Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হনুমান ।। মনোজিৎ গাইন



বসিরহাটের নদে গ্রামে হনুমানের খুব উপদ্রব বেড়েছে। চারিদিকে খুব হৈ-চৈ হচ্ছে এই নিয়ে। যেকোনো সময় যেকোনো বাড়িতে হনুমান ঢুকে পড়ছে। তারপর ফলমূল, শাকসবজি যা পাচ্ছে তাই নিয়ে হাওয়া। কত বাড়ির যে কত টালি হনুমানের লাফানোর চোটে ভেঙেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

সেদিন কলুপাড়ার রফিক ভাইয়ের মেয়ে রেহেনাকে হনুমানে কামড়ে দিয়েছে। ওকে আবার হসপিটাল থেকে অ্যান্টি-ব়্যাবিস ইনজেকশন নিতে হয়েছে।

আর একদিন হয়েছে কি, বামুন পাড়ার চাটুজ্জেদের মেয়ে পিচু রাস্তা দিয়ে আসছিল। আর সেই সময় এক হনুমানও দুলকি চালে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। দু-জনেই দু-জনকে ভয় পেয়ে ছুট লাগাল। আর একসাথে ছুটতে গেলে যা হয়- হনুমান আর পিচু দু-জনেই দু-জনের পায়ে পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। হনুমানটা তো রেগে দাঁত খিঁচিয়ে পিচুর গালে দিয়েছে কষিয়ে এক থাপ্পড়। তবে আঁচড়ে বা কামড়ে দেয়নি বলেই রক্ষে।

কিন্তু এরপর থেকে আরেক ঝামেলা শুরু হয়েছে। পিচুকে সবাই 'হনুমানে ল্যাঙ' মেরেছে বলে খ্যাপাচ্ছে। শুনেই পিচু রেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে।

পাশেই ধান্যকুড়িয়া গ্রামে একজন অদ্ভুত লোক থাকে। তাকে সবাই ট্যাঁপাদা বলে ডাকে। সে বলে, সে নাকি আগে সাংবাদিক ছিল। নিন্দুকেরা তাই শুনে আড়ালে বলে, হ্যাঁ ছিল, তবে আগের জন্মে। একমাত্র এই ট্যাঁপাদাই হনুমানের ব্যাপারে খুব আনন্দিত, কেন না অনেক খবর তৈরি করা যাচ্ছে বিভিন্ন কাগজে। সেদিন নাকি 'প্রতিসকাল' কাগজে 'নদে গ্রামে হনুমানের উপদ্রব' বলে একটা স্কুপ নিউজ বেরোনোর পর পঞ্চায়েত অফিসে একটা ফোন এসেছিল, তাতে যে ফোন করেছিল সে নাকি পঞ্চায়েত প্রধানকে বলেছে, তোমাদের গ্রামে ট্যাঁপা নামে যে বীর হনুমান রয়েছে, সেটাকে আগে তাড়াও, তাহলেই সব হনুমান পালাবে।

হনুমানের জ্বালায় সমস্ত গ্রাম জুড়েই এক অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। একে তো থামাতেই হবে। গ্রামের মুরুব্বীরা একটা সভা ডাকলেন হনুমান সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায় তাই নিয়ে। সেখানে আলোচনায় ঠিক হল যেহেতু হনুমানকে মারা যাবে না, তাই হনুমান কে ধরে ছেড়ে দিয়ে আসলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে ? হনুমান কে ধরবে ? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।

এই সমস্যার সমাধান ট্যাঁপাদাই বার করল। প্রস্তাব দিল, বনদফতরের খবর দেওয়া হোক, ওরাই একমাত্র হনুমান ধরতে পারবে।

সেই অনুযায়ী বসিরহাটে বনদপ্তরে খবর দেওয়া হল। একদিন বনদপ্তরের কর্মীরা সদলবলে চলে এলেন। ওনারা এসে প্রথমেই স্বীকার করে নিলেন, এতদিন ওনারা শেয়াল, কুকুর, বনবেড়াল এমনকি একবার হিঙ্গলগঞ্জে গিয়ে বাঘও ধরেছেন। কিন্তু হনুমান কোনোদিন ধরেননি। সুতরাং হনুমান ধরতে গ্রামবাসীরা যেন একটু সহযোগিতা  করে।

ট্যাঁপাদার নেতৃত্বে গ্রামের কয়েকজন সাহায্যের হাত বাড়াতে রাজি হলেন। বনদপ্তরের কর্মীদের সঙ্গে একদল ছেলেপিলেও চলল। হনুমানের দেখা মিলল নদের শেষ সীমানায় যুগের বাগানে। ওরা তখন আনন্দ করে কচি-কচি আম খাচ্ছে। বন দফতরের কর্মীরা সেই আম গাছের নিচে জাল পেতে হনুমানদের তাড়া করতে লাগল। কিন্তু এইভাবে কি আর অনুমান ধরা যায়! হনুমানগুলো বনদপ্তরের কর্মীদের বারবার হই-হই শুনে বিরক্ত হয়ে কাঁচা আম টপাটপ ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগল। এই আম বৃষ্টিতে বনদফতরের কর্মীরা হতচকিত। নিজেদের মাথা বাঁচাতে যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল। একজন তো ছুটতে গিয়ে গোবরে পা পিছলে সজোরে পড়ল, আর ওই পড়া দেখে বাচ্চাদের সে কি হাততালি, ট্যাঁপাদা তো থামাতেই পারে না।

কিন্তু এভাবে চললে তো হবে না। হনুমানদের লিডার বীর হনুমান কে ধরতেই হবে। প্ল্যানটা ট্যাঁপাদাই দিল। বীর হনুমানকে আম গাছ থেকে নামানোর একদম সলিড প্ল্যান। বীর হনুমান নাকি আরেকটা বীর হনুমান দেখলেই তেড়ে আসে। একটা বীর হনুমান যদি গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই গাছের ওই বীর হনুমান নিচে আসতে গিয়ে জালে আটকে যাবে। কিন্তু আর একটা বীর হনুমান কোথায় পাবে ? তাহলে কাউকে হনুমান সাজিয়ে কাজটা সম্পূর্ণ করতে হবে।

অনেক প্ল্যান-পোগ্রাম করে ট্যাঁপাদাকেই জোর করে হনুমান সাজার অনুরোধ করা হল। কিন্তু হনুমানের সাজ কোথায় পাবে ? সমাধান দিল দক্ষিণপাড়ার সন্তুদা। বলল, গত বছর রাসেরমেলায় স্বরূপদার দল 'হনুমানের লঙ্কাকাণ্ড' পালা করেছিল। সরূপদার কাছে পেয়ে যেতে পারিস' সঙ্গে-সঙ্গে কয়েকজন গিয়ে জোগাড় করে আনল সেই পোশাক' মুখে কালি মেখে আর হনুমানের পোশাকটা পড়ে ট্যাঁপাদাকে বেশ হনুমান-হনুমানই লাগছিল' এবার শুরু হবে লঙ্কাকাণ্ড।

হনুমান সেজে ট্যাঁপাদা আম গাছের তলায় গিয়ে হনুমানের দিকে তাকিয়ে তাদের মতো দাঁত খিঁচিয়ে খ্যাঁক-খ্যাঁক করতে লাগল। আর পাশেই বনদফতরের কর্মীরা জাল নিয়ে রেডি থাকল। যেই বীর হনুমান নেমে আসবে তখনই তাকে খপ্ করে ওই জাল ফেলে ধরবে। জালের দড়ি যাতে ফস্কে না যায় তার জন্য বনদপ্তরের কর্মীরা জালের দড়ি কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিল। আর অফিসারের মুখে একটা হুইসেল। হুইসেল বাজলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে। বাগানে গিযে গ্রামবাসীরা ভিড় করছে হনুমান ধরা দেখবে বলে। বেশ মজাও পাচ্ছে তারা।

প্রথমে বীর হনুমান ট্যাঁপাদাকে দেখে দাঁত খিঁচোচ্ছিল। তারপর হঠাৎই এক লাফে গাছ থেকে নেমে ট্যাঁপাদার দিকে তেড়ে এল। এতো ক্যুইক ব্যাপারটা ঘটে গেল যে, বন দফতরের কর্মীরা ঠিক বুঝে ওঠার আগেই ট্যাঁপাদার একেবারে কাছে। ঠিক তখনই অফিসারের হুইসল বেজে উঠল বনদপ্তর কর্মীদের লক্ষ্যও একদম পারফেক্ট।

কিন্তু বীর হনুমানকে কি অত সহজে বাগে আনা যায়। সেও এক মোক্ষম ঝটকা মারল। আর তাতেই যাদের কোমরের জালের দড়ি বাঁধা ছিল তারা বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে এল। খানিকটা সামলে নিয়ে ওরাও টান মারল, এইবার হনুমান কিছুটা এগিয়ে এল। এভাবে কিছুক্ষন দড়ি টানাটানির পর বীর হনু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে সজোরে এক টান মারল। ব্যাস, বনদপ্তরের কর্মীরা টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে এ-ওর ঘাড়ে পড়ে গেল।

হনুমানবেশী ট্যাঁপাদা খুব ভয় পেয়ে গিয়ে হুপ-হুপ না করে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বীর হনুমান এবার গায়ে জাল নিয়ে সোজা ট্যাঁপাদার সামনে এসে কষিয়ে এক চড় মারল। যেন বোঝাতে চাইল, আমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে, খুব স্পর্ধা তো তোদের! এবার বনদপ্তর কর্মীদের দিকে এগিয়ে গিয়ে দু'চারটে চড় তাদের দিয়ে জাল-টাল ছিঁড়ে সোজা আমগাছের মগডালে। আর সেই গাছে লুকিয়ে পড়েছিল বনদফতরের অফিসার। বীরহনুমানকে ওই গাছে উঠতে দেখেই অফিসার, মা-রে বাবা-রে বলে হাত ছেড়ে দিয়ে চিৎপটাং। অফিসারের জ্ঞান ফিরেছিল ২৪ ঘন্টা পরে বদরতলা হাসপাতালে।

অফিসারের যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখে তার আশেপাশে বেডে শুয়ে তার সব সাঙ্গ-পাঙ্গ, সঙ্গে ট্যাঁপাদাও।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ