে ভাবলেন- কি, এত বড়ো আস্পর্ধা, আমি সামনে আসতেও ভয় নেই সামান্য মানুষের ? ভাল্লুকমামা রেগে-মেগে মারলেন এক থাবা। মামার থাবায় ফালা-ফালা হয়ে গেল ডাক্তারবাবুর মুখের চামড়া। প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে তেড়ে এল সঙ্গীরা। শেষে ডাক্তারবাবুকে নিজের হাতে নিজের সেলাই করতে হল।

তাতাই বলে উঠল- ইস্, ডাক্তারবাবুটা কি বোকা! ভাল্লুক দেখে কেউ ফটো তুলতে যায় ? আমি হলে এক দৌড়ে পালিয়ে যেতাম।

টুকাই বলল- পালিয়ে যাব বললেই কী পালিয়ে যাওয়া যায় ? জানিস সেখানে কি উঁচু-উঁচু রাস্তা! কত বরফ!

পাহাড়ের সৌন্দর্য

সমুদা বলল- ঠিকই বলেছিস, পালিয়ে যাব বললেই হিমালয় থেকে পালানো যায় না। হিমালয়ের টান বড়ো সাংঘাতিক, বড়ো নেশা। হিমালয়ের তুষারশুদ্র শৃঙ্গে যখন প্রভাতী সূর্যের আলো পড়ে তখন তার আকর্ষণ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সূর্যের পরিক্রমার সঙ্গে-সঙ্গে ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে হিমালয়ের সৌন্দর্যের পরিবর্তন ঘটে। কত মানুষ হিমালয়ের টানে ঘর-সংসার ছেড়েছে, হিমালয়ের অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে হিমালয়ের পথে-পথে। তবে এই হিমালয়ে বাঙালির অবদান কম নয়। হালে আমাদের সত্যব্রত দাম প্রথম বাঙালি হিসাবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করলেও বাঙালি অতীশ দীপঙ্করই প্রথম হিমালয় অতিক্রম করে পাড়ি দেন তিব্বতে। বাঙালি সিকদার পিক ১৫ বা মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা প্রথম নিরূপণ করেন।

হঠাৎ মাঝখান থেকে তিথি বলে উঠল- সমুদা, শুনেছি তেনজিং নোরগে ও এডমণ্ড হিলারির আগে নাকি এভারেস্টে কেউ উঠেছিল ?

পাহাড়ের রোমহর্ষক কিছু তথ্য ও ঘটনা

-এটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন রে! ১৯২৪ এভারেস্ট অভিযানে অভিযাত্রী ম্যালরী ও আরভিন। সঙ্গী নোয়েল ওভেন এঁদের শেষ রকস্টেপ পর্যন্ত উঠতে দেখেন কিন্তু তারপর সবশেষ। ঘটে দুর্ঘটনা। ১৯৩০ সালে আরভিনের আইস-এক্সট্রা পাওয়া যায় ৮৪৪০ মিটার উচ্চতায়। আর ১৯৯৯ সালে ম্যালরীর দেহ পাওয়া যায় ৮১৫৫ মিটার উচ্চতায়। বোঝা যায় আকস্মাৎ পতনের ফলে মৃত্যু হয়েছে ম্যালরীর। পাওয়া যায়নি আরভিনের দেহ। সেই কোডাক ক্যামেরাটা পাওয়া গেলে হয়তো বোঝা যেত আরভিন ও ম্যলরী মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে উঠে ছিলেন কিনা!

তবে তোদের কয়েকটা তথ্য জানিয়ে রাখি যেমন, আমাদের বাংলার মানুষ তেনজিং নোরগে, নিউজিল্যাণ্ডের এডমণ্ড হিলারির সঙ্গে ১৯৫৩ সালের ২৯শে মে সকাল ৯টায় প্রথম এভারেস্টে ওঠেন। আমাদের মাস্টার মশাই কুশাং শেরপা স্যার মিনি দার্জিলিং এর মানুষ, মাউন্ট এভারেস্টের চারটি ফেশ দিয়েউ উঠেছেন। নোয়াং গোম্বু স্যার, ইনিও দার্জিলিং-এর লোক, পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি মাউন্ট এভারেস্টে দুবার ওঠেন। ইটালিয়ান পর্বতাভিযাত্রী রেনল্ড মেসনার পৃথিবীর সবকটি আটহাজারী পর্বতের, যাদের উচ্চতা আট হাজার মিটার বা তারও বেশি, সবকটাতেই চড়ে বসেছেন। জাপানি জুনকো টাবেই মহিলা অভিযাত্রী হিসাবে সর্বপ্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। আর প্রথম ভারতীয় মহিলা হলেন বাচেন্দ্রী পাল। ফু দোরজি সর্বপ্রথম বিনা অক্সিজেনে এভারেস্টে চড়েন। তোরা জানিস কী, মাউন্ট এভারেস্টের অনেক নাম আছে ? নেপালীরা বলে, ‘সাগর মাথা’, তিব্বতীরা বলে, ‘চোমেলুঙমা’, আর চিনারা বলে, ‘জুমুলাঙমা-ফেঙ

টুকাই শুনতে-শুনতে বলল- আমরা দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি, খুব সুন্দর! সূর্যোদয় সেখানে আরও সুন্দর!

সমুদা বলল- তোরা যাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বলিস নেপতারা বলে- কঙ-লো-চু’, ভুটিয়ারা বলে- খুম্বু-করম’, নেপালী-ভুটিয়া ভাষায় এর নাম কঙছেন’, তিব্বতীরা বলে- গ্যানস-ছেন-জোড-লোঙ্গাআর নেপালের আদিবাসীরা বলে খুম্বু-করম-ল্যাঙ্গুর। পণ্ডিতদের মতে কাঞ্চনজঙ্ঘা কথাটা এসেছে তিব্বতী শব্দ ক্যাং-ছেন-দ্য-জঙ্ঘা থেকে, যার অর্থ বরফের পাঁচ কোষাগার। কাঞ্চনজঙ্ঘা স্থানীয়দের কাছে অন্যতম প্রাচীন দেবতা।

সমুদার কাছে অনেক তথ্য শুনে ওরা হাসাহাসি করছিল, কেউ গম্ভীরভাবে শুনছিল। এবার সমুদা বলল- শোন, শুরুটা করেছিলাম ভূতের গল্প দিয়ে শেষও করব তা দিয়ে তবে শুরুর গল্পে কোনো প্রমাণ নেই, তোরা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিস। কিন্তু এটা তোরা উড়িয়ে দিতে পারবি না। সারা পৃথিবী এই ঘটনার সাক্ষী।

পাহাড়ের ভূত

নাঙ্গাপর্বতঃ স্থানীয়রা বলে দিয়ামির অর্থাৎ পর্বতের রাজা। জার্মানদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক তখন সাপে-নেউলে। তখনও পর্যন্ত কেউ উঠতে পারেনি নাঙ্গা পর্বতে। ১৯৫৩ সাল, জার্মানদল আবার শুরু করেছে নাঙ্গা পর্বত অভিযান। জার্মানরা এর আগে অনেক অভিযান করেছে এখানে, মারাও গেছে অনেকে। এই দলে ঢুকলেন অষ্ট্রিয়ান অভিযানী হারমান বুল। জার্মান রেডিও বারবার সম্প্রচার করছে অভিযানীদের অভিযানের খতিয়ান। চতুর্থ ক্যাম্পে পৌঁছে গেল দল। খবর এল, ব্রিটিশ অভিযানী দল জয় করেছে মাউন্ট এভারেস্ট। হঠাৎ এল একটা ব্লিজার্ড বা তুষার ঝড়। অনেকে আহত হল। আহতরা ফিরে এল নীচে।

সেদিন ঝকঝকে আকাশ। কিন্তু দলনেতা হুকুম দিলেন পুরো অভিযানীদলকে নীচে নেমে আসতে। অভিযাত্রীরা অমান্য করলেন দলনেতার আদেশ। ছিন্ন হল যোগাযোগ ব্যবস্থা। আসলে দলনেতার দাদা উইলি মারকেল এই নাঙ্গা পর্বত অভিযানে মারা যান। যখন মারকেল মারা যান তখন দলনেতার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। দলনেতা কখনোই চাননি কোনো অভিযাত্রী এই নাঙ্গা পর্বত অভিযানে সফল হোক, যেহেতু তাঁর দাদা এই অভিযানে সফল হননি।

সে দিনই মধ্যরাত্রে একা অভিযান শুরু করলেন হারমান। কিন্তু পথ বড়োই কষ্টের, পিঠে ন্যাপস্যাক নিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। তাই ন্যাপস্যাককে পাথরের একটা খাঁজে রেখে জ্যাকেটের ভেতর ক্যামেরা ও আইস অ্যক্স নিয়ে আবার শুরু করলেন হাঁটতে। বহু কষ্টে, চির-তুষারের ওপর দিয়ে একাই উঠে পড়লেন নাঙ্গা-পর্বতের শীর্ষে। পৃথিবীর মানুষের প্রথম পা পড়ল নাঙ্গা পর্বতের শীর্ষে।

এবার ফেরার পালা। জল নেই, খাবার নেই, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সারা শরীরে তুষার ক্ষত নিয়ে অবসন্ন হারমান ফিরে আসতে লাগলেন। আস্তে-আস্তে রাত হয়ে এল। আর ফেরার উপায় নেই। হরমান একটা ঢালু পাথরে বসে পড়লেন, পড়ে গেলেই মৃত্যু! এইভাবে কাটালেন সারারাত।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলল- সকাল হয়ে গেছে হরমান, ওঠো! এবার চলা শুরু করো। আগন্তুকের ডাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন মৃত্যুমুখী হরমান পেছনে তাকিয়ে দেখলেন সারা শরীর অভিযাত্রীর পোশাকে আবৃত এক দীর্ঘ দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন। কোনোরকমে হরমান জিজ্ঞাসা করলেন- কে তুমি ?

আগন্তুক বললেন- বন্ধু, তোমার সহ-অভিযাত্রী।

হরমান বললেন- আমি আর পারব না, আমি শেষ, এবার আমি মারা যাব।

আগন্তুক বললেন- তুমি পারবে, তুমি এতটা যখন পেরেছ আরও এগিয়ে যেতে পারবে।

বহু বোঝানোর পর হরমান উঠলেন। আস্তে-আস্তে টলমল পায়ে চলতে লাগলেন, পেছনে আগন্তুক। কিন্তু এ পথ বড়োই বন্ধুর, বড়ো শক্ত। অবসন্ন, ক্ষুধার্থ, তৃষ্ণার্ত শরীর নিয়ে বেশি চলা সম্ভব নয়।

তুষারের ওপর দিয়ে আর তিনি চলতে পারছেন না, তাঁর আর চলার শক্তি নেই। আগন্তুক প্রথমে বোঝালেন, তারপর ধমক দিয়ে বললেন- ওঠো হরমান, ওঠো...। তুমি পৃথিবীর মানুষকে বলবে না, তোমার অভিযানের কথা ? বলবে না, তোমার বিজয়ী হওয়ার কথা ? তোমার বাড়ির লোকজন, তোমার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে, তাদের বলবে না, তোমার এই জয়লাভের কথা ?

হরমান ও আগন্তুক কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। হরমান আবার জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কে ?

আগন্তুক মুখের ঢাকাটা খুলে বললেন- চিনতে পারছ না ?

আগন্তুককে দেখে চমকে উঠলেন হরমান! তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল- হা ঈশ্বর! মারকেল!

বিষন্ন সুরে মারকেল বললেন- হ্যাঁ, উইলি মারকেল! একজন অসফল অভিযাত্রী। তারপর হুকুম দিলেন- চলো, হরমান চলো; ওয়াক...!

টলমল পায়ে চলতে লাগলেন হরমান। তিনি চলেন আর আছড়ে-আছড়ে পড়েন, একটু বিশ্রাম নেন, আবার চলেন। হারমান পড়ে গেলেই পেছনে মারকেল ভারী গলায় বলেন- ওয়াক হারমান, ও..য়া..ক।

দলের সবাই নিশ্চিত হারমান মারা গেছে। বেসক্যাম্পে দলনেতাও বললেন- নাঙ্গা পর্বত আরও একজনের প্রাণ নিল।

চলতে-চলতে একসময় মারকেল বললেন- সামনে দেখো হারমান।

হারমান দেখলেন, দূরে তাঁর বন্ধুরা মালপত্র গোছাচ্ছে, একজন ছবি তুলছে, আর একজন উইলি মারকেলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পাথরে ফলক গাঁথছে। আনন্দে নেচে উঠলেন হারমান। পেছন থেকে মারকেল বললেনÑ- বিদায় হারমান।

হারমান মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন পেছনে কেউ নেই।

পাহাড়ের আনন্দ

তারপর অনেক ইতিহাস। হারমান ফিরে এলেন কিন্তু অভিযাত্রীদের অনেকে স্বীকৃতি দিতে চাইল না। স্বীকৃতি দিল না দলনেতা। এটা সম্ভব নাকি। যে মারকেলের কথা হারমান বলছেন, তিনি এই অভিযানের বহুপূর্বে মারা গেছেন। যে মারা গেছে সে কাউকে পথ দেখাতে পারে ? অবিশ্বাস্য, অসম্ভব! শোনা যায় ব্যাপারটা সে দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু ক্যামেরায় ছবি যে হারমানের হয়ে কথা বলছে! শৃঙ্গ জয়ের স্বীকৃতি পেলেন হারমান।

পরিশেষে

সমুদা সব শেষে বললেন- এত কষ্ট, যন্ত্রণা, মৃত্যু সত্ত্বেও মানুষ বারেবারে ছুটে যায় হিমালয়ে! কী আছে সেখানে ? ম্যালোরি বলেছিলেন, ‘এভারেস্টটা সেখানে আছে বলেই তো যাওয়া। হিমালয়ে আছে ত্যাগ-শৌর্য-আধ্যাত্ম-বিজ্ঞান-দর্শন আর অপার্থিব সৌন্দর্যের অনাবিল আনন্দ! তাই তো যুগে-যুগে মানুষ ঘর ছেড়ে বেছে নিয়েছে হিমালয়ের পথ।

হিমালয়ের টুকিটাকি

প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী- তেনজিন নোরগে (ভারত), এডমন্ড হিলারী (নিউজিল্যান্ড)।

প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী মহিলা- জুনকো তাবেই (জাপান)।

প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী ভারতীয় মহিলা- বাচেন্দ্রী পাল।

প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী বাঙালি- সত্যব্রত দাম।

প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী বাঙালি মহিলা- শিপ্রা মজুমদার।

বিনা অক্সিজেনে প্রথম এভারেস্ট জয় করেন- ফু দোরজি।

দু-বার এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম ব্যক্তি- নোয়াং গোম্বু।

ভারতের সর্বোচ্চ সৃঙ্গ- গডউইন অস্টিন বা কে-টু।

পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ স্থান- সান্দাকফু।

পৃথিবীর সর্বোচ্চ গ্রাম- কিব্বের (হিমাচল প্রদেশ)।

এভারেস্টের চারটি 'ফেস' দিয়ে উঠেছেন- কুশান শেরফা।

প্রথম ব্যক্তি যিনি আবিস্কার করেন এভারেস্ট বিশ্বের সর্বোচ্চ সৃঙ্গ- রাধানাথ সিকদার।

বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় উচ্চতম সৃঙ্গ- গডউইন অস্টিন বা কে-টু ও কাঞ্চনজঙ্ঘা।

বিশ্বে আট হাজার মিটার বা আরও বেশি উচ্চতার পর্বতসৃঙ্গের সংখ্যা- ১৪টি (যেমন- এভারেস্ট, মাকালু, নাঙ্গাপর্বত, লোৎসে, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি)।

উপরোক্ত ১৪টি সৃঙ্গই আরোহন করেছেন- রেনল্ড মেসনার।

বিশ্বের প্রথম শীতলতম স্থান- ফারময়ানস্ক (সাইবেরিয়া)।

বিশ্বের দ্বিতীয় শীতলতম স্থান- দ্রস (জম্মু ও কাশ্মীর)।

 

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ডিসেম্বর ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ