ক্লাবে লোকসমাগম অল্প। বর্ষণমুখর শীতের রাতে অনেকেই বাড়ি থেকে বের হয়নি। আমরা গুটিকতক ছেলেই জোঁকের মতো ক্লাবটিকে আগলে রেখেছি। ক্যারাম খেলতে আজ আর ভালো লাগছে না। সকলে চুপচাপ বসে। বয়স্কদের মধ্যে ভূতনাথবাবু একাই ছিলেন। তাই, সবাই মিলে ভূতনাথবাবুকে একটা জোরালো ভূতের গল্প বলতে অনুরোধ করলাম। যেমন বিদঘুটে কালো চেহারা তেমনি তিনি ভূতের গল্পের রাজা। বোধহয় এই কারণেই ভূতনাথ নাম তার স্বার্থক।
ভুতনাথবাবু বিড়িতে একটা দীর্ঘ সুখটান দিয়ে বললেন, বেশ তবে শোন, আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগের কথা। তোরা তখন জন্মাসনি। গ্রামে তখন লোকজন খুব কম। পথঘাট থাকত সদাই নির্জন-নিস্তব্ধ। গ্রামে বিদ্যুৎ, টেলিফোন আসেনি। রাতে টিমটিমের আলো জ্বেলে ক্যাঁচর-ক্যাঁচর শব্দে দু-একটা গরুর গাড়ি যেত। বাঁশ গাছগুলো প্রায় নুয়ে-নুয়ে পড়ত। বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ।
আমার মাছ ধরার ভীষণ শখ ছিল সে সময়। পাড়ার অনেকে তো আমাকে 'এঁশোপেতি' বলত। তবে আমি কিন্তু জাল-টাল দিয়ে মাছ ধরতাম না। রীতিমতো চার ফেলে ছিপ দিয়ে। হ্যাঁ চার তৈরিতে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই জগা দুজনেই সমান ওস্তাদ ছিলাম। কোন মাছের কি চার হবে তা ছিল আমাদের নখদর্পণে।
জগন্নাথ, মানে জগার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। মাছ ধরার সময় ও ছিল আমার সাগরেদ। ছিপ, চার, মাছ তোলার সমস্ত জিনিসই জগা বহন করত।
জগা খুব আত্মভোলা আর রসিকও। তবে মাঝে-মাঝে একটু-আধটু নেশা করত এই যা। ওকে সামান্য মাছ দিলেই ও ভীষণ খুশি হত।
সেদিন ছিল রান্না পুজোর আগের দিন। বাজারের সব মাছেরই দাম আগুন। আমরা ঠিক করলাম রাতেই মাছ ধরব। নীলকুঠি পুকুরে মাছ প্রচুর। ভালো চার করে সন্ধ্যায় পুকুরে ফেলে এলাম। গন্ধ ছড়াতে সময় লাগে। মাছ আসতেও দেরি হয়। ঠিক হল ১১টা নাগাদ আমরা যাব মাছ ধরতে। জগা আমাকে ডাকবে। আমি দুটো ছিপ, চার, কৌটো, মাছ তোলার ঝাঁপি ঠিক করে সামান্য ঘুমিয়ে নিলাম।
কত রাত হয়েছে ঠাহর করতে পারলাম না। কাক-জোছনার মতো আলো-আঁধারি। জগার ডাকে ঘুম ভাঙল। ভুতো- এই ভুতো, উঠে পড়। মাছ ধরতে যাবি যে। বললাম, কে জগা ? জগা বলল, হুঁ।
বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা গাছের তলায় বসে ঝিমুচ্ছে জগা। পরনে একটা লুঙ্গি আর রঙিন সার্ট। ঠিক যেন একটা জোকার। বললাম, তুই টিমটিমেটা নিয়ে আয়। আমি অন্যসব জিনিসগুলো নিচ্ছি।
জগা বলল, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তুই নে।
নীলকুঠি পুকুরপাড়ে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসলাম। একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে। শরীরটা খারাপ থাকায় জগা একটু দূরে বসল। ও যেন আজ বাকহীন।
পাঁচমিনিট যেতে না যেতেই ছিপে মাছ গেঁথে গেল। বড়ো রুই মাছ। একলাফে জগাও মাছটা তুলে নিল। এরপর ঘনঘন মাছ গাঁথতে থাকল। ভাবলাম কার সুন্দর মুখ দেখে যে আজ বেরিয়েছিলাম। এত তাড়াতাড়ি এত মাছ! প্রত্যেকটাই নধর, হৃষ্টপুষ্ট। ভাবতেই পারা যায় না।
জগা বলে উঠল, আজ আমায় অর্ধেক ভাগ দিতে হবে। আমার ফুস মন্তরেই এত মাছ পড়েছে। আমি খুশি হয়েই জগাকে গোটা-ছয়েক মাছ দিলাম। বললাম, এবার বাড়ি যা। অবশিষ্ট মাছ নিয়ে আমরা হাঁটা দিলাম।
চারিদিক থমথমে ভাব। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি, জগা বড়ো রুই মাছটাকে কড়মড় করে চিবুচ্ছে। লম্বা-লম্বা ওর হাত-পা। কিম্ভুত-কিমাকার শরীর। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ।
আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, জগা, একি করছিস ? কাঁচা মাছ খাচ্ছিস কেন ?
-আমি তো রোজই কাঁচা মাছ খাই? ওই দেখ শ্যাওড়া গাছে তোর বৌদিও কেমন কাঁচা মাছ চিবুচ্ছে। ভনি কাপড় গায়ে মুলোর মতো দাঁতে কাঁচা মাছ খাচ্ছে জগার বউ। দেখে আমি 'থ' হয়ে গেলাম।
বুঝতে অসুবিধা হল না যে, আমি ভূতের পাল্লায় পড়েছি। প্রেতাত্মা জগার ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। জোরে হাঁটতে শুরু করতেই ওরা নাকি সুরে বলতে থাকল, ভুঁতো, মাঁছগুঁলা দিঁয়ে যাঁ। নঁইলে তোঁর ঘাঁড় মঁটকে, রঁক্ত চুঁষে খাঁব।
কখন যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরতেই আবার চমকে উঠলাম। দেখি জগা আমাকে পাখার বাতাস করছে। বাড়িসুদ্ধ লোক। বুঝলাম এ জগা সে জগা নয়।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । জুলাই ২০১০
0 মন্তব্যসমূহ