![]() |
-ইরাণী, তুই কোথায় যাচ্ছিস ?
ইরাণী কোনো উত্তর দিল না। ও সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটেই চলেছে।
-কিরে ইরাণী, যাচ্ছিস কোথায় ? এবারও ইরাণী কোনো উত্তর দিল না।
-কিরে মেয়ে! উত্তর দিচ্ছিস না বড়ো ? খুব ডাঁট হয়েছে দেখছি তোর!
কিন্তু উত্তর দেবে কে ? ইরাণী একেবারে ঘোরের মধ্যে রয়েছে যে! কোনো দিকে ওর লক্ষ্যই নেই! সামনের দিকেই হাঁটছে শুধু।
যে রাস্তা ধরে সে হাঁটছে, সেই রাস্তা সোজা গিয়ে ঠেকেছে আলোমতি পাহাড়ের গায়ে।
কিন্তু হলটা কী ? বিশাখের এত ডাকাডাকিতেও মেয়েটার কোনো হুঁশ নেই! ভারী অহঙ্কার হয়েছে তোর। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা!- বলেই বিশাখ ছুটল ইরাণীর দিকে।
ছুটতে ছুটতে বিশাখ ধরে ফেলল ইরাণীকে। তার লাল-কমলা ওড়নাটি ধরে পেছন দিকে টান দিতেই ইরাণীর চটকা ভাঙল। বেশ অবাক হয়েই সে জিজ্ঞেস করল, বিশাখ! কী হল ?
-কী হল মানে। এতক্ষণ ধরে তোকে ডাকছি, সাড়াই দিচ্ছিস না! কী এমন ভাবছিস বল তো ?
-তুই ডাকছিলি ? আমাকে! কখন ডাকছিলি ? কই, শুনতে পেলাম না তো ? আশ্চর্য!
-শুনতে যে পাসনি, সে তো বুঝতেই পারছি! কিন্তু তুই ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিস কোথায় ?
বিশাখের প্রশ্ন শুনে অবাকই হল ইরাণী। তাই তো! সত্যিই তো! আমি যাচ্ছিলাম কোথায়!-এতক্ষণে চটকা ভাঙল তার। সে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, আমি যাচ্ছিলাম কোথায় ? তাই তো! আমি কোথায় যাচ্ছিলাম ?
-কেন, তুই কোথায় যাচ্ছিলি, তাই তুই জানিস না নাকি!
-আমি যে যাচ্ছিলাম, সেটাই তো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! কোথায় যাচ্ছিলাম, সে তো পরের কথা।
এরকম কথাবার্তা শুনলে ধন্দ লেগে যাবারই কথা! বিশাখের সে রকমই ধন্দ লেগে গেল। একটা মজার ব্যাপার নয় কী ? একজন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, সে যদি বলে, আমি যাচ্ছিলাম কি না তাই আমি বুঝতে পারছি না, তার চেয়ে আশ্চর্যের আর কীই বা হতে পারে! ফলে বিশাখের ধন্দ লাগল। অনেকটাই লাগল।
ইরাণী আর বিশাখের কথা একটু বলে নিই। সবুজ গাছপালা ঘেরা পাহাড়ের কোলো ছোটো একটা বাড়িতে থাকে ইরাণী। এখানে যদিও সবই পাহাড়, তবুও পুব দিকে তাকালে যে পাহাড়ের চুড়োটা দেখা যায় সেটা বেশ উঁচু। সেই পাহাড় ঘিরে বনটাও বেশ ঘন। ইরাণীদের গ্রামের নাম রঙটঙ। উঁচু পাহাড়টির নাম আলোমতি।
ইরাণীদের ছোটোখাটো বাড়ির ডানপাশ দিয়ে দক্ষিণদিকে একটা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে। সেই রাস্তা ধরে গুনে-গুনে ঠিক দশ মিনিট হাঁটলেই বিশাখদের বাড়ি। দু’জন একই স্কুলে পড়ে। ইরাণী আর বিশাখের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব।
এই যে এখন দু’বন্ধুই ভারী চিন্তায় পড়ে গেছে। কেমন যেন সব খাপছাড়া ব্যাপার। ইরাণী ভাবছিল, আমি কোথায় যাচ্ছিলাম, বুঝতেই পারছি না! বিশাখ ভাবছে, যা বাবা! ওকে এতক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছি, শুনতেই পাচ্ছে না!
ওরা দু’জন এখন ঠিক যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে একটা পাহাড়ী ঝোরা নেমে গেছে আরো নীচে সমতলের দিকে। ঝোরার বাঁ পাশ বরাবর গেছে কমলা লেবুর বাগান। লেবুতে এখনো রঙ ধরেনি। কাঁচা সবুজ গায়ের রঙ। ইরাণী আর বিশাখ কমলা বাগানের পাশের সরু পাথুরে রাস্তা ধরে হাঁটছিল আনমনে। তখনই ওরা পাশের ঝোপে খসখস আওয়াজ শুনতে পেল। সেদিকে চোখ পড়তেই ওরা প্যাঙ্গোলিনটাকে দেখতে পেল। সারা গায়ে তার রূপোলি রঙের আঁশ। ছোটোখাটো একটা তৃণভোজী ডাইনোসর যেন। বনবাদাড়ের মধ্য থেকে ঘাড় উঁচু করে প্যাঙ্গোলিনটা ইরাণী আর বিশাখকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বন থেকে বেরিয়ে উঠে এল সরু রাস্তাটার ওপর। এবার সে চলতে শুরু করেছে রাস্তা ধরে সামনের দিকে। তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল বিশাখ ও ইরাণী।
ওরা কেন প্যাঙ্গোলিনের পিছন পিছন হাঁটছে ? কি আশ্চর্য ঘটনা! কোথা থেকেই বা প্যাঙ্গোলিনটা এল ? ইরাণী আর বিশাখকে দেখে কেনই বা বন ছেড়ে রাস্তায় নামল প্যাঙ্গোলিন, কে জানে!
তার চেয়েও বড়ো কথা, প্যাঙ্গোলিনের সবুজ-হলুদ চোখের সঙ্গে দুই বন্ধুর চোখাচোখি হওয়া মাত্রই ওদের যেন নিমেষে জাদু করে ফেলল রূপোলি জন্তুটা। ইরাণী আর বিশাখ ওমনি বিনা বাক্যব্যয়ে প্যাঙ্গোলিনের পিছু-পিছু চলতে শুরু করেছে। ভারী আশ্চর্যের নয় কী ব্যাপারটা ?
দুই
এভাবে ওরা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ হাঁটল। বহুক্ষণ! হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেল আলোমতি পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ বনের দোরগোড়ায়। বিশাখ বা ইরাণী কেউই কোনোদিন আলোমতি পাহাড়ের কাছাকাছিও আসেনি। ওদের রঙটঙ গ্রাম থেকেই পাহাড়টাকে দেখেছে।
কিন্তু ফের অবাক কাণ্ড। ঘন বনের মধ্যে ঢুকে সেই রূপোলি প্যাঙ্গোলিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।
যেই প্যাঙ্গোলিন ওদের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল, ওমনি ঘোর কেটে গেল দুই বন্ধুর। ওরা এতক্ষণ যেন স্বপ্নের মধ্যে ছিল। ঘোর কাটতেই দু’জন অবাক। দু’জনে একসঙ্গেই চেঁচিয়ে বলে উঠল- এ আমরা কোথায় এসেছি ? কী করে এলাম ?
ওমনি বনের মধ্য থেকে কে যেন উত্তর দিল, তোমরা আলোমতি পাহাড়ের গায়ে ভানুমতি বনে এসেছ।
-কিন্তু এইমাত্রই তো আমরা কমলালেবু বাগানের পাশের রাস্তায় ছিলাম!
-ছিলে তো ছিলে! তাতে কী হয়েছে ? এখন তোমরা ভানুমতি বনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছো, এটাই সত্যি।
-কিন্তু তুমি কে ? কোথা থেকে কথা বলছ ?
-এই তো আমি। পেছনে তাকিয়ে দেখ। আর এটাও জেনে রাখো, আমিই তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছি।
পেছনে তাকিয়ে ইরাণী আর বিশাখ অবাক হয়ে গেল। দেখতে পেল একটা মানুষকে। লোকটা পাগল-পাগল দেখতে মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, উশকো খুশকো একগাল দাড়ি।
-তুমি কে গো ? প্রচণ্ড অবাক হয়ে বিশাখ আর ইরাণী জিজ্ঞেস করল।
আমি মানুষ। আবার কী ? তোমরা যেমন তেমনিই! বলতে পারো আমি তোমাদের বন্ধুই।
অচেনা মানুষটা আমাদের বন্ধু হতে যাবে কেন ? -এইরকমই ভাবছিল বিশাখ আর ইরাণী। কিন্তু লোকটার চোখে চোখ পড়তেই সে ভাবনা নিমেষে উধাও হয়ে গেল। ওদের মনে হল সত্যিই এই মানুষটা চমৎকার! সত্যিই মানুষটা আমাদের বন্ধু, আমাদের আপনজন।
ইরাণী জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের এখানে নিয়ে এলে কেন হঠাৎ ?
-এমনিই। মনে হল আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে একটু গল্প-গুজব করি। তাই তোমাদের এখানে নিয়ে এলাম। বহুদিন হয়ে গেল তোমাদের সঙ্গে কথা হয়নি, দেখা হয়নি। তাছাড়া মনটাও আমার বেশ কিছুদিন হল ভালো নেই।
-কেন ভালো নেই ? জিজ্ঞেস করল বিশাখ।
-তোমরা কি জানো, এই শান্ত পাহাড়ে মাঝে মাঝে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুনে সবুজ বন খাক্ হয়ে যায়।
-কিসের আগুন ?
-হিংসের আগুন। ভারী নোংরা ব্যাপার-স্যাপার।
মানুষটার কথার কোনো মানে বুঝল না ওরা দুই বন্ধু। ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইল। একটু সময় চুপ করে থেকে একজন আমতা-আমতা করে বলল, আমরা তোমার কথার কিছু বুছছি না গো!
-তোমরা রঙটঙ পাহাড়েই থাক তো ?
-হ্যাঁ।
-সবুজ পাহাড়ে নিরিবিলিতে থাক বলে পাহাড়ের মাথায় কি হচ্ছে টেরই পাও না।
-তা পাহাড়ে কী হচ্ছে শুনি ?
-হচ্ছে অনেক কিছুই। সে তোমাদের এখন জানার দরকার নেই। শুধু এটুকু জেনে রাখো, পাহাড়ের মানুষের মনে এখন আগুন জ্বলছে।
-তাই নাকি!
-আর একদিকে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভরে থাকছে পাহাড়ি বন। তোমরা খেয়াল করে দেখেছ কি, ভানুমতী বনের গাছপালাগুলো কেমন নুয়ে পড়েছে ? দ্যাখো, সবুজ পাতাগুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে!
বিখাশ আর ইরাণী ভানুমতী বনের গাছপালাগুলো ভালো করে দেখে বুঝল মানুষটা কিছু ভুল বলেনি। পুরো বনই কেমন মিইয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো আর ঝকঝকে তরতাজা নেই।
-হ্যাঁ গো! তুমি ঠিকই বলেছ! নিয়ে এলাম। তোমরা শুধু লক্ষ্য রেখো, পাহাড়ি ঝোরা বেয়ে ওই আগুনের ছাই আর ধোঁয়া যেন কিছুতেই রঙঠঙ্ গ্রামে না পৌঁছয়।
-তা হলে কী হবে ?
-তা হলে কমলালেবুর বাগানে গাছের শিকড়ে চলে যাবে বিষমাখা জল। তাতে সমস্ত কমলালেবু হয় শুকিয়ে যাবে, নয়তো সব কমলালেবুতে বিষ ঢুকে যাবে। সেই লেবু খেলেই মানুষের মন বিষাক্ত আর হিংসুক হয়ে উঠবে।
-আমরা ঝোরার জল পবিত্র রাখব কী করে ?
-তোমরা রোজ ঝোরার জলে সবুজ পাতা ছড়িয়ে দিও। আর সবুজের যাতে অভাব না হয়, গাছেদের সব সময় যত্নআত্তি কোরো। আরো আরো গাছ লাগিও।
-আমরা তাই-ই করব। কিন্তু তোমার নামটা বল!
-আমাকে সবাই বাঁশিওয়ালা বলেই জানে।- এই বলে বাঁশিওয়ালা তার কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে বের করল একটা বাঁশের বাঁশি। বাঁশিটি ঠোঁটে ঠেকিয়ে ফুঁ দিতেই আকাশে-বাতাসে সুরের ঢেউ উঠল। সে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে ইরাণী আর বিশাখ ফের পৌঁছে গেল ওদের গ্রাম রঙটঙ।
সেদিন থেকেই ইরাণী আর বিশাখ পাহাড়ি ঝোরার জল পবিত্র রাখতে সবুজ পাতা ছড়িয়ে দেয়
ঝোরায়। পাশাপাশি দু’জন পাহাড়ঘেরা
গ্রামের নানা জায়গায় লাগায় গাছের চারা। প্রত্যেকটি গাছকে যত্ন করতে ওরা দুই বন্ধু
কখনোই ভুলে যায় না।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯
0 মন্তব্যসমূহ