পচাদের জাঙালটা সেবার বাবা চাষ করতে নিয়ে সোনা ফলিয়েছিল। জুট মিল বন্ধ তাই
চাষ করেই সংসার চালাতে হয় বাবাকে। পচাদের জাঙ্গাল আর খাঁদুদের দুই বিঘা জমিটা
বর্ষা ও খোরো দুটো চাষ দেবে বলে আগাম টাকায় জমায় নিল। কারখানায় লকআউটে সব গেছে।
শেষে মা-বাবার বিয়ের আংটিটা স্যাকরার দোকানে বাঁধা দিয়ে জমি দুটো নিয়েছে।
পচাদের জমিতে ঘাস মারার বিষ দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে শশা, ঢেরস লাগাল।
একদিন রাত্রে বেয়ানের শশাগুলো পর্যন্ত কে তুলে নিয়ে গেল। পঞ্চায়েতকে জানানো
হল। পঞ্চায়েত বিচারে রায় দিল, কে চুরি করেছে,
কি করে ধরব! তার থেকে
আপনার বাগানে কুঁড়ে বেঁধে পাহারা দিন। তাহলে চুরি হবে না।
ওই বাগানের কাছে পুকুরটাতেও বাবা মাছ চাষ করেছে। তাই বাবা আর দেরি না করে বাগানে কুঁড়ে বানিয়ে রোজ রাত্রে পাহারা দেয়।
সেদিন রাত্রে বাবার খুব জ্বর। তাই বাবা আমাকে আর ভাইকে পাঠাল কুঁড়েতে পাহারা দেবার জন্য। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে আকাশ একদম পরিষ্কার। তেঁতুল গাছের উপর দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ব্যাঙের ডাক আর মাঝে-মাঝে ডাহুকের ডাক মিলেমিশে একটা যেন থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গাছপালাগুলোও সব চুপচাপ। যেন মনে হচ্ছে অনেকক্ষণের হাওয়ার তাণ্ডবে ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আশেপাশের ক্ষেতগুলোতে ধানগাছ শুয়ে পড়েছে।
কুঁড়েটা একটু উঁচুতে থাকায় চারদিকের অনেকটা জায়গা দেখা যায়। বসে-বসে সেই সব দেখছি। ভাইকে বললাম, একটা গল্পের বই আনলে ভালো হত। সময় কেটে যেত। ভাই বলল, শুয়ে পর। পাহারা দেওয়া মানে সারারাত জেগে থাকতে হবে নাকি! বাগানে চোর ঢুকলে ঠিক ঘুম ভেঙে যাবে। হ্যারিকেনটা ভাই কমিয়ে দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
একা-একা আর কতক্ষণ জেগে থাকা যায়। ভাইয়ের পাশে আমিও শুয়ে পড়লাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। বললাম, চোর ঢুকেছে নাকি ? হ্যারিকেনের আলোটা বাড়া তাড়াতাড়ি। ভাই ভীত গলায় বলল, ওদিকে দেখ।
ওদিকে তাকিয়ে আমিও রাম নাম জপতে শুরু করলাম। সাদা কাপড় পরা বউটা হাতছানি দিয়ে তখনো ডাকছে। ভাই বলল, দাদা পালিয়ে যাই চল।
-আরে পালাবি কোথায় থেকে ? সিনেমায় দেখিসনি, ওরা উড়তে পারে, হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে ঠিক আমাদের কাছে সে যেতে পারবে। তারপর খেয়াল হল ভূতটা তো এগিয়ে আসছে না। একজায়গায় দাঁড়িয়েই ডাকছে।
-আচ্ছা দাদা, একবার কাছে গিয়ে দেখলে হয় না ? বাবা সংসারের জন্য কত কষ্ট করে জেনেই হয়তো গুপী-বাঘার মতো ভূতের রাজা আমাদেরকেও বর দিতে এসেছেন!
-আরে আমরা কি গান জানি নাকি যে আমাদের বর দেবে! বরং গেলেই ঘাড় মটকে দেবে।
-দাদা, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন ? দেখ এবছর বাবা স্কুলের মাইনে দিতে পারেনি বলে হেডমাস্টারমশাই আমাদের পরীক্ষায় বসতে দেবে না বলেছেন। ভূতের রাজার বরে যদি আমাদের অনেক টাকা হয়ে যায়, তাহলে আমরা পরীক্ষা দিতে পারব। আর যদি অন্যরকম কিছু হয়, আমি চেঁচাব। তুই তাড়াতাড়ি এই কুঁড়ে ঘরের চাল থেকে একটা খড়ের আঁটি খুলে তাতে আগুন জ্বালিয়ে নিয়ে দৌড়বি আমার দিকে। ভূতেরা আগুন দেখলে ভয়ে পালিয়ে যাবে।
-আমার খুব ভয় করছে। তুই যাস না।
তবুও ভাই গেল। আমি কিছুক্ষণ পরে হ্যারিকেনটা জোর বাড়িয়ে ভাইয়ের পিছন-পিছন গেলাম। গিয়ে দেখি ভাই কি যেন খুঁজছে। বললাম, কিরে কি হল ?
-তুই হ্যারিকেনটা নিয়ে এলি কেন ? উনি নিশ্চয়ই আগুন দেখে পালিয়ে গেছে। ইস্, ভূতের রাজার বর আর পাওয়া হল না। আমরা কি সুন্দর বড়লোক হয়ে যেতাম।
ভাই আমার ওপর রেগে গিয়ে গজ-গজ করতে লাগল। হঠাৎ আমার চোখ কলাগাছটার দিকে পড়তে খুব হাসি পেল। ভাইকে বললাম, ওই দেখ, ওই কলাপাতাটাই হাওয়াই নড়ছিল আর আমরা ভূত ভেবে কত কিছু স্বপ্ন দেখছি।
-আমি স্পষ্ট দেখেছি বউটা সাদা কাপড় পরে ছিল।
ভাইকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, কলাপাতাটার ওপরে চাঁদের আলো পড়ায় মনে হচ্ছিল যে, ওটা সাদা কাপড় পরে আছে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শ্রাবণ ১৪১৭ (জুলাই ২০১০)
0 মন্তব্যসমূহ