![]() |
গল্পের নায়ক পোকাদা।
আমাদের বাড়ির চারটে বাড়ির পরেই পোকাদার পেল্লাই বাড়ি। পোকাদা যখন মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ হয়েছিল তখন তার চেহারা নাকি এতই ছোটো ছিল যে তা দেখে পোকাদার ঠাকুমা বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ কোলঝাড়া নাতিটির নাম রেখেছিলেন পোকা।
মায়ের মুখে শোনা, পোকাদার ছোটকা ভাইপোর নাম শুনে পোকাদার ঠাকুমাকে ভেংচি কেটে বলেছিল, ‘আর নাম পাওনি মা! শেষে ওই ফুটফুটে ছেলেটার নাম রাখলে পোকা?’
ছেলের কথার উত্তরে পোকাদার ঠাকুমা গাল ফুলিয়ে বলেছিলেন, ‘ওরে খোকা, জোনাকি পোকাও পোকা, আবার গোবরে পোকাও পোকা, দেখিস- এ ছেলে বড়ো হয়ে সক্কলকে আলো দেবে।’
ছোটকাও দমবার পাত্র নয়। মায়ের কথার উত্তরে বলেছিল, ‘এখন আর ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে না, ইলেক্ট্রিক বাল্ব জ্বলে। তোমার জোনাকি পোকার এখন আর তেমন কাজ নেই।’ যাইহোক বাড়ির সকলের অনুরোধে পোকাদার ঠাকুমা অন্নপ্রাশনে নাতির আরো একটা নাম রাখলেন পোকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, শ্রী প্রহ্লাদ ভদ্র। প্রহ্লাদ ভদ্র নামটা যথারীতি স্কুলের খাতায় আর রেশনকার্ডেই বন্দী হয়ে রইল। পোকা আমাদের কাছে পোকাদা হয়ে জ্বল-জ্বল করতে লাগল।
আমি সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি, চারিদিকেই কেমন একটা রাজনীতির ঝোড়ো হাওয়া, ইস্কুলের বড়ো ছেলেরা আমাদের মাঝেমধ্যেই ছাত্র রাজনীতি বুঝিয়ে যাচ্ছে।কেউ ডানদিকে, কেউ বামদিকে। আমি রাজনীতির কিছুই বুঝি না, বরাবরই একটু বোকা ধরণের, আর সেই জন্যই সবকিছু খুব লেটে বুঝি আর যাও বুঝি তার সবটাই প্রায় অন্যের কাছে ভুল বোঝা হয়ে ঝুলঝাড়ুর আদর পায়।
আমার থেকে দু’বছরের বড়ো হয়েও পোকাদা আমার ক্লাসে পড়ে। পরপর দু’বার ক্লাস সিক্স-এ ডিগবাজি খেয়ে শেষে স্কুল সেক্রেটারির ‘স্পেশাল পারমিশনে’ পোকাদা ক্লাস সেভেনের বি সেকশনে আমার সহপাঠী হয়েছে। কানাঘুষো শুনেছিলাম ওই দু’বছর পীক্ষার সময় নাকি পোকাদার ভীষণরকম মাথার মধ্যে কি সব সাংঘাতিক অসুখ হয়েছিল।
সে যাইহোক, পাড়ায় পাশাপাশি, শ্রেণিকক্ষেও পাশাপাশি বসব এ আর নতুন কথা কী! পোকাদা পড়াশোনায় যেমনই হোক কিন্তু রাজনীতির তুখোড়-তুখোড় ভাষা চটজলদি এমনভাবে হুস করে মাথায় ঢুকিয়ে নেয় যা সহজে আর বের হয় না। পোকাদা সুযোগ সুবিধে পেলেই আমাদের জ্ঞান দেয়, বলে, ‘দ্যাখ, ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ। শুধু পড়াশোনা করলেই হবে না, দেশের দিকে ফিরে দ্যাখ, কত চোর, ডাকাত, কালোবাজারী, সমাজবিরোধী দেশটাকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, এতে কি তোর আমার কিছুই করার নেই ?
-কেন পোকাদা, দেশে কি এখন পুলিশ কমে গেছে ? আমি আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করি।
-ধুৎস্, কিস্সু হবে না তোর। পোকাদা নাক সিঁটকে উত্তর দেয়, ফালতু তোর পেছনে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
পোকাদার কাছ থেকে পাত্তা না পেয়ে আমি আজকাল আর রাজনীতির কথায় নাক গলাই না। পোকাদাও আমাকে বাদ দিয়ে অন্য ছেলেদের নিয়ে দল পাকিয়েছে, কথায়-কথায় ক্লাস বয়কট করে।
পোকাদা অংকে ভীষণ কাঁচা। অংকের মাস্টারমশাই ধীরেনবাবুকে আমরা যমের মতো ভয় পাই। ধীরেনবাবুর বেতের ছোঁয়া বাঁচাতে ক্লাসের সব ছেলেরাই হোমওয়ার্ক করে রাখে। সেদিন ধীরেন স্যার ক্লাসে ঢুকতেই পোকাদা চোখ কপালে তুলে ধড়াস করে বেঞ্চে শুয়ে পড়ল। কী হল-কী হল ক্লাস শুদ্ধু সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল পোকাদার মুখের উপর। হুড়োহুড়িতে অংকের বই-খাতা সব ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে লাগল।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে ধীরেন স্যারের হাতে ধরা বেতটা ক্রমাগত নৃত্য করতে লাগল। ধীরেন স্যার বেত নাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এ্যাই-সব বেঞ্চে উঠে দাঁড়া।’
আমি পোকাদার একমাত্র প্রতিবেশী সহপাঠী হয়েও সবার আগে বেঞ্চে উঠে দাঁড়ালাম। আমার দেখাদেখি আরো দু’একজন, এইভাবে একে-একে সব ছেলেরাই বেঞ্চে উঠে দাঁড়াল। ধীরেনবাবু ধীরে-ধীরে পোকাদার বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। ততক্ষণে আমাদের অনেকের চোখ যতটা সম্ভব বাঁকা হয়ে ঘাড় ঘুরে গেছে ধীরেনবাবু আর পোকাদার দিকে।
ধীরেনবাবু পোকাদার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এ্যাই তোর কী হয়েছে ? ওঠ, উঠে বোস।’ পোকাদার সাড়া নেই। ধীরেনবাবু এবার জোরে-জোরে পোকাদার গায়ে নাড়া দিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে মুখে না বললে বুঝব কী করে, কোথায় কষ্ট ?’
-‘পেটে ব্যথা’। পোকাদা মড়ার মতো চোখ করে কোনোরকমে বলে উঠল। ‘তোরা সব বোস’ বলে ধীরেন স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সেদিনের মতো আমাদের অংকের ক্লাস ফাঁকি গেল। তা যাক্। অংক গেলে অংক হবে কিন্তু পোকাদা মারা গেলে তো আর পোকাদা হবে না, ভেবে আমি মনে-মনে স্বস্তি পেলাম।
ধীরেনবাবুর মুখে পোকাদার অসুস্থতার খবর পেয়ে হেড স্যার আমাদের ক্লাসে ঢুকলেন। পোকাদার কাছে গিয়ে বেশ রাগত স্বরে বললেন, ‘বাড়িতে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবি, সামনেই পরীক্ষা।’ বেশি কথা বলার মানুষ নন হেড স্যার। কথা ক’টা বলেই ক্লাস থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই ছুটির ঘন্টা পড়ল। আমি পোকাদাকে নিয়ে সাবধানে হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। কয়েকটা মোড় ঘুরতেই দেখি পোকাদা গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজছে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে পোকাদার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন একটু সুস্থবোধ করছ পোকাদা ?’
আমার কথা শুনে পোকাদা আমার পিঠে একটা মোটামুটি কিলো পাঁচেকের কিল মেরে বলল, ‘সুস্থ মানে ? কখন অসুস্থ হলাম ?’
‘তবে যে ক্লাসে অমন ...’
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই পোকাদা বলে উঠল, ‘ওসব ঢপ্ বুঝলি গজু ? মাঝে-মাঝে ঢপ্ দিতে হয়। আজ আমার ধীরেন স্যারের হোমটাক্স করা ছিল না।’
পোকাদার মিছে কথার পুঁটলি ওই ঢপের কথা শুনে আমার ঠোঁট দুটো ততক্ষণে ফাঁক হতে-হতে প্রায় একটা বড়ো সাইজের রাজভোগের আকার ধারণ করেছে। আমার মুখের অমন বিতিকিচ্ছিরি ভাব দেখে পোকাদা আমার হাতে একটা ঠেলা মেরে বলল, ‘যা, বাড়ি যা।’ পোকাদা নাচতে-নাচতে তার বাড়ি ঢুকে গেল। বুঝলাম পোকাদার ওই মাথার রোগের বাহানাটাও ছিল মোটামুটি একটা বড়োসড়ো ঢপ।
ওই ঘটনার দু’দিন পরেই ইতিহাসের ক্লাসে পোকাদা ‘বাবাগো’ বলে আবার শুয়ে পড়ল। ইতিহাসের মাস্টারমশাই অধীরবাবু পরীক্ষার আগে ‘ইর্ম্প্যট্যান্ট’ প্রশ্নের উত্তর লেখাচ্ছিলেন। আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে লিখে চলেছি হঠাৎ পোকাদার ‘বাবাগো’ চিৎকারে হাতের পেন থেমে গেল, দেখলাম পোকাদা বেঞ্চে শুয়ে পড়েছে। আমিই শুধু একমাত্র জানতাম এসব পোকাদার সেই ‘ঢপ’। আমি তাড়াতাড়ি বিরক্ত মুখে পোকাদার কাছে গিয়ে বললাম, ‘কী হচ্ছে পোকাদা ? সামনে পরীক্ষা আর তুমি আজকেও শুলে ?’ পোকাদা কাতরাতে কাতরাতে বলে উঠল, ‘একটু জল।’ জল খেয়েও পোকাদা আর উঠল না। মাস্টারমশাই আর পড়াবেন কী! পোকাদাকে নিয়ে তখন টানাটানি, খ্যাঁচাখেঁচি কিছুতেই পোকাদা ওঠে না। বেঞ্চে একদম সেঁটে থাকল। ঠিক যেন ছারপোকা, বিছানায় লেপ্টে আছে, কিছুতেই নড়ার ক্ষমতা নেই। পুরো চল্লিশ মিনিটই পেটে ব্যথা। ক্লাস শেষ হবার ঘন্টা পড়তেই পোকাদা আমায় এক মোক্ষম চিমটি কেটে বলল, ‘খবরদার, ভবিষ্যতে আর ফাজলামো করলে ফলটা হাতে-হাতে টের পাবি।’ এরপর আমি দু’দিন পোকাদার সঙ্গে বেশি কথা-বার্তা বলিনি। উরুতে পোকাদার কাটা চিমটি ফুলে কালো ইঁট হয়ে আছে।
গতকাল স্কুল ছুটির পর পোকাদা আগ বাড়িয়ে আমার পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল বাদাম চিবুতে-চিবুতে। আমার হাতে গোটা কয়েক বাদাম প্রায় গুঁজে দিয়ে বলল, ‘চাদরটা ভালো করে গায়ে ঢেকে নে। আজ বড়ো ঠাণ্ডা।’ সত্যি বড্ড বেশি ঠাণ্ডা পড়ে গেল। চাদরটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বাদাম চিবুতে-চিবুতে চলেছি। পোকাদা বলল, ‘জানিস গজু, এবার পাড়ায় আমরা একটা সরস্বতী পুজো করব।’
-‘পাড়ায় পাঁচ-ছ’টা তো হয়, কে আমাদের চাঁদা দেবে ?’
-‘ওসব তোকে ভাবতে হবে না’ কথাটা পোকাদা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে তাচ্ছিল্য ভরে।
আমি লাটাইয়ের সুতোর মতো গুটিয়ে যেতেই পোকাদা বক্তৃতার ঢঙে বলে চলল, ‘মানুষের কাছে আমাদের সহানুভুতি আদায় করতে হবে।’
বিকালে আমরা চার-পাঁচজন পোকাদার প্রধান সাঙ্গোপাঙ্গোরা বাঁশতলার মাঠে জমায়েত হলাম। পোকাদা আগে থেকেই মরা তালগাছটার গুঁড়িতে গুড়িসুড়ি মেরে বসে ছিল, আমরা ক’জন একান্ত সেবকের মতো পায়ের নিচে বসলাম। পোকাদা শুরু করল, ‘আমার প্রিয় শ্রোতা বন্ধুগণ, বালক সংঘের ছেলেরা একতরফাভাবে আমাদের পাড়ার সরস্বতী পুজোটা দখলে রেখে চলেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। আমি এর প্রতিবাদে ‘নব বালক সংঘের’ পুজো করব ঠিক করেছি, তোমরা সবাই রাজি তো ?’ বকী, গণেশ, পচা, সন্তু সবাই সমস্বরে ‘করতে হবে’ ‘করতে হবে’ করে বিকট রকম চেঁচাতে লাগল। পোকাদা হাত নেড়ে সবাইকে চুপ করতে বলল। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে পোকাদা দাঁত খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এ্যাই, তুই রাজি নস’ ? আমি তোতলাতে-তোতলাতে বললাম, ‘সবাই রাজি হলে আমিও রাজি, তবে-’
-‘কি তবে ?’ পোকাদার ধমক।
-‘কোথায় হবে পুজোটা ?’
হ্যাঁ-এর ওপর মোক্ষম একটা টান মেরে বকীর দিকে চেয়ে বলল, ‘পারমিশন-’
-‘বকীর দাদুর পারমিশন নিয়ে বকীদের গ্যারেজটা কব্জা করতে হবে।’
বকী কিছু একটা বলতে চাইতেই পোকাদা আগেই বলে উঠল। ‘ওটা পেলে ডেকরেশন চার্জ ফিফটি পারসেন্ট কমে যাবে।’
বকী হাঁ বন্ধ করতেই পোকাদা দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল, ‘তবে এব্যাপারে বকীকেই আমাদের সাহায্য করতে হবে।
সন্ধ্যার সময়ে আমরা ক’জন বকীর সঙ্গে বকীদের বাড়ি গেলাম, সব শুনে বকীর দাদু আমাদের এই মারে তো সেই মারে, হাতে লাঠি নিয়ে তেড়ে উঠলেন, ‘গলা টিপলে দুধ বার হয়, বলে কিনা সরস্বতী পুজো করব! বল তো ‘সরস্বতী’ বানান কী ?’
বকীর দাদুর লাঠির তাড়া খেয়ে আমরা সোজা এক ছুটে একেবারে রাস্তায়। বকীও আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। পোকাদা বকীর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘দ্যাখ, ভালো কথায় যেখানে কাজ হয় না, সেখানে আন্দোলনের পথে যেতেই হয়। তোর চিন্তা নেই। আজ থেকেই অনশন চালিয়ে যা, আমরা সবাই জানলা দিয়ে তোকে লজেন্স-বিস্কুট সাপ্লাই দেব।’ পোকাদার নির্দেশে বকীর রাত্রের খাওয়া বন্ধ হল। পরের দিন সকাল থেকেই বকীর পুরোপুরি ভাবে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ, বকীর মা, ঠাকুমা বকীকে খাওয়ানোর জন্য পাগল হয়ে উঠলেন, কিন্তু বকীর এক জেদ দাদু দাবী না মানলে সে অনশন চালিয়ে যাবে। বকীর ঠাকুমা বকীর বাবাকে বললেন, ‘হ্যাঁরে খোকা, কী সব দাবী-দাবার কথা বলছে আমার সোনার চাঁদ নাতি ? দে না বাছা মিটিয়ে, ক’টা পয়সা বই’তো নয়।’
মায়ের কথার উত্তরে বকীর বাবারও সাফ জবাব, ‘ক’টা দিন না খেয়ে মরুক, দেখবে আন্দোলন শিকেয় উঠবে।’
বকী বাড়িতে না খেয়ে বিছানায় লেপ্টে থাকে। শুধু মাঝে-মাঝে বাগানের দিকের ঘরের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে লজেন্স, বিস্কুট নিয়ে যায়। বকীর কাছে সময় মতো ওগুলো দিয়ে আসার ভার আমার ওপরেই পড়েছে। বকীকে বিস্কুট দেবার সময় ওর শুকনো মুখ দেখে আমারই টেনশনে মরে যাবার জোগাড়।
ভয়ে ভয়ে পোকাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পোকাদা, বকী যদি মরে যায় ?’
-‘আহা, আহা, কী কথার ছিরি! শুনলে থাবড়াতে ইচ্ছে করে।’ পোকাদার খিঁচুনি আমার কথার স্রোত রোধ করে দিল।
এইভাবে দু’দিন কেটে যাবার পর পোকাদা একটা ভাঙা চোঙ হাতে নিয়ে বকীদের বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল বক্তৃতার ঢংয়ে। আমি চোঙ হাতে পোকাদাকে বক্তৃতা দিতে দেখে চুপিচুপি গণেশের কানে-কানে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা কোথায় পেল রে ?’ ‘ওটা ভজাদার। ভজাদা সন্ধ্যাবেলা পার্কে চানাচুর বেচে, আপাতত পোকাদা ওটা নিয়ে কাজ চালাচ্ছে, পরে আন্দোলন করার সামগ্রী মেম্বারশিপের টাকায় কেনা হবে।’
আমি চুপসে গিয়ে চুপ করে পোকাদার বক্তৃতা শুনতে লাগলাম। পোকাদা চোঙ হাতে বলে চলেছে, ‘বন্ধুগণ আমাদের দলবদ্ধ ঐকান্তিক চেষ্টায় বাধ সাধছে বকীর দাদু। আমাদের এই সামান্য দাবী না মেটা পর্যন্ত বকী একা নয়, আমরা সবাই একে-একে অনশন চালিয়ে যাব, আপাতত আজ বকী তার অনশন ভাঙবে গণেশের হাত থেকে পাতিলেবুর রস খেয়ে। এরপর আমি অনশনে বসব।’
পোকাদার বক্তৃতা শুনে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই বারান্দা জানলা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মেরে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। এমন কি বালক সংঘের ছেলেরাও বার দুই পায়চারি করে গেল। বক্তৃতা শেষ করে পোকাদা আমায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন বলা হল রে, বুড়ো গলবে ?’
-‘গলবে মানে, এতক্ষণে বোধহয় গলে জল হয়ে গেছে!’
-‘বকীদের বাড়িটা নেহাৎ গলির ভেতরে তাই, না হলে দেখতিস আমার বক্তৃতা শুনতে ভিড়ে-ভিড় হয়ে যেত।’
সন্ধের আগেই আমি, গণেশ, পচা, সন্তু, বকী মিলে ছেঁড়া কাপড়, চট আর পোকাদার রাতে শোবার চৌকিটা দিয়ে একটা মঞ্চ বানালাম। খুব শীত, পোকাদা নেতার মতো সেখানে গিয়ে বসল, আমাদের হুকুম দিল, ‘যা তোরা সব খেয়ে-দেয়ে আয়। তোরা ফিরলে আমি পিছন দিকে একটু যাব।’
মঞ্চের পাশে দুটো চট টাঙিয়ে নর্দমার মুখটা আড়াল করা হয়েছিল যদি অনশনরত কারুর বাথরুমের প্রয়োজন হয় সেইজন্য।
আমি বাড়ি ঢুকতেই আমার ছোটোপিসি আমাকে উপদেশ দিল, ‘তোরা চালিয়ে যা। আজকালকার দিনে অধিকার চাইলেই পাওয়া যায় না, তোরা আন্দোলন করে অধিকারীবাবুর কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে নে।’
ছোটোপিসিকে সমর্থন করে আমার মাও বললেন, ‘এ বড়ো অন্যায় অধিকারীবাবুর, ছোটো-ছোটো শিশুর মনে দুঃখ দেওয়া।’
আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে মঞ্চে এসে দেখি পোকাদা গম্ভীর মুখে বসে আছে, গালটা একটু বেশি ফোলা। আমাকে দেখেই পোকাদা ঢোঁক গিলে ফেলল। আমি বললাম, ‘তুমি আমরণ অনশনে বসে চিবচ্ছো ?’
-‘আ-মরণদশা, কথার কথা, যেন ছেলে খেলা! ঠাকুমা দু’টো নারকোল নাড়ু দিয়েছিল, তাই আর কী! আর তা ছাড়া এখনো স্টার্ট হয়নি, এবারে চলবে লাগাতার।’
সত্যি সে রাতে পোকাদা আর কিচ্ছুটি খেল না। সারা গায়ে চাদর, সোয়েটার, কম্বল জড়িয়ে গুটিয়ে বসে রইল। রাত দশটা নাগাদ বকীর দাদু লাঠি হাতে একবার পায়চারি করে গেলেন। রাত বাড়তেই আমরা একে-একে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। পোকাদা অচল, অনড়ভাবে বসে রইল। ভোর রাতে খুব শীতে ঘুম ভেঙে গেলে, দেখি মঞ্চে পোকাদা নেই, ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘পোকাদা- তুমি কোথায় ?’
-‘এই যে এখানে।’
সাড়া দিল পাশের ঘেরা জায়গাটা থেকে। বুঝলাম পোকাদা বাথরুমে গেছে। পোকাদা এল, আমরা গেলাম। আমরা এলাম পোকাদা গেল। ভাবলাম পোকাদার ডায়রিয়া হল নাকি!’
বেলা দশটা পর্যন্ত পোকাদা প্রায় বার দশেক গেল আর এল।
পোকাদার এত চিত্ত চাঞ্চল্য কেন! মন খারাপ নিয়ে পোকাদাকে ঘিরে আমরা বসে। মাঝে আমার মুখ ফসকে একবার বেরিয়ে এল, ‘কি দরকার পোকাদা পুজো-ফুজো করার! চলো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই।’
-‘তোকে কে আটকেছে রে ?’ পোকাদা চোখ পাকিয়ে উঠল। বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ বকীর বাবা আর দাদু আমাদের মঞ্চের সামনে এসে বললেন, ‘যা পুজো কর। কিন্তু দু’দিনের বেশি একদম নয়। দু’দিনের বেশি গাড়ি বাইরে রাখতে পারব না।’
হঠাৎ বকীর দাদুর এরকম সিদ্ধান্ত দেখে আমি বকীকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কি বকী তোর দাদু ভয় পেয়েছে!’
-‘মনে হয় ঠাকুমা দাদুকে ধমকেছেন, আমাদের কথার মাঝখানেই বকীর ঠাকুমার গলা ভেসে এল। বকীর ঠাকুমা তখনো একনাগাড়ে বলে চলেছেন, ‘ভালোয় ভালোয় ওদের কথা শোনো। পরের ছেলের ক্ষতি হলে ভালো হবে না কিন্তু, যদি না শোনো তবে ওদের পাশে গিয়ে আমি আর বৌমাও অনশন করব।’
আমরা সমস্বরে পোকাদাকে কোলে তুলে নিয়ে বলতে লাগলাম, ‘থ্রি চিয়ারস ফর পোকাদা, হিপ, হিপ হুররে....।’ বকী কমলালেবু ছাড়িয়ে এক কোয়া পোকাদার মুখে টপকে দিল। বাড়ি ফেরার সময় আমি পোকাদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ গো পোকাদা, অনশনে থাকতে তোমার খিদে পায়নি ?’
পোকাদা তার পোকা দাঁত রেব করে ফিচ্ করে হেসে বলল, ‘পোকা ভদ্র আর যা কিছুই করুক বোকামো করে না। এই যে দেখছিস সোয়েটার আর কোট-এর প্রতিটা খাপে-খাপেই ভর্তি ছিল কেক আর বিস্কুট। বারবার বাথরুমে যাবার নামে সাঁটিয়ে এসেছি। অবশ্যি তোদের জন্যও ছিল, চাইলেই পেতিস।’ পোকাদার কথা শুনে আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল।
তারপর পোকাদা পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চিনি বিস্কুট বার করে আমার গালে দিয়ে বলল, বোকারাম এবার হাঁ বন্ধ কর।’
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আাগস্ট ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ