বনের ধারে বস্তিতে একদল কাঠুরিয়ার বাস। গভীর বন থেকে মধু, মোম, জ্বালানি কাঠ, সংগ্রহ করে এনে তারা বাজারে বিক্রি করে। মাঝে মাঝেই হিংস্র বাঘ, সিংহ, হাতির সামনে পড়ে দু-এক জন প্রাণও হারায়। তবুও এভাবেই ওরা বাঁচে, এটাই ওদের জীবিকা। এত দরিদ্রতার মধ্যেও ওরা সৎ, সরল, সাহসী ও কর্মঠ। বন ওদের বন্ধু, ওদের প্রাণ। সবুজ অরণ্য, ওরা কখনো ধ্বংস করে না। মরা গাছ, শুকনো ডাল জ্বালানি হিসেবে কেটে আনে ঠিকই, কিন্তু সবুজ-সজীব গাছে কখনো হাত দেয় না। ওরা জানে, গাছ না থাকলে ওরাও বাঁচবে না।
কাঠুরিয়াদের মধ্যে দু-জন ছিল খুব ধূর্ত আর অসৎ। একজনের নাম জংলি, অন্যজনের নাম তুফান। দুজনের খুব বন্ধুত্ব। এক সঙ্গেই থাকে। লোকে ওদের বলে জংলি-তুফান। অন্ধকার জগতের কাঠের চোরা-কারবারীদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে। জ্বালানি কাঠের আড়ালে, ওরা বন থেকে মূল্যবান চন্দনবৃক্ষ কেটে এনে, তাদের পাচার করে। মোটা টাকা কামায়। অন্য কাঠুরিয়ারা সে কথা জানে না। শুধু ভাবে, ওদের এত টাকা-পয়সা কোথা থেকে হচ্ছে ? জংলি-তুফান কখনো দলের সঙ্গে কাঠ কাটতে যায় না। আলাদাভাবে দুই বন্ধু বনে যায়। তাদের বিপদ বেশি। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়। কিন্তু তারচেয়েও বেশি ভয়, ওদের এই আসাধু কারবারের কথা যদি দলের অন্য সব লোকেরা জেনে ফেলে! দু'একদিন আগে ওরা ঘুরে-ঘুরে, বনের কোথায় চন্দন বৃক্ষ আছে দেখে জায়গাটা চিহ্নিত করে আসে। তারপর সময়মতো গিয়ে গাছ কেটে, হিসেব মতো করে জ্বালানি কাঠের মধ্যে ভরে বন থেকে বেরিয়ে আসে। ওদের অত্যাচারে বনের এ-দিকটায় চন্দন বৃক্ষ প্রায় ধ্বংসের মুখে।
ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ্য করেন বনদপ্তরের রেঞ্জ-অফিসার মিস্টার অলোকরাজ। সহকর্মীদের নিয়ে বন পরিদর্শনে এসে তিনি দেখেন, বনের এক দিকটায় চন্দনবৃক্ষ প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা গাছ, যেন সদ্য কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! এত নিরাপত্তা থাকার সত্বেও, বনরক্ষীদের নজর এড়িয়ে কি ভাবে দিনের পর দিন চন্দনবৃক্ষ চুরি হয়ে যাচ্ছে ? -সেই কথাটাই বারবার ভাবতে থাকেন। এলাকার নজরদারি ও বন পুলিশকর্মী আরো বাড়িয়ে দিলেন। গোপন তথ্য আদান-প্রদানের জন্য নিয়োগ করলেন গুপ্তচর। যেমন করেই হোক, চন্দন-চোরাকারবারীদের ধরতেই হবে। প্রয়োজনে তিনি বারবার বন পরিদর্শনে আসবেন, কথাটা ভাবতে-ভাবতে সেদিনের মতো ফিরে গেলেন।
আগের দিন নদীর ধারে বেশ পুরুষ্টু চন্দনগাছটা দেখে এসেছে তুফান। শীতের চাদর
খুলে বসন্তের হাওয়ায়, গাছটা যেন নতুন
করে সেজে উঠেছে। সবুজ পল্লবে ভরে গেছে সারা দেহ। আবেশি গন্ধে মউ-মউ করছে চারিদিক।
অতি সতর্কতায় কুঠার হাতে দুজন ঢুকে পড়ল বনের ভিতর। কাপড়টা শক্ত করে কোমরে বেঁধে,
কুঠার দুখানা তুলে ধরতেই
চমকে উঠল। পুলিশের গাড়ি। গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে গেছেন অলকরাজ। সদলবলে বেরিয়ে
পড়েছেন অভিযানে। পুলিশের গাড়ি দেখেই জংলি ও তুফান দুজনেই কুঠান দুখানা নদীর জলে
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, একটা নিশানা রেখে,
একটু সরে গিয়ে কি যেন খোঁজার
ভান করতে লাগল। গাড়ি থেকে নেমে এসে অলকরাজ জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে কি করছ ? নিত্যান্ত গোবেচারার মতো মুখ করে দুজনে বলে উঠল,
আঁজ্ঞে গরু! গরু হারিয়ে
গেছে, খুঁজেছি! অলকরাজ সন্দেহের চোখ মেলে, আপাদমস্তক ওদের দেখে নিলেন। না, সঙ্গে বা আশেপাশে গাছ কাটার কুঠার বা করাত কোনো
যন্ত্রই নেই। চন্দনবৃক্ষটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অক্ষত রয়েছে। তাই হবে, ওরা গরু খুঁজতেই এসেছে! এসব ভেবে গাড়ি ঘুরিয়ে
ফিরে গেলেন।
পুলিশের গাড়িটা চলে যেতেই, জংলি ও তুফান নদীর জলে নেমে, নিশানা বরাবর গিয়ে জল থেকে কুঠার দুখানা তুলে এনে, বাড়ি ফিরে গেল। ভাবতে লাগল, বুদ্ধির জোরে এ-যাত্রায় খুব বেঁচে গেছি! দু-এক দিন পর নজরদারি একটু কমলে গাছটা কেটে আনা যাবে!
লোভ আর সামলাতে পারল না ওরা, দুদিন যেতে না যেতেই আবার কুঠার হাতে বেরিয়ে পড়ল দুই বন্ধু। গাছটা কেটে আনতেই হবে! অনেক টাকা পাওয়া যাবে! ঠিক করল- জংলি লক্ষ্য রাখবে আর তুফান গাছটা কাটবে। গাছটার কাছে এসে তুফান দেখল, আজ যেন চন্দনগাছটা অন্যরকম সেজেছে। সবুজ পত্র-পল্লবে আচ্ছাদিত গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন চোখের জলে আকুতি জানাচ্ছে- আমাকে মেরো না! তুফান গাছের কাছে আসতেই, এক ঝাঁক বুনো পাখি তাকে ঘিরে উড়তে লাগল। গাছটা যে তাদের আস্তানা। সমবেত কলতানে তারা যেন বলতে থাকল, তোমরা গাছটা কেটো না। ক্ষণিক বিহ্বালতা কাটিয়ে, নিষ্ঠুর তুফান কুঠার হাতে তুলে নিল।
ওরা যে কুঠার হাতে বনে ঢুকেছে, সে কথা গুপ্তচর মারফত পৌঁছে গেছে অলকরাজের কানে। সোজা পথে না এসে, ঘুরপথে গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছে তুফানের কাছাকাছি। এরপর হাঁটতে হবে। নজরদারিতে থাকা জংলির প্রথমে চোখে পড়েনি, হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ শুনে পড়িমড়ি করে ছুটে খবরটা দিতে আসে তুফানের কাছে। কুঠারটা হাতে তুলে থমকে যায় তুফান। কী সর্বনাশ! পুলিশের গাড়ি! আর সময় নেই! আগের মতোই কুঠার দুখানা নিমেষে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, গাছটার কাছ থেকে সরে এসে, নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করতে থাকে। ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে চলে এসেছেন অলকরাজ। ওদের দুজনকে দেখে চমকে ওঠেন। একি! সেই চেনা মুখ! গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠেন, কি, এতদিনেও গরু খুঁজে পাওনি তোমরা ?
-আঁজ্ঞে, না হুজুর। গরুটা খুব দুষ্টু কিনা! আমতা-আমতা করে উত্তর দিল তুফান।
অলকরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন, দুজনের মুখেই অপরাধবোধের সুস্পষ্ট ছায়া। ওদের কাছে বা আশেপাশে ঝোপঝাড়ে গাছ কাটার কোনো যন্ত্র লুকোনো আছে কিনা, খুঁজে দেখার জন্য সহকর্মীদের নির্দেশ দিলেন। অনেক খোঁজা-খুঁজি হল, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। হঠাৎ অলকরাজের দৃষ্টি পড়ল নদীর দিকে, ওখানকার জল এত লাল কেন! দেখে মনে হচ্ছে রক্ত! দেখার নির্দেশ দিতেই দুজন সাহসী পুলিশ নদীতে নেমে গেল। অবাক হয়ে দেখে, একটা বিশাল আকারের বোয়াল মাছের পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছে। আর তার শরীর গেঁথে রয়েছে একটা ধারালো কুঠার। নদীর ধারের ছোটো-ছোটো মাছগুলো খেতে এসেছিল সে। আচমকা ছুঁড়ে ফেলা তুফানের কুঠার দুখানার একটা গেঁথে যায় তার পেটে, আর পালাতে পারেনি মাছটা। কারো কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না। ধরা পড়ে গেল জংলি-তুফান। পুলিশের জেরায় একে-একে সব অপরাধ স্বীকার করল তারা। কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে ওদের তোলা হল পুলিশ-গাড়িতে। অলকরাজ বসলেন চালকের আসনে।
গাড়ি ছেড়ে দেবার মুহূর্তে হঠাৎ একঝাঁক পাখির কিচির-মিচির শব্দে ফিরে তাকালেন, দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য! অজস্র বনের পাখি এসে বসেছে চন্দনবৃক্ষটার ওপর। বসন্তের হাওয়ায় গাছটা খুশিতে দুলছে, আর পাখিরা শিস দিয়ে তালে-তালে গাইছে-
'বন্ধু তুমি বাঁচালে যখন আমাদের প্রাণ,
পরে যাও ভালো চন্দন-টিপ
নিয়ে যাও কিছু সবুজ ঘ্রাণ!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ