কত হাসি-কান্না দুরন্তপনা খুনসুটি হুটোপুটি দুষ্টুমিতে ভরা আমাদের ছেলেবেলা।জীবনের এই সময়টি পেরিয়ে এসে যাঁরা অনেক বড়ো হয়ে যান, তাঁদের ছেলেবেলার কথা কার না জানতে ইচ্ছে করে। সেই বড়ো মানুষদের সেরা সময়ের গল্প কথাই দলিল হয়ে উঠল "চিরকালের ছেলেবেলা"র পাতায়-
তখন তিনি একেবারে শিশু- আড়াই বছর বয়স, মারা যান তাঁর বাবা। অনেকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। একটু সুস্থ বোধ করলে বাবাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হত। অন্য পরিবেশে, অন্য জল-হাওয়ায় হয়তো একটু ভালো থাকবেন- এমন ভেবে নিয়ে যাওয়া হত কখনো গঙ্গার ধারে সোদপুরে, কখনও বা প্রকৃতিময় গিরিডিতে। বাবাকে নিয়ে অন্য কোনো স্মৃতি মনে না থাকলেও সোদপুর আর গিরিডি যাওয়ার স্মৃতি মনে ছিল। অসুস্থ শরীরেও বাবা লিখতেন, ছবি আঁকতেন। সোদপুরে জানলার ধারে বসে বাবা ছবি আঁকছিলেন আঁকতে-আঁকতেই তাঁকে লক্ষ্য করেই বলেছিলেন, ওই যে জাহাজ যাচ্ছে।
বাবার কথা শুনেই ছুটে গিয়েছিলেন উঠোনে। অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলেন ভোঁ বাজিয়ে স্টিমার চলে গেল।
বাবার সেই কথা, গঙ্গায় দেখা স্টিমার ছবি হয়ে তাঁর মনে গেঁথে রইল চিরকাল।
সবাইকে কাঁদিয়ে অকালে অসময়ে বাবা মারা গেলেন। মা পড়লেন মহাবিপদে। বাঁধ-ভাঙা শোকে, চোখের জলে প্রতিজ্ঞা করলেন ছেলেটিকে ভালো করে মানুষ করবেন। সত্যিকারের বড়ো মানুষ, সবাই যেন অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।
শুরু হল সংগ্রাম। চাকরি নিলেন এক মেয়েদের স্কুলে। ভালো গান গাইতেন তাঁর মা। রবীন্দ্রনাথও গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
মা ঠিক করলেন ছেলেকে নিয়ে একবার গুরুদেবের কাছে যাবেন। ঘুরে আসবেন শান্তিনিকেতন। ছেলের বয়স তখন বছর দশ। শান্তিনিকেতন যাওয়া, রবীন্দ্রনাথের দেখা পাওয়ার কথা ভেবে আনন্দ তাঁর আর ধরে না। রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ নেবেন বলে একটি নতুন খাতাও কিনে ফেললেন।
শান্তিনিকেতনে তখন পৌষমেলা চলছিল। মার সঙ্গে ছেলেও গেলেন উত্তারায়ণে। দেখা হল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। অটোগ্রাফ চাই শুনে কবি বললেন, খাতাটা থাক আমার কাছে। কাল এসে নিয়ে যেও।
পরেরদিন আবার গেলেন। গুরুদেব তাঁকে দেখে রেখে যাওয়া খাতাটি খুঁজতে শুরু করলেন। অনেক কাগজপত্র, খাতা বইয়ের ডাঁই- মিনিট তিনেক খোঁজাখুঁজির পর মিলল সেই খাতা। মা’র হাতে খাতাটি দিয়ে কবি বললেন, এটার মানে ও আরেকটু বড়ো হলে বুঝবে।
ছেলেটির তখন কী আনন্দ! খাতা খুলে তো অবাক, কবি তাঁর খাতায় লিখে দিয়েছেন আট লাইনের একটি কবিতা,
বহুদিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে / বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা / দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর / একটি শিশিরবিন্দু।
এই ছেলেটি বড়ো হয়ে সিনেমা তৈরি করে গোটা পৃথিবীর মানুষকেই অভিভূত করে দিয়েছিলেন। তিনি সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ রায়ের পিতা অবিস্মরণীয় ছোটোদের লেখক সুকুমার রায়। মাতা সুপ্রভা রায়। তাঁর জন্ম ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে ২রা মে।
সত্যজিতের পড়াশোনার শুরু বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজে ও শান্তি-নিকেতনের কলাভবনে। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় মাস্টারমশাই হিসাবে পেয়েছিলেন পিতৃবন্ধু অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে। শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকা শিখেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসুর কাছে।
ছবি আঁকা দিয়েই সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবনের শুরু। বিভূতিভূষণের ''আম আঁটির ভেঁপু'' বইটির ছবি আঁকতে গিয়ে ''পথের পাঁচালী'' উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমা তৈরির কথা মাথায় আসে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সমস্ত প্রতিকুলতা, আর্থিক সংকট দূরে সরিয়ে শেষপর্যন্ত ছবির কাজ শেষ হয়। ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে মুক্তি পায় ছবিটি। সত্যজিৎ রায়কে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন দর্শক-মন। একে একে করেছেন অনেক ছবি, ছোটোদের কখনও ভুলে থাকেননি। তাদের জন্য তৈরি করেছেন ''গুপী গাইন বাঘা বাইন''-এর মতো মজাদার ছবি। ছোটোদের কথা ভেবেই করেছেন নিজের লেখা ফেলুদার গল্প নিয়ে ''সোনার কেল্লা'' বা ''জয়বাবা ফেলুনাথ''।
ছোটোদের কথা ভেবে সত্যজিৎ গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার রায়ের ‘সন্দেশ’ নতুন করে প্রকাশ করেছেন।
চলচ্চিত্রকার হিসাবে সারা পৃথিবী জয় করেছেন সত্যজিৎ রায়। দেশ-বিদেশের কত সম্মান-স্বীকৃতিই না পেয়েছেন! লাভ করেছেন বিশ্ব-চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সম্মান অস্কার পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথের পর তাঁকে নিয়ে বাঙালির গর্বের অন্ত নেই।
সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান হয় ১৯৯২ খ্রীস্টাব্দের ২৩ শে এপ্রিল।
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুন ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ