Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মৃত্যুঞ্জয়ী যিনি ।। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

কত হাসি-কান্না দুরন্তপনা খুনসুটি হুটোপুটি দুষ্টুমিতে ভরা আমাদের ছেলেবেলা।  জীবনের এই সময়টি পেরিয়ে এসে যাঁরা অনেক বড় হয়ে যান, তাঁদের ছেলেবেলার কথা কার না জানতে ইচ্ছে করে। সেই বড় মানুষদের সেরা সময়ের গল্প কথাই দলিল হয়ে উঠল "চিরকালের ছেলেবেলা"র পাতায়-

ভারী দয়ালু ছেলে। কারও দুঃখ দেখলেই মন কেঁদে ওঠে। যেভাবেই হোক দুঃখী মানুষকে সাহায্য করেন। একটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। সেদিন ছেলেটি স্কুল থেকে ফেরেনি তখনও। মামা বৈঠকখানায় বসেছিলেন। হঠাৎই নজর চলে যায় আলমারির দিকে। পিঁপড়ের বিরাট লাইন। সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়ে চলছে আলমারির দিকে।

আলমারিতে কি আছে ? কি থাকতে পারে ? মিষ্টি আছে বোধ হয়। খুলে দেখলে কেমন হয়! মামা বসে-বসে এসবই ভাবছিলেন। ঠিক তখনই স্কুল থেকে ফিরে এলেন ছেলেটি। দ্রুত পিঠ থেকে বই-বোঝা নামিয়েই আলমারি থেকে কি যেন বের করলেন। বের করেই দৌড়। বাড়ির বাইরে, গেটের কাছে জীর্ণ-শীর্ণ একজন দাঁড়িয়েছিল। হাতের জিনিস সেই মানুষটিকে দিয়েই আবার ফিরে আসেন বৈঠকখানায়।

কি ঘটে গেল তখনো মামা বুঝে উঠতে পারেননি। অপরিসীম আগ্রহ-কৌতুহলে ভাগ্নের কাছে জানতে চাইলেন, কী ছিল আলমারিতে ? ভাগ্নে মিটিমিটি হাসেন। হাসতে-হাসতে বলেন, রুটি। আমার সকালের জলখাবার।

বইয়ের আলমারিতে যে রুটি থাকতে পারে, মামা এমনটি ভুলেও ভাবেন নি। তাই অবাক-বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, সে কি কথা- সকালে তুমি কিছু খাওনি ?

ছেলেটির মুখে আর হাসি নেই। বড়োদের মতো গম্ভীর গলায়, চোখেমুখে গাম্ভীর্যের ভাব ফুটিয়ে জবাব দেয়, ওই ভিখিরিটি সারাদিন কিছু খাইনি। আমি তো রোজ তিন বেলা খাই। ওর এক বেলাও জোটে না।

ছোট্ট ছেলেটির মুখে এমন কথা শুনে গর্বে মামার বুক ভরে যায়। আনন্দে ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরেন। কাঁপা-কাঁপা গলায়  বলেন, একদিন তুমি অনেক বড়ো হবে। অনেকঅ-নে-ক।

আবেগে মামার কণ্ঠস্বর বুঝে আসে। চোখের কোণ জলে চিকচিক করে।

সত্যি হয়েছিল সেদিনের এই আশীর্বাদ। অনেক অ- নে-ক বড়ো হয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি ভারতবাসী আজ তাঁর জন্য গর্বিত। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটি সুভাষচন্দ্র বসু। আমাদের নেতাজি।

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি জন্ম, ওড়িশার কটকে। আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার চাংড়িপোতায়। পিতা জানকীনাথ বসু। মাতা প্রভাবতী দেবী। জানকীনাথের ছিল দয়ার শরীর। তাঁর কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনো নিরাশ হত না। টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারছে না, এমন অনেক ছাত্রের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন তিনি।

মাতা প্রভাবতী দেবীও ছিলেন ভীষণ দয়ালু। অকাতরে গরিব-দুঃখি মানুষজনকে সাহায্য করতেন। বালক বয়সেই বাবা ও মা-র এই দানশীলতায়-অনুপ্রাণিত-উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র ।

সুভাষ চন্দ্রের বাল্য শিক্ষার শুরু কটকের মিশনারি স্কুলে। এই স্কুলে পড়েছেন একটানা ছয় বছর। মিশনারি  স্কুলের পর ভর্তি হন রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বেণীমাধব দাস। তাঁর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ছিল। সুভাষচন্দ্র যখন ওই স্কুলের ছাত্র, সে সময়ই তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাই বেণীমাধব দাস অন্যত্র চলে যান। খুব কষ্ট হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের। বিদায় সভায় বক্তৃতা দিতে দিতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। অবশ্য সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ এরপরও ছিল। নিয়মিত চিঠি লিখতেন। সুভাষচন্দ্রের চিঠির উত্তর দিতেন মাস্টারমশাই। প্রতিটি চিঠিতে থাকত সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা।

স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। স্বাধীনতা হীনতায় কে আর বাঁচতে চায়। সুভাষচন্দ্র ততদিনে চলে এসেছেন কলকাতায়। ভর্তি হয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রেসিডেন্সিতে তখন ইতিহাস পড়াতেন ওটেন। রাশভারী মেজাজী মানুষ। ভারতীয়দের মোটেই ভালো চোখে দেখতেন না। ঘরের সামনে পায়চারি করার অপরাধে একটি ছেলেকে ভীষণ তিরস্কার করেছিলেন। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ওটেনের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেন। দাবি তোলেন ওটেনকে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাঁকে দিতে হয় চরম খেসারত। বহিষ্কৃত হন তিনি।

সবাই ভেবেছিলেন সুভাষচন্দ্রের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল বুঝি। শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে মুশকিল আসান হয়। সুভাষচন্দ্র ভর্তি হন স্কটিশচার্জ কলেজে। স্কটিশ থেকে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে দর্শনে অনার্স বি.এ. পাস করেন। ভেবেছিলেন মনস্তত্ত্ব নিয়ে এম.এ. পড়বেন। কিন্তু তা আর হল না। পিতার নির্দেশে চলে যেতে হল বিলেতে, আই.সি.এস. পড়তে। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইল এদেশে। দেশ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে উত্তাল। দেশের ডাকে সুভাষচন্দ্র ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে ইস্তফা দিয়ে চলে এলেন স্বদেশে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ছয় মাসের কারাদণ্ড ভোগ করার পর মেলে মুক্তি। আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে। দেশ মাতাকে পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে হবে, এটাই তার লক্ষ্য, এটাই তাঁর স্বপ্ন। বহু মানুষকে পাশে নিয়ে লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে গেলেন সুভাষচন্দ্র। লক্ষ্য ছিল স্থির, অবিচল- তাই রবীন্দ্রনাথও সুভাষচন্দ্রকে দেশের নেতৃপদে বরণ করে নিয়ে ''দেশগৌরব'' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ যে যোগ্যতম মানুষটিকে যোগ্য উপাধি দিয়েছিলেন, পরবর্তী ঘটনাবলীতে তা বোঝা যায়। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে যেভাবে সুভাষচন্দ্র দেশ ছাড়েন, বিদেশে গিয়ে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করেন, তার তুলনা হয় না। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকেই তিনি ''নেতাজি'' নামে পরিচিত হন।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্রের অবদানের কোনো তুলনা হয় না। হাজার ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় প্রয়াত হয়েছেন সুভাষচন্দ্র। এমন এক সংবাদ না হলেও তা ভারতবাসী বিশ্বাস করেনা। সুভাষচন্দ্র মৃত্যুঞ্জয়ী।

 

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১২


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ