রাজামশাই সবদিকেই সুখী। তবে বর্তমানে একটি বিষয়ে তিনি ভীষণ চিন্তিত। তাঁর রাজ্যের শেষ সীমান্তে আছে গভীর এক জঙ্গল আর তারপরেই আছে বিশাল পাহাড়। সেই পাহাড়ের গুহায় কোথা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে ভয়ঙ্কর এক দৈত্য।
সে প্রায়ই লোকালয়ে আসে আর দু-দশজনকে ধরে নিয়ে যায়। গুহায় গিয়ে আরামসে ওদের কড়মড়িয়ে খায়। রাজামশাই-এ খবর আগেই পেয়েছিলেন। কালবিলম্ব না করে তিনি কয়েক হাজার সৈন্যসহ সেনাপতিকে পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু হায়! দৈত্য বীরবিক্রমে বেরিয়ে এসে একটা হুংকার দিতেই অর্ধেক সৈন্য ভূমিসাৎ হয়েছে। সেনাপতি গর্জন করে নির্দেশ দেয়, আক্রমণ। তবে বেশি সময় লাগেনি। সেনাপতি কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গিয়েছিল। কতক আছড়ে, কতক খাদ্য হিসেবে। আর অবশিষ্ট হাত-পা ভাঙা, চোখ উপড়ানো অবস্থায় রাজার কাছে ফিরে ছিল।
রাজা সবদিক ভেবে ঠিক করলেন ব্যাপারটা শুধু কঠিন নয় একেবারে আয়ত্তের বাইরে। তবে আয়ত্তের বাইরে বলে তো আর বসে থাকলে চলবে না। সে তোর রাজ্যের ভিতরে এসে প্রতিদিন লোকজনকে খেয়ে নিচ্ছে। একদিন তো জনশূন্য হয়ে যাবে। রাজা থাকবেন কাদের নিয়ে!
রাজা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সৈন্য সজ্জিত করে নিজেই আক্রমণে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। হয় তিনি থাকবেন, না হয় দৈত্য। কিন্তু সৈন্যরা সব মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। ইচ্ছে করে কে আর মরণকে জড়িয়ে ধরে। এমন অবস্থায় রাজা হুংকার দিয়ে বললেন, তোমরা কান খুলে শোনো- আমি বলছি যুদ্ধে তোমাদের যেতেই হবে। গেলে দৈত্যের হাতে মরতে হতে পারে, কিংবা নাও পারে। কিন্তু, না গেলে আমার হাতে মরতে হবে।
এরকম কথাবার্তা হচ্ছে, হঠাৎ একটা প্রবল ঝড় এল। রাজপ্রাসাদ যেন কেঁপে উঠল। রাজা বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার কি ? উত্তর শোনার সময় পাওয়া গেল না। মেঘের মতো দৈত্য এসে নিজেই বলল, আমিই এসেছি।
সত্যিই মেঘাকৃতি দৈত্য। বিশাল শরীর। কোমরটা কয়েকটা বটগাছের মতো মোটা। মোটা তালগাছের মতো পা। পরনে বাঘ ছালের মতো একটা অদ্ভুত পরিচ্ছদ। বুকটা বোটের পাটাতনের মতো চওড়া। মাথাটি মাঝারি একটা জালার মতো। চুল নেই মাথায়। শিয়ালের লেজের মতো গোঁফ। দাড়িতে বুরুসের মতো একগোছা চুল।
দৈত্যকে দেখে রাজা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। রানী, রাজকুমারী, রাজপুত্ররা ভয়ে রাজার কাছে এগিয়ে এল। রাজা চিৎকার করে বললেন, তুই আমার শান্তির রাজ্যে জ্বালাতন করতে এসেছিস কেন ?
দৈত্য কুলোর মতো কান নেড়ে বলল, না-না, আমি আর জ্বালাতন করব না। এ-রাজ্যে আর থাকব না। আপনারও কোনো ক্ষতি করব না। আপনি একটি শর্ত মানলে আপনার সব শর্ত মানব।
অকস্মাৎ পরিবেশ একটু বদলে গেল। রাজা একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, বলো তোমার কি শর্ত ? দৈত্য দেরি না করে বলতে শুরু করল, শুনেছিলাম রাজকুমারী সুন্দরী। স্বচক্ষে দেখলাম কথাটা সত্যি। আমি রাজকন্যাকে বিবাহ করতে চাই। আপনি কন্যাদান করুন এটাই আমার শর্ত।
হঠাৎ যেন মেঘ ডেকে উঠল। বজ্রপাত হল রাজপ্রাসাদের উপর। রাজা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। রাজকন্যা ভয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। মা তো দিশেহারা, এরপর কি হবে এই ভেবে।
দৈত্য হাসি মিশিয়ে বলল, কেন, আমি তো অযোগ্য নই। দশখানা রাজ্য জয় করে দেব। সোনাদানা, মণিমুক্তা ভরিয়ে দেব। শত্রুরা ভয়ে এমুখো হবে না। আর আমি, আমার চেহারা এই নিয়ে আপত্তি ? বেশ, দেখুন আমার সেই লুকনো চেহারা।
কী আশ্চর্য! দেখতে-দেখতে সেই দৈত্যাকৃতি চেহারাটা কোথায় মিলিয়ে গেল। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল একটি সুঠাম চেহারার যুবক। সত্যিই যেন আর একটা রাজপুত্র।
ব্যাপারটা দেখে সকলে যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। রাজামশাই কি বলবেন ঠিক করতে পারলেন না। মানুষের মতো ছোট-ছোট পা ফেলে দৈত্য রাজার কাছে এল। সুকন্ঠে বলল, রাজকন্যাকে স্বেচ্ছায় দিলে সব বাঁচবে। না দিলে প্রথমে প্রজাকুল মরবে। তারপর রাজা ধ্বংস হবে। সবার শেষে রাজকুমারীকে আমি জোরপূর্বক বিবাহ করব। নিন, ঠিক করে বলুন, কোনটা বেছে নেবেন। এক্ষুনিই বলুন।
রাজা তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতই ছিলেন। তিনি সবেমাত্র আদেশ দেবেন, আক্রমণ। এমন সময় তাকে থামিয়ে রাজকন্যা বলল, না যুদ্ধ হবে না আমার জন্য একজনও মরবে না। আমি দৈত্যের কথায় রাজি।
দৈত্যের মুখে হাসি ফুটল। রাজা-রানী-রাজপুত্র তো হতবাক। কিন্তু রাজকন্যাকে বাধাও দিত পারল না কেউ। তারপর রাজকন্যা বলল, তবে আমার একটা শর্ত আছে। বিবাহ হবে একপক্ষ কাল পরে।
দৈত্য তো দারুণ খুশি। হাসতে-হাসতে বলল, ঠিক আছে আমি একপক্ষ কাল পরে বিবাহ করতে আসব। আজ এই পর্যন্ত। বলেই সেই রাজপুত্রের ছোট্ট চেহারাটা ফুলে উঠতে লাগল। একটু পরে আবার সেই দৈত্যের রূপ ধারণ করল। বড়ো-বড়ো তালগাছের মতো পা দিয়ে রাজপ্রাসাদের প্রাচীরের উপর দিয়ে বাইরে গিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল।
রাজকন্যা তো কথা দিয়েছে। রাজা-রানী-রাজপুত্র দাদা সে কথা মানতে নারাজ। রাজা বললেন, এর থেকে আমরা সবাই মরব। তোমার জীবন নষ্ট করে কাপুরুষের মতো বাঁচতে চাই না। রানী বোঝায়, রাজপুত্র দাদা বোঝায়, অনেক বোঝানোর পর সিদ্ধান্ত হয়- বিনা যুদ্ধে রাজকন্যাকে দেওয়া হবে না।
রাজ্যে ঘোষণা করে দেওয়া হয়- দৈত্যকে বধ করে যে রাজকন্যাকে রক্ষা করতে পারবে তাকে রাজকন্যা এবং রাজ্যের অর্ধেকটা দান করা হবে।
ইতিমধ্যে ঘটনাটা কারোর অজানা ছিল না। কেউ শুনেও ঘটনাটা না শোনার ভান করল। তবে যুগে-যুগে ধরিত্রী মাতা তো বীর সন্তানের জন্ম দিয়েই থাকেন। তেমনই এক বীর-বুদ্ধিমান খবরটা শুনে রাজার কাছে এসে পৌঁছল। আর বলল, আমি ওই দুষ্টু দৈত্যকে বধ করব আর রাজকন্যাকে রক্ষা করব।
সে রাজামশাইকে ডেকে একান্তে কিছু কথা বলল। দৈত্যকে শেষ করতে গেলে কিছু কাজে তাকে সাহায্য করতে হবে। রাজা খুশী মনে বললেন, তুমি যা চাও সব পাবে। আগে দৈত্য বধের জন্য চিন্তা করো।
দশ-বারোটা দিন প্রস্তুতি নিতে সময় লাগল। তারপর পক্ষকাল পার হল। বিবাহের যোগ এসে গেল। দৈত্যের নিজের হাজির হবার কথা। কিন্তু বুদ্ধিমান বাজনাদার, সৈন্য-সামন্ত, লোহার বিশাল এক পালকি সমেত বেশকিছু শক্তপোক্ত বাহক নিয়ে দৈত্যের গিরিগুহার সামনে হাজির। জোরে ডাক ছেড়ে বুদ্ধিমান হাঁক ছাড়ল। আমি কন্যা পক্ষের দূত এসেছি। আপনাকে আদর করে সমারোহে নিয়ে যাবার জন্য। বাজনাদার বাজনা শুরু করল। এসবকিছু শুনে দৈত্য বেরিয়ে এল। দেখে তো সে অবাক। খুশিও হল খুব। বলল, আমি তো সবে মাত্র যাত্রা করব বলে তৈরি হচ্ছিলাম। বুদ্ধিমান বললে, তা কেন ? আজ আপনি পায়ে হেঁটে যাবেন কেন ? পালকি এনেছি। এরা বয়ে নিয়ে যাবে। রাজার হুকুম। কিন্তু আমরা চাই আপনি সেই রাজপুত্রের বেশে চলুন।
দৈত্য গদগদ খুশিতে বলল, বেশ ভালো কথা। কিন্তু গলার এই তাবিজটা সঙ্গে রাখতে হবে। বাকি সব এখানে থাক। দরকার নেই। বুদ্ধিমান বলল, কেন ? কেন ? আনন্দের অতিশয্যে দৈত্যের বুদ্ধিভ্রম ঘটল। বলল, তুই কি বুঝবি রে পুচকে ছেলে ? এতে আমার প্রাণ আছে। কেবলমাত্র কোনোভাবে আগুনে গলিয়ে সব শক্তি, বুদ্ধি, মায়া, বিনষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখন-
থামিয়ে দিয়ে বুদ্ধিমান বলল, সে কথা আমার জানার দরকার নেই। আমি রাজার কর্মচারী মাত্র। আদার ব্যাপারী আমি, জাহাজের খবর জেনে আমার লাভ কি! আপনি বর সেজে পালকিতে এসে বসুন। তারপর সব কাজ আমাদের।
দৈত্য সেই রাজপুত্রের বেশে পালকিতে উঠল। এক্কেবারে খাঁটি বর। ফুলের মালা, টোপর-চন্দনের টিপ সবকিছু ঝকমক করে জ্বলছিল যেন।
সৈন্য-সামন্ত, বাজনাদার আর বাহক এসে পালকি নিয়ে থামল নবনির্মিত একটি প্রাসাদে। সেখানে বাজনা বন্ধ হল। সবাই চলে গেল বিশ্রামের জন্য। দৈত্য বলল, এখানে কি হবে ?
বুদ্ধিমান বলল, এখানেই তো বিবাহের আয়োজন করা হয়েছে। বিবাহের জন্যই তো এটা নতুন নির্মাণ করা হয়েছে। দৈত্য বলল, যেন অন্যরকম দেখছি! কি দিয়ে তৈরি হয়েছে ভবনটা ?
হাসতে-হাসতে বুদ্ধিমান বলল, গলা দিয়ে। গালার কথা শুনে দৈত্য বলল, গালা ? সেটা আবার কি ? বুদ্ধিমান বলল, বলে ঠিক বোঝানো যাবে না। কাজ করে দেখাতে হবে। দৈত্য বলল, তার মানে ? বুদ্ধিমান বলল, পুরোনারীগণ হাজার প্রদীপ নিয়ে আসবে। তোমাকে বরণ করে নেবে। দৈত্য বলল, তারা কোথায় ? বুদ্ধিমান বলল, ওই যে- বলার সঙ্গে-সঙ্গে চারদিকে আগুন জ্বলে উঠল।
জতুগৃহ নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশাল দেয়াল, ছাউনি ইত্যাদি সব গালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তাতেই একজন আগুন লাগিয়ে দিল। চারিদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সে কি ভয়ানক আগুন আর তার লেলিহান শিখা!
দৈত্য এতক্ষণ পরে সব বুঝতে পেরে হুংকার দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে ছলনা ? রাজা তোকে কুবুদ্ধিতে আমাকে মারতে রেখেছে! মরবি, সবংশে মরবি। এই কথা বলে বিশাল গর্জন করে পালকির ভিতরে মারল এক বজ্র ধাক্কা। আর তাতেই মড়মড় করে পালকি ভেঙে গেল। তার টুকরোগুলো দূরে-দূরে ফেলে দিয়ে জ্বলন্ত ছাদ ফুঁড়ে পাহাড়ের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াল। ছোট ঘরের ছাউনির মতো পায়ের পাতা দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকল।
বুদ্ধিমানও কম যায় না। তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিল সে। শনশন করে চালিয়ে দিল দুটো সুতীক্ষ্ণ তীর। লক্ষ্য দৈত্যের চোখ দুটো। কিন্তু কি আশ্চর্য! চোখের মণি যে পাথরের, তাই তাতে ধাক্কা লেগে তীর চুর-চুর হয়ে ভেঙে পড়ে গেল। তবুও বুদ্ধিমান দমে গেল না। ঝড়ের বেগে কয়েকশো তীর ছুড়ে দিল এক পলকে। দৈত্য ক্রুদ্ধ হয়ে বেশিরভাগই নষ্ট করে দিল। তবে কিছু তীর তার শরীরে গেঁথেও গেল ছোটখাটো কাঁটার মতো।
এদিকে আগুন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সেই ভয়াল লেলিহান শিখা যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। বুদ্ধিমান দেখছে, দৈত্যের গলার তাবিজটা দুলছে। এই অবস্থায় দৈত্য বুদ্ধিমানকে আক্রমণ করতে এগিয়ে যায়। বুদ্ধিমান বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একটু কোণের দিকে সরে যায়। লক্ষ্য স্থির রেখে সব শক্তি এক করে দুটো পরপর তীর ছুড়ে দিল তাবিজটা লক্ষ্য করে। একটি বাধা পেল, অন্য তীরটি দৈত্যের বেখেয়ালেই তীব্র গতিতে তাবিজটা তার গলার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পড়ল বিশাল অগ্নিকুণ্ডে। সর্বনাশ বুঝে দৈত্য চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকারে আকাশ যেন ভেঙে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও দৈত্য আর সে প্রাণের মূল্যবান তাবিজ খুঁজে পেল না। আগুনে পুড়ে নিমিষেই গলে তরল হয়ে গেল। দৈত্যের সব বুদ্ধি, শক্তি, মায়া ধীরে-ধীরে শক্তিহীন হতে থাকল। এই সুবর্ণ সুযোগে বুদ্ধিমান ঝাঁকে-ঝাঁকে তীর চালিয়ে দিল। দৈত্যের সারা শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে গেল সেই তীরগুলো। রক্ত ঝরে পড়তে থাকল। তার ওপর আগুন লেগে গেল দৈত্যের গোটা শরীরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছটপট করতে-করতে মারা গেল বিশালকার দৈত্য।
রাজামশাই রাজপ্রাসাদের উপর থেকে বুদ্ধিমানের সব বীরত্ব দেখে ধন্য-ধন্য করতে থাকলেন। রানী, রাজপুত্র খুশি ভীষণ। রাজকুমারের মুখে মধুর হাসি ফুটে উঠল। চতুর্দিকে 'ধন্য বীর', 'ধন্য বীর' রব উঠল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬
0 মন্তব্যসমূহ