Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

রিমির ইচ্ছে ।। মধুসূদন ঘাটী



রিমির ইচ্ছে সে তার বিদেশকাকুর কাছ থেকে জেনে নেবে কী করে ক্লাসের পরীক্ষায় প্রথম হতে হয়। অনেক চেষ্টা করেছে সে। ভোর-ভোর উঠে পড়া মুখস্থ করেছে, রাত্রে অনেকটা সময় বাড়িয়েছে পড়ার। স্কুল থেকে ফিরেও পড়তে বসেছে। তবু সে তিন রোল করেছে এবার। মনোলীনা প্রতিবারের মতো প্রথম হয়েছে এবছরও। অথচ নম্বরের তফাৎ মাত্র সাত। এই সাতনম্বর তাকে টপকাতেই হবে। মাঝখানে কী করে যে দেবস্মিতা ঢুকে পড়ল কিছুতেই তার মাথায় আসছে না। মাত্র দু নম্বর বেশি পেয়েছে সে। সবাই জানে, দেবস্মিতা পড়ায় ফাঁকি দেয়। স্কুলের অনুষ্ঠানে ভালো গান গায় বলে কি এই বেশি নম্বর পাওয়া ? সে যে একদম গান গাইতে পারে না। মনোলীনা না হয় সত্যিই বুদ্ধিমতী। কিন্তু দেবস্মিতা ?

রিমি তার বাবাকে বলে রেখেছে, এবার বিদেশকাকু বাড়িতে এলে সে একটু সময় বের করবে। বিদেশকাকু আসলে অন্য রাজ্যে চাকরি করতে যায়। বদলির চাকরি। আজ এ রাজ্যে তো কয়েকদিন পরে অন্য রাজ্যে জয়েন্ট করে। কত জানে বিদেশকাকু। গান, আকৃত্তি, নাটক, খেলাধুলো এসব ছেড়েই দিলাম। এত ভালো বলতে পারে। প্রচুর বই পড়ে কিনা! পাতার পর পাতা মুখস্থ। কী স্মৃতিশক্তি!

গতবার যখন বিদেশকাকু এল রিমির তখন অ্যানুয়েল পরীক্ষা। মুখ গুঁজে পড়ছে আর পড়ছে। কই, কিছুই তো হল না। সেই তিন রোল!

মা বলেছিল, ‘মন দিয়ে পড়তে হয়।মন জিনিসটা যে কী! না চোখে দেখা যায়, না ধরা যায়। বাবাকে বলেছিল রিমি কথাটা, ‘মন মানে কী ?’ বাবা বলেছিল, ‘মন হল তোমার হৃদয়। মন ভালো থাকলে অনেককিছু ভালো লাগে, ভালো হয়ে যায়।রিমি কিছুক্ষণ ভাববার পর আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ভীষণ রাগ হয় দেবস্মিতা, মনোলীনার উপর। ওদের মনটাই তাহলে ভালো!

সেদিন একা-একা অনেক্ষণ ভেবেছিল কথাটা। বারান্দায় হাতে বই নিয়ে বসেছিল সে। একটা দোয়েলপাখি ফুড়ৎ করে উড়ে বসল ঠিক তার সামনের আতাডালে। লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে মিষ্টি সুরে গান গাইছিল আর পিটকি চোখে দেখছিল রিমিকে। রিমির ভালো লেগেছিল দোয়েলপাখির গান। অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি কার কাছে গান শিখেছ ?’

দোয়েলপাখি এডাল-ওডাল কয়েকবার লাফাল। তারপর বলল, ‘মায়ের কাছে।বলেই নিমেষে নাগালের বাইরে উড়ে গেল। অনেক খুঁজল পাখিটাকে রিমি। ভীষণ দুঃখও হল। কেন না তার মা তো গান জানে না। কে শেখাবে তাকে গান। মনে মনে ভাবল এবার তাকে গানও শিখতে হবে।

বিদেশকাকু আসছে শুনে মনের মধ্যে তোলপাড় উঠল রিমির। অনেক কথা। সব গুছিয়ে তো বলতে হবে। বিকেলবেলা যখন সূয্যি ডুবিডুবি করে, সে সময় বিদেশকাকু বাড়ির সব ছোটোদের ডেকে পাঠায়। মশলামুড়ির সঙ্গে বেগুনভাজা বানিয়ে মা অপেক্ষা করে। বিদেশকাকু বাড়ি এলে রিমির জন্যে রং-পেন্সিল আনতে ভোলে না। রিমি তো ভালো ছবি আঁকতে পারে। গতবারে তার জন্যে আঁকার মস্ত বড়ো একটা খাতা এনেছিল। পড়ার চাপ ছিল বলে মাত্র একটু সময় দেখা হয়েছিল। খুব আনন্দ হয়েছিল রিমির।

এবার বিদেশকাকু আসতেই রিমির মনটা ভালো হয়ে গেল। আজ সে একদম পড়ার কথা ভাববে না। শুধু জানতে চাইবে, ভালো মন পেতে হলে কী করতে হয়। পরীক্ষায় প্রথম তাকে হতেই হবে।

সেদিন আকাশটা বেশ গোমড়ামুখো ছিল। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। বৃষ্টি পড়লে বিদেশকাকুকে বেশ খুশি-খুশি দেখায়। এখন যে রাজ্যে থাকে সেখানে নাকি সারা বছরে বৃষ্টির দেখাই মেলে না। বর্ষায় ভিজলে যে জ্বর হতে পারে সে কথা বিদেশকাকু কে বোঝাবে!

ছোটোরা মাদুর পেতে গোল হয়ে বসেছে বারান্দায়। রিমির বাবাও বিদেশকাকুকে ভীষণ ভালোবাসে। মাঝে মাঝে এসে জলের বোতল ধরিয়ে যায়। মার বেগুনভাজা যেন ফুরোয় না। বিদেশকাকুর এই খাবারে ভীষণ আগ্রহ। মনে হয় সে রাজ্যে কোনো বেগুনগাছ নেই।

এবার মান্তু, পিঙ্কি, সুন্দার অনেক চকোলেট পেয়েছে। সামনের মাসে তো রিমির জন্মদিন আছে। বিদেশকাকু তখন থাকবে না। তাই রিমির জন্যে দামি জলরঙের সেট এনেছে এবার। একটু-আধটু জল রঙের কাজও সে শিখেছে। রিমির আঁকা দেখে খুব খুশি বিদেশকাকু।

পিঙ্কি রিমির মাসির মেয়ে। থাকে দুতিন গ্রাম পেরিয়ে। মসির সঙ্গে আসে বিদেশকাকুর আসার গন্ধ পেলে। ও ভালো গান গায় আর বিদেশকাকু গানের ভক্ত। বৈঠক তাই পিঙ্কির গলায় রবিঠাকুরের গান দিয়ে শুরু হল। এবার মুখ খুলল বিদেশকাকু। বলল, ‘রবিঠাকুরের গান গাইতে গেলে নিজেকে বিনয়ী হতে হবে। কেননা দরদ দিয়ে এ গান না গাইলে শ্রোতারা খুশি হবে না। এতো আর ঝিঙ্কাচিকা গান নয় যে যেমন তেমন করে গেয়ে দিলেই হল।

সুনন্দ আবৃত্তিটা ভালোই করল। বীরপুরুষের মতো বীরপুরুষকবিতাটি বলেই প্রশ্ন করল বিদেশকাকুকে, ‘কেমন হয়েছে ?’ বিদেশকাকু এবার মার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছেলেকে আরও বেশি করে সময় দিতে হবে এই কবিতার জন্য। ভয়ের বিরুদ্ধে আরও জোরাল গলার স্বর চাই। বাকিটা বেশ ভালো।আসলে মা-ই তো শেখায় ভাইকে। রিমির যে সেটাও ভালো লাগে না। পড়ার চাপে কবিতা মুখস্থ করবার সময় কোথায়!

বিদেশকাকু এবার তাকাল মান্তুর দিকে। পাশের বাড়ির কাকুর মেয়ে। তার গান, আবৃত্তি ভালো লাগে না। ভালো আঁকেও না। তবু বিদেশকাকু তাকে বেশ পছন্দ করে। কেননা, সে ভালো সাঁতার জানে। জলের রানি সে। পুকুরের জলে নামলে তার গতি বেড়ে যায়। ছোটোদের সাঁতারে সে গ্রামে এক নম্বর। অনেক পুরস্কার এনেছে। জেলা সাঁতারেও সে এবার নামবে। তাই বাইরে যায় ট্রেনিং নিতে। তার সমাদর তো হবেই। বিদেশকাকুর জলে ভীষণ ভয়। একবার নৌকোডুবির গল্প বলতে বলতে চোখের কোণে জল এসেছিল বিদেশকাকুর। নদীর কথা বললেই এড়িয়ে যায়। কিন্তু জলে সাঁতার কাটতে কাটতে জানলে বাহবা দিতে ভোলে না। রিমিও কাকুকে খুশি করবার জন্য সাঁতার শিখেছে। বিদেশকাকু বলল, ‘তোমাদের ইচ্ছেটাই আসল। ইচ্ছে থাকলে তোমরা অনেক কিছু করে দেখাতে পার। এই যেমন রিমি। ভালো রেজাল্ট করে, ভালো আঁকে।বলেই থামল। রিমির তখন হাঁসফাঁস অবস্থা। কেননা বিদেশকাকু যে এরকমভাবে তাকে নিয়ে শুরু করবে সে ভাবেনি। সঙ্গে এনেছিল আঁকার খাতা। অনেক নতুন ছবি সে এঁকেছে বিদেশকাকুকে দেখাবে বলে। সেসবের কী হবে!

রিমির সাজনো-গোছানো কথাগুলো যে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বিদেশকাকু এবারও বলল, ‘ মনের ভিতরের ভালো-মন্দ ফুটিয়ে তোলে তোমার ইচ্ছে। অনেকে আবার একে একাগ্রতাও বলে। তোমার একাগ্রতা ঠিক থাকলে তুমি যে কোনো পরীক্ষায় প্রথম হতে পার। তোমাকে পারতেই হবে ধরণের জেদ যেদিন তোমাকে পেয়ে বসবে সেদিন তোমার জিৎ। তুমিই প্রথম।কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠল রিমি। এটাই তো জানতে চেয়েছিল সে। তবে এই জেদটা আসবে কোত্থেকে। কেননা তার তো প্রথম হওয়ার ইচ্ছে প্রবল। তাহলে কী জেদটাই অধরা। এবার রিমি প্রশ্ন করে বসল বিদেশকাকুকে, ‘জেদ কীভাবে অর্জন করা যায় ?’

বিদেশকাকু এবার হাসলেন। রিমির পরীক্ষার খবর আগেই জেনেছে মার কাছে থেকে। তার জেদের কথাও। কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসাল রিমিকে। একটু আদর করল। তোমার সব আছে, তুমি পারবেই। তোমার আঁকার মতো ভালো মনটাও। তোমাকে নিয়ে আমাদের সকলের অনেক স্বপ্ন। স্কুলের পরীক্ষাটাই বড়ো নয়। সামনে আরও অনেক অনেক পরীক্ষা আসবে। কিছুটা ব্যর্থতা আছে বলেই তো তোমার জেদ বাড়ছে। এই যে তুমি জানতে চাইছ, এর থেকে বোঝা যায় প্রথম তুমি হবেই।

রিমির মনটা ভরে উঠল এবার। বিদেশকাকু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সাহস পেয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে এই শক্তিটুকুই দাও বিদেশকাকু। আমি যেন অনেক বড়ো হতে পারি।

বিদেশকাকু আরও একবার আদর করল রিমিকে। সভা ভাঙল। তারপর তার হাত থেকে আঁকার খাতাটা নিয়ে বলে উঠল, ‘রিমির ইচ্ছে পূরণ হোক।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ