Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আমার ব্যাঙাচি বড়ো হয়ে সাপ হবে ।। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়


কত হাসি-কান্না দুরন্তপনা খুনসুটি হুটোপুটি দুষ্টুমিতে ভরা আমাদের ছেলেবেলা। জীবনের এই সেরা সময়টি পেরিয়ে এসে যাঁরা অনেক বড়ো হয়ে যান, তাঁদের ছেলেবেলার কথা কার না জানতে ইচ্ছে করে! সেই বড়ো মানুষদের সেরা সময়ের গল্পকথাই দলিল হয়ে রইল এই বিভাগে-

দুখুমিয়া। সত্যি তাঁর দুঃখের শেষ নেই। ওইটুকু ছেলে, দুঃখ সইবার কী অপরিসীম শক্তি। হাজারো দুঃখ-বেদনার মধ্যেও মুখের হাসিটি কখনো হারিয়ে যায়নি। ছোটোদের কথা না তোলাই ভালো, এত দুঃখে বড়োরাই কেঁদে ফেলত। থমকে দাঁড়াত। চোখের কোল হয়তো জলে চিকচিক করত।

দুখুমিয়ার তখন মোটে আট বছর বয়েস। হঠাৎই মারা যান বাবা। অভাবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অনেকগুলি ভাইবোন, বড়ো পরিবার, সংসার আর চলে না। দিন যত যায়, অভাব ততই বাড়ে। দশ বছর বয়েসে মক্তব থেকে নিন্ম-প্রাথমিক পাস করার পর সেখানেই মেলে পড়ানোর কাজ। যারা একেবারেই ছোটো, সবে মক্তবে এসেছে, পড়াতে হত তাদের। মক্তবে পড়িয়ে আর কতই বা মেলে! অন্য কাজেরও চেষ্টা করতে হয়। মিলেও যায়। পাশের গাঁয়ে মোল্লার কাজ। ছোটো ছেলের পক্ষে সত্যি ভারি শক্ত কাজ। রংচঙে ঝলমলে ছোটোবেলা কে যেন চুরি করে নেয়।

বছর বারো বয়সে এই পড়ানোর কাজ ও মোল্লাগিরি ছেড়ে নাম লেখালেন লেটোর দলে। গান বেঁধে, এ-গাঁয়ে, সে গাঁয়ে, গান শুনিয়ে বেশ আনন্দেই কাটে। লেটোর দলে সেরা গাইয়েকে বলা হয় গোদা কবি। ওই দলের গোদা কবি মানুষটি ছিলেন বড়ো ভালো। দুখুমিয়াকে ভীষণ ভালোবাসতেন। বাচ্চা গাইয়ে, মজা করে বলতেন ব্যাঙাচি। দুখুমিয়া অনেক, অ-নে-ক বড়ো হবে, নিশ্চিন্ত ছিলেন গোদা কবি। একদিন তো গানই গেয়ে উঠেছিলেন, ‘আমার ব্যাঙাচি বড়ো হয়ে সাপ হবে।

গোদা কবির ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে-অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। লেখার কী তেজ, অসির চেয়ে মসি বড়ো, তা প্রমাণিত হয়। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন দুখুমিয়া।

দুখুমিয়া বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম।

বর্ধমান জেলার আসানসোলের কাছে চুরুলিয়া গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর, শিল্পীর রং-তুলিতে আঁকা গ্রামখানি। অজয় নদ তিরতির করে বয়ে চলেছে। খানিক দূরে আরেক নদী, ময়ূরাক্ষী। গ্রামের এক প্রান্তে বীরভূম জেলার সীমান্ত, অন্যপ্রান্তে বিহারের সাঁওতাল পরগনা।

এই গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিঃ ২৪ মে) নজরুলের জন্ম। পিতা ফকির আহম্মদ। মাতা জাহেদা খাতুন। ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়ে নজরুলের এ অনিশ্চিত টালমাটাল জীবনের শুরু হয়। হঠাৎই একদিন বাড়ি থেকে পালালেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে ভর্তি হলেন বর্ধমানের মাথরুন হাইস্কুলে। মাথরুন হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন নামজাদা কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। এ স্কুলে নজরুল অবিশ্যি বেশিদিন পড়েননি। মাথরুন স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আসরে-আসরে ঢোলক বাজিয়ে, গান গেয়ে বেশ আনন্দেই ছিলেন নজরুল। দরাজ গলায় ধরতেন গান। সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হত, তন্ময় হয়ে শুনত। সেই আসরে শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন অন্ডালের ব্রাঞ্চলাইনের এক গার্ডসাহেব। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে নজরুলকে দিলেন চাকরির প্রস্তাব। নজরুলও রাজি হয়ে গেল। গার্ডসাহেবের সঙ্গে চললেন তাঁর প্রসাদপুরের বাংলোয়।

কিন্তু গার্ডসাহেব মানুষটি মোটেই সুবিধার ছিলেন না। তাই নজরুল সে কাজ ছেড়ে কাজ নিলেন রুটির দোকানে।

দোকানে হাড়ভাঙা খাটুনি। রাতে যে একটু আয়েস করে ঘুমোবেন, তারও উপায় ছিল না। শুতে যেতে হত দোকানের কাছের এক বাড়িতে। শুতে হত সিঁড়ির নীচে।

এইভাবে যে সিঁড়ির নীচে প্রতিদিন রাত কাটিয়ে যায় এক কিশোর, তা বাড়ির কেউ জানত না। হঠাৎই একদিন বাড়ির মালিক কাজি রফিজউল্লাহের চোখে পড়ে গেল। পরের দিন নজরুলকে পাকড়াও করে। নজরুল তাঁর দুঃখময় জীবন-কথা শোনাতে বাধ্য হন।

দয়ালু মানুষ। সব শুনে মনে দয়া জাগে। ঠিক হয় আর রুটির দোকানে কাজ নয়। নজরুল কাজি রফিজউল্লাহের বাড়িতেই থাকবেন।

স্নেহ-ভালোবাসা আর নিরাপত্তায় নজরুলের অশান্ত জীবনে শান্তি ফিরে আসে। কাজটাজ সেরে একটু অবসর পেলেই বই নিয়ে বসতেন। মনে পড়ে যেত সেই মক্তবের স্মৃতি, মাথরুন স্কুলের কথা। স্বপ্ন দেখতেন আবার স্কুলে যাবেন। একদিন সেই কথা জানান রফিজউল্লাহ সাহেবকে। শুনে খুশি হন তিনি। খুশি-ঝরা গলায় বলেন, পড়বে, নিশ্চয়ই তুমি স্কুলে পড়বে। আমি ভর্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

নজরুল মন দিলেন নিজেকে গড়ার কাজে। বাধা এসেছে, সব বাধা দুহাতে সরিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন।

নজরুল কবিতা লিখে, গান বেঁধে পরাধীন ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ছোটোদের জন্যেও লিখেছেন অনেক ছড়া-কবিতা।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কবি। কবির কলমও থেমে যায়। এইভাবে অসুস্থ হয়ে কেটেছে সুদীর্ঘকাল। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট বাংলাদেশের ঢাকা শহরে মারা যান তিনি।

 

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ