Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

লাল দল ।। মন্দাক্রান্তা সেন



মিঠুদের স্কুলে চারটে দল। লাল দল, নীল দল, সবুজ দল আর হলুদ দল। এই দলগুলিকে বলা হয় হাউজ। দলের মধ্যে ক্লাস টেন থেকে একজন করে হাউজ ক্যাপ্টেন মনোনীত হয়। এরা খেয়াল রাখে দলের মেয়েরা ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কিনা, শৃঙ্খলা বজায় রাখছে কিনা। প্রত্যেক দলের দায়িত্বে একজন করে দিদিমণি, এদের বলা হয় হাউজমাদার। এঁরা, যাকে বলে, পুরো দলের কাণ্ডকারখানাকে সুপারভাইজ করেন।

মিঠু লাল দলের সদস্য। মিঠু লাল দলের সম্পদ। সে পড়াশোনায় খুব ভালো। বছর বছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়। স্কুলের মধ্যে ও বাইরে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় আঁকা, গান, বিতর্ক, দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পায়। তাতে লাল দলের পয়েন্ট বাড়ে, আর বছর বছর লাল দল সেরা দল নির্বাচিত হয়। দলগুলির নিজেদের মধ্যে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতা খুব, কিন্তু মূলত মিঠুর জন্যেই কেউ লাল দলের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না।

শুধু লাল দল কেন, ইস্কুলের যে কোনো অনুষ্ঠানে, যেমন রবীন্দ্রজয়ন্তী, বনোমহোৎসব, বার্ষিক প্রদর্শনী... সবকিছুতেই থাকে মিঠুর প্রতিভাবান হাতের ছাপ, হাতের ছোঁয়া। আলপনা দিতে সবার আগে ডাক পড়ে তার। হলঘরে, সিঁড়িতে আলপনা দেয় সে। যে কোনো নাটকে মেন পার্ট তার বাঁধা। তার গান ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান হয় না। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা গুলোতে অনেক প্রাইজ পায়। সব মিলিয়ে মিঠু স্কুলের  গর্ব। আর সে কথা সবাই মেনে নিয়েছে, তা সে মনে মনে যার যতই হিংসে থাক।

এদিকে, দলগুলোর ওপর একটা দায়িত্ব আছে। প্রতিমাসে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে এদের স্কুল বুলেটিন বার করতে হয়। তার মানে, স্কুলের হল ঘরের দেয়ালে সাঁটানো একটা বোর্ড রয়েছে, সেটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তাতে এক মাস ধরে স্কুলের পক্ষে উপযোগী নানা খবর সংগ্রহ করে হাতে লিখতে হয়। ক্লাস এইটের মেয়েদের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবে, মাসে-মাসে প্রত্যেকটি দলই সাজিয়ে ক্ষান্ত দেয়, রোজ-রোজ খবর কেউই লেখে না। মিঠুরা এর আগে একবারই পালা পেয়েছিল, সে মাসটায় ছিল শার্লক হোমস শতবার্ষিকী। প্রকৃতপক্ষে ক্লাসের সব লাল দলের মেয়ের একসঙ্গে মিলে কাজ করার কথা, কিন্তু দায়িত্ব এসে পড়েছিল মিঠুর ঘাড়েই। খুব সুন্দর হয়েছিল সেটাও। আর তাছাড়া মিঠু প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়ে এসে সেখানে খবর লিখত - খেলার খবর, সাংস্কৃতিক খবর এইসব।

তো, এবার আবার লাল দলের পালা পড়েছে। মিঠুও তখন ক্লাস এইটে। বোর্ডটা ঠিক কেমন সাজানো হবে তাই নিয়ে সে একটু চিন্তিত। অবশ্য চিন্তার বিশেষ কিছু নেই। সামনেই পুজো, আর কদিন বাদেই পুজোর ছুটি পড়বে। দুর্গা পূজোর থিম নিয়ে বোর্ড সাজালেই চলবে।

মিঠু ক'দিন ধরে ভাবল। মাথার ভেতর পুরো ব্যাপারটা ছকে নিল। তারপর কাজ আরম্ভ করে দিল। সাধারণত এসব কাজ ক্লাসের ওই দলের সবাই মিলে করে। কিন্তু মিঠু দায়িত্ব নিয়েছে দেখে সবাই আরামে হাত গুটিয়ে বসে থাকল, ভাবখানা - ব্যস আর কোন চিন্তা নেই।

মিঠু খুব খাটল। বোর্ডের একদম অপরদিকে মাঝামাঝি থার্মোকল দিয়ে দুর্গা ঠাকুরের মুখ। তাতে প্রদীপ উল্টে মা দুর্গার তিনটি চোখ। সরু চুড়ি দিয়ে মা দুর্গার নাকের নথ। থার্মোকলেরই মুকুট আর কলকার মতো কানের গয়না। দেখতে লাগছে একদম ডাকের সাজের মতো। তার নিচে দু'পাশে এইরকম ডাকের সাজে ছোট-ছোট লক্ষ্মী-সরস্বতীর মুখ। তাদের নিচে কার্তিক আর গণেশ।

দুর্গা মায়ের মুখের ঠিক চিবুকের নীচে লম্বা সরু লাঠি দিয়ে বানানো বর্শা, তার মাঝখানে হার্ড পেপারে তৈরি দুটি হাতের মুঠি, যেন মা দুর্গা বর্শাটি ধরে রেখেছেন। আর তার ঠিক নিচের দিকে মাঝে-মাঝে একটা মহিষের মাথা- মহিষাসুর।

মজাটা হচ্ছে এই, মহিষাসুরের মাথাটা আসলে ক্যালেন্ডার। তার নিচে একই মাপের ত্রিশটা কাগজ কেটে লাগানো যাতে প্রতিদিনের খবর লেখা হবে।

তাছাড়াও বোর্ডের চারকোণে চারজন কাগজের উপর আঁকা ঢাকি আটকানো। সবমিলিয়ে দারুন জমকালো একটা ব্যাপার যাকে বলে। ক্লাসের মেয়েরা এসে দেখে যায়, তাদের নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে এবারও বুলেটিন বোর্ড সাজানোয় লাল দল প্রথম হবে। এবার রেড হাউজের মেয়েরা টুকটাক কাজে হাত লাগায়। সাজানো সম্পূর্ণ হয়েই গেছে, তবুও আঠা দিয়ে সাঁটনো যা কিছু বাকি, সবাই মহোৎসাহে সেসবে সাহায্য করে। সবার মনে গর্ব, মিঠুর জন্য তারা নির্ঘাত ফার্স্ট হবে। আর অন্য-অন্য হাউজের মেয়েরা যারা ব্যাপারটা দেখে গেছে বলে, আমাদের একটা মিঠু থাকলে আমরাও ফার্স্ট হতাম। সব কাজ তো একাই করেছে। ও তো একাই একশো।

সাজানো শেষ হলে সবাই মিলে বোর্ডটাকে তুলে আবার দেয়ালে আটকে দিল। নইলে এতক্ষণ তো সাজানো হচ্ছিল মেঝেতে পাতিয়ে। এরপরের কাজ হচ্ছে প্রথমে হাউজমাদারকে দেখানো, তারপর বড়দি কে দেখানো।

হাউজমাদার শমিতাদি প্রচুর প্রশংসা করলেন, বললেন- তোমরা নিজেরা নিজেরা এত বড়ো কাজ করেছো সবাই মিলে, আমি তো জানতামই না। খুব সুন্দর হয়েছে চমৎকার হয়েছে, মনে হচ্ছে এবার আমরা হাউজ মিটিংয়ে অনেক পয়েন্ট পাব।

মিঠুর সত্যিই খুব গর্ব হল। হোক না সে একাই করেছে সবকিছু, লাল দলের সবার সঙ্গে কৃতিত্ব ভাগ করে নিতে পারলেই তো সে খুশি।

এরপরের কাজ বড়দিকে দেখানো। শমিতাদি ক্লাসে চলে গেছেন। এবার বড়দি কে ডাকতে যাবে কে ? এ বলে তুই যা ও বলে তুই যা। শেষ পর্যন্ত সবাই মিঠুকেই ধরে বসল, তুই এত ভালো মেয়ে, বড়দি তোকে চেনেন, এটাও তোরই বানানো, তুই ছাড়া কে যাবে ?

মিঠু বলল, ঠিক আছে, আমি রাজি আছি, কিন্তু আমার সঙ্গে কয়েকজনকে যেতে হবে, না হলে আমি যাব না।

অগত্যা তাই ঠিক হলচার-পাঁচজন মিলে বড়দির ঘরের সামনে উপস্থিত হওয়া গেল, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে কারো আর সাহস কুলোয় না। শেষ পর্যন্ত মিঠু পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আসব ?

বড়দির গলাটি  লাগসই গম্ভীর, কে ? কি ব্যাপার ?

মিঠু বলল, বড়দি আমরা লাল দলের ক্লাস এইটের ব্যাচ। বুলেটিন বানিয়েছি। একবার দেখবেন ?

বড়দি একটা ফাইল দেখছিলেন। দেখতে-দেখতেই বললেন, ও আচ্ছা, চলো যাচ্ছি।

মিঠু সরে এল, বন্ধুদের বলল, চল সব হলঘরে। বড়দি আসছেন। হলঘরে সবাই জড়ো হয়েছে। লাল দল ক্লাস এইট এর ব্যাচ। এমনকি যে এ কাজে কুটোটি নাড়েনি সে পর্যন্ত সগৌরবে উপস্থিত। বড়দি আসবেন, সোজা কথা!

বড়দি এলেন, সবাই তটস্থ। উনি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সমস্তটা দেখলেন, তারপর বললেন, খুবই ভালো কাজ হয়েছে দেখছি!

মিঠুর আনন্দে প্রায় চোখে জল এসে গেল। তার এত খাটনি যেন সার্থক হল। সে যা ভেবেছিল তা ঠিকঠাক করে উঠতে পেরেছে ভেবে তার আনন্দ হল। তার ভাবনা এবং তার বাস্তবায়ন দুটোই একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেছে।

কিন্তু তার পরের ঘটনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

বড়দি বললেন, এর পেছনে প্ল্যানিংটা কার ?

মিঠুর গা ছম-ছম করে উঠল। কিন্তু নিজে কি বলা যায় ? তার পাশ থেকে দেবযনি এক পা বাড়িয়ে বলতে যাচ্ছিল, মি...

তার আগেই কৃষ্ণপ্রিয়াদি বলে উঠল, প্ল্যানিংটা শমিতাদির বড়দি, আমাদের হাউজমাদারের। আমরা সবাই মিলে সেটাই করেছি।

মিঠু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। প্ল্যানিংটা শমিতাদির ? উনি নিজের মুখেই বলে গেলেন তিনি ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতেন না, আর কৃষ্ণপ্রিয়া দি বলে কিনা...

আশ্চর্য, সত্যি কথাটা জানা সত্ত্বেও কেউ এর প্রতিবাদ করল না, যে না, এটা সম্পূর্ণ মিঠুর পরিকল্পনা। অবশ্য বড়দি সামনে মুখ খুলবে কে!

বড়দি বললেন, হ্যাঁ, এর পিছনে কোনো পাকা ইন্টেলেকচুয়াল মাথার পরিকল্পনা আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়।

মিঠুর গর্ব হল, কিন্তু তার গর্ব ছাপিয়ে ঝাপসা হয়ে এল চোখ। সে ভয় পাচ্ছিল যেন বড়দির সামনে সে কেঁদে না ফেলে। ইস কি বিচ্ছিরিই না হবে ব্যাপারটা। কিন্তু কৃষ্ণপ্রিয়া কেন অমন করল ? হিংসায় ? এর কোনো উত্তর জানা নেই।

ও যদি বলতো আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করেছি, তা হলেও বোধহয় মিঠুর এতটা দুঃখ হত না। আসলে বানানোটা নয় ভাবনাটাতেই সে সত্যিকারের প্রশংসা আশা করেছিল। হয়তো এটা তার ভুল। ঈশ্বর তাই কি তাকে শাস্তি দিলেন।

বড়দি চলে গেলে সে একা বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে কান্না ধুলো। তারপর ভালো করে রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বাইরে এসে দেখল এক কৃষ্ণপ্রিয়া ছাড়া সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। মিঠু কোনো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অমৃতা এসে তার হাত টেনে ধরল বলল, কাঁদিসনা মিঠু, মন খারাপ করিসনা, কৃষ্ণপ্রিয়া এটা খুব খারাপ কাজ করেছে।

হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে ভাঙা গলায় মিঠু বলল, কই তখন তো তোরা কেউ কিছু বললি না ?

ওরে বাবা, বড়দির সামনে কে মুখ খুলবে, তাও তো আমি বলতে যাচ্ছিলাম দেবযানি বলল, কিন্তু আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বলে দিল।

মিঠু বলল, তাহলে ওরি সাহস আছে বলতে হবে। বড়দির সামনে কি স্মার্টলি একটা মিথ্যে কথা বলে গেল আর আমরা সবাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শুনলাম।

কুহেলি কি একটা বলতে যাচ্ছিল, মিঠু বাধা দিয়ে বলল, যাক ছেড়ে দে, প্রথমটায় আমারও খুব দুঃখ হয়েছিল। এখন দুঃখটা আস্তে-আস্তে কমে যাচ্ছে যত ভাবছি বড়দির কথাটা- এর পেছনে কোনো পাকা ইন্টেলেকচুয়াল মাথার প্ল্যানিং আছে। তাহলে আমার মাথাটা ইন্টেলেকচুয়াল আর পাকা, একথাটা মানতেই হবে।

সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। অনিন্দিতা বলল, বাইরে তো চ্যাঁচাতে পারব না, আয় বাথরুমেই চেঁচিয়ে নিই- থ্রি চিয়ার্স ফর মিঠু চক্রবর্তী হিপ্ হিপ্ হুররে...

ওদের বাধা দিয়ে মিঠু বলল, না না বল, থ্রি চিয়ার্স ফর রেডহাউজ, হিপ হিপ হুররে...।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ