Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বদলে যায় পুণ্যশ্লোক ।। জয়তী চট্টোপাধ্যায়

ক্লাস ওয়ান থেকে পুণ্যশ্লোক কদমপুর বয়েজ স্কুলে পড়ছে। বাবা-মা আর ঠাম্মির পছন্দের নাম ডাম্পি। স্কুলের বন্ধুদেরও। অত বড়ো নাম ধরে ডাকা যায়!

পড়াশোনায় ছোট্ট থেকেই দারুণ। বুদ্ধি তীক্ষ্ণ। টেবিল টেনিসে আন্তঃস্কুল চাম্পিয়ান। তুখোড় দাবাড়ুও বটে। আর ক্যুইজ কম্পিটিশনে তো ডাম্পি ছাড়া দল অসম্পূর্ণ। কিন্তু বড়ো খামখেয়ালি আর জেদি। কোনো-কিছুতে না বললে সেটা ওকে দিয়ে করানো কারো সাধ্যে কুলোয় না। তবে, সব থেকে ধারালো ওর দুষ্টু বুদ্ধি।

একবার পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে অংক কষল শ'খানেক। কিন্তু, স্কুলে গিয়ে দেখল বাংলা পরীক্ষা। সারাবছরই তো পড়াশোনা করে, তাই তেমন অসুবিধা হল না। আর বাংলা সাবজেক্টটা ওর দুচোক্ষের বিষ। প্রায় না পড়েই পরীক্ষা দেয়। শুধু ভাবে, ইস, রবি ঠাকুর অবন ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র এঁরা কি করে এত ভালো লিখতেন! আবার উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় ছাড়া কি ভাবা যায়! সুনীল, শীর্ষেন্দু না পড়লে তো ওর রাতের ঘুম আসাই মুশকিল। তবুও, বাংলাকে ও ভালবাসে না।

অংক আর বাংলা রুটিনে ওরকম গড়বড় হওয়ার পরে পরীক্ষার রুটিন পেলেই ওটা এখন মায়ের ডায়েরিতে সাঁটানো হয়ে যায়।

আরো এক অদ্ভুত মায়ার স্বভাব আছে পুণ্যশ্লোকের। জীব-জন্তু ও খুব ভালোবাসে। বিশেষ করে রাস্তার কুকুরকে অভুক্ত দেখলে ও বিস্কুটের টিন উপুড় করে ওদের খাইয়ে দিয়ে আসে। অসুস্থ হলে বাড়িতে এনে সেবা-যত্নও করে। না, বাড়ির কেউ ডাম্পির এসব কাজে কখনো বাধা দেয় না।

স্কুলের সুরজিৎ স্যারকে ও খুব পছন্দ করে। কেমন সাদা বোর্ডে কালো মার্কার দিয়ে এঁকে ফেলেন একটা গুঁফো জোকার কিংবা একগাল হাসি মুখ নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে। ডাম্পি আঁকাতে ভালোই নম্বর পায়। কিন্তু মাঝে-মাঝে সুরজিৎ স্যারের হাতটা ঈশ্বরের কাছে ধার চায়। সেদিন প্রদীপ উল্টে মুখ আর লেজ লাগিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটা ছোট্ট ইঁদুর। যেন তাড়া খেলেই পালিয়ে যাবে!

এত তুখোড় ছেলে একটু মন দিতে পারে না কেবল একটা বিষয়ে। সব স্যারেরাই একটু অবাক হন। শাস্তি পেতে-পেতে ডাম্পির কেমন জেদ চেপে গেছে। এদিকে গোগ্রাসে বাংলা গল্পের বই পড়ে। কিন্তু বাংলা শ, , স লিখতে গেলেই সব একাকার হয়ে যায়। তারপর আবার র, ড়, ঢ়। উঃ! কেন, একটা স আর একটা র থাকলে কি ক্ষতি হত! বিষয়টা বোঝে, কিন্তু যত গণ্ডগোল বানানে। এইতো সেদিন ইউনিট টেস্টে বুদ্ধদেব বসুর 'পুরস্কার' গল্পের ওপর পরীক্ষা ছিল। কিন্তু লিখবে কি! স, , শ সব তিড়িং-বিড়িং করে নাচতে লাগল চোখের সামনে। ভাবখানা এই- কোনটা লিখবে ডাম্পি! ঠিক করো, আমরা লাইন বেঁধে অপেক্ষা করছি। উত্তর ঠিক হলেও বানান ভুলেই সব নম্বর কেটে যায়। বাবা অবাক হয়ে বলেন, কিন্তু কই ডাম্পি ব্যোমকেশ, অরণ্যদেব, প্রফেসর শঙ্কুর বানান তো ভুল হয় না।

বাংলার পৃথ্বীশ স্যার পুণ্যশ্লোককে একটুও পছন্দ করেন না। স্টাফ রুমে সবাই যখন ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন পৃথ্বীশ স্যারের মুখটা বাংলার ৫-এর মতন হয়ে যায়। বাংলায় ৩০-এর ঘরে নম্বর পেলেও ডাম্পির ফার্স্ট হওয়া আটকায় না। অন্য সব বিষয়ে তো ফুল মার্কস। হেডস্যার মাঝে-মাঝেই ডেকে বলেন, পুণ্যশ্লোক, তোর কাছে স্কুলের যে অনেক আশা। একটু মন দিয়ে পড় বাংলাটা।

বাড়িতে বাবা-মা দু'জনেই পড়ান। ক্লাস এইটে ওঠার পরে একজন বাংলার স্যারও রাখা হয়েছে। কিন্তু সেই স্যারকে দেখলেই ওর হুঁকোমুখো হ্যাংলার কথা মনে পড়ে যায়।

পৃথ্বীশ স্যারের বাংলা ক্লাসে প্রায় রোজই কানমলা, বেঞ্চের উপরে দাঁড়ানো বা বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ডাম্পির বরাদ্দ।

রোজ শাস্তি পেতে-পেতে একদিন ডাম্পি মরিয়া হয়ে উঠল। আর দুষ্টুমির পাল্লাও যে বেশ ভারি। সেদিন সবার অলক্ষ্যে বাংলা পিরিয়ডের ঠিক আগে একটা চ্যাপ্টা বাক্স রেখে এল স্যারের টেবিলে। ওদের রোল কলটা পৃথ্বিশ স্যারই করেন। হঠাৎ চোখ পড়ল বাক্সটার ওপরে। এটা আবার কি! ডাম্পি প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দাঁড়িয়ে উঠে বলল, স্যার এটা রঘু বেয়ারা দিয়ে গেল, বলল আপনাকে দিতে। পৃথ্বীশ স্যার বাক্সটা খুলতেই হুড়মুড় করে খানকুড়ি আরশোলা বেরিয়ে পড়ল। ক্লাসের ছেলেরা এমনকি পৃথ্বিশ স্যারও লাফালাফি শুরু করে দিলেন। আরশোলা জিনিসটা এমনই ভয়ঙ্কর। সব যখন সাফসুতরো হয়ে গেল তখন স্যার গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার কাজ সত্যি করে বল ?

পুণ্যশ্লোক একটুও ভীতু নয়। সবাই যখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে তখন ও সটান দাঁড়িয়ে বলল, রোজ-রোজ শাস্তি পেতে ভালো লাগে না স্যার। তাই...

-বাঃ চমৎকার! বাংলার নম্বরটা তো টেনে-টুনে তিরিশের কোঠা থেকে তুলে আনতে পারলি না। এখন আমাকে নাস্তানাবুদ করছিস!

ডাম্পি জানে কাজটা ঠিক হয়নি। ঝোঁকের মাথায় করেছে। ওরই কি কম পরিশ্রম হয়েছে, এতগুলো আরশোলা জোগাড় করে বাক্সবন্দী করতে! এখন তো স্যার সরি বললেও শুনবেন না। নিশ্চয়ই বাবাকে ডেকে পাঠানো হবে! তারপর... আর চিন্তা করতে পারল না ডাম্পি।

বেল পড়তেই পুণ্যশ্লোককে নিয়ে হেড স্যারের ঘরে গেলেন পৃথ্বিশ স্যার, সব বললেন। হেডস্যার বাংলা স্যারকে ক্লাসে যেতে বললেন। ডাম্পি সকলেরই স্নেহভাজন। দুষ্টু, মেধাবী এই ছাত্রটিকে যে ভালো না বেসে থাকা যায় না। হেডস্যার কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেন রে পুণ্যশ্লোক! একটু মন দিয়ে বাংলা পড়তে পারিস না ? আর আজকের কাজটা ঘোরতর অন্যায়? স্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আর বাংলার নম্বরটাকে নিয়ে যেতে হবে আশির কোঠায়।

বাড়ি ফিরে ডাম্পির খুব অনুতাপ হয়। স্যারের সঙ্গে এরকম ব্যবহার কেন সে করল! নিজে বাংলা পারে না তাই! শাস্তি তো পায় সেই জন্যই। তাতে স্যারের কি দোষ! কেমন করে সে নিজেকে ক্ষমা করবে।

সারারাত ঘুমোতে পারল না ডাম্পি। ছটফট করল। সকালে যথারীতি স্কুল। তবে যাওয়ার সময় ও ঠাকুরমার ঘরে ঢুকে কি সব নিয়ে স্কুলব্যাগে ভরল।

সেদিন সেকেন্ড পিরিয়ডে বাংলা ক্লাস। স্যারের সঙ্গে একটা ঢাউস ব্যাগ থাকে। ওটা ক্লাসের বাইরে টেবিলের ওপর রেখে স্যার ক্লাসে ঢোকেন। সেদিন যদিও ডাম্পি সব পড়া করে এসেছিল, কিন্তু ক্লাসের বাইরে বেরনোটা ওর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তাই অন্যমনস্কতে '', 'স্মরণে' '' আর শেষমেষ 'দ্রাবিড়ে' '' বলাতেই পৃথ্বিশ স্যার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ডাম্পিকে ক্লাসের বাইরে বের করে দিলেন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ভাবতে লাগলেন কাল এত কাণ্ড ঘটে গেল তবুও না পড়ে আসা। সারা ক্লাস কিছু পড়াতেই পারলেন না তিনি। ডাম্পি বাইরে থেকে সব লক্ষ্য করছিল।

বেল পড়তেই পৃথ্বিশ স্যার তড়িঘড়ি পা চালালেন হেড স্যারের ঘরের দিকে। ডাম্পির দিকে লাল চোখে তাকালেন একবার। ব্যাগটা এ কাঁধ  থেকে ও কাঁধ করলেন।

১৫ মিনিট পরে আবার ডাম্পির তলব হেডস্যারের ঘরে। তখন অংক ক্লাস চলছিল। ডাম্পির প্রিয় বিষয়। বিমর্ষ মুখে 'স্যার আসব' বলে অনুমতি নিয়ে ও হেডস্যারের ঘরে ঢুকল। সামনে মস্ত বড়ো টেবিলের ওপরে সারি-সারি সাজানো আছে কুলের আচার, আমের আচার, নিমকি, গজা, চানাচুরের প্যাকেট। সঙ্গে ছোট্ট একটা সাদা চিরকুট- স্যার, এবার আমি বাংলায় আশির ওপরে পাব। কথা দিলাম। কাল আমি অন্যায় করেছিলাম। বাবা তো পকেট মানি দেন না। এগুলো ছাড়া আমার আর দেবার কিছু নেই। ক্ষমা করে দেবেন স্যার...।

সেদিন ডাম্পির উপরি পাওনা হল হেডস্যারের অট্টহাসি আর পৃথ্বিশ স্যারের ওর মাথায় হাত রেখে প্রাণভরে আশীর্বাদ।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত - চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ