উধো বড়ো হবে। হলই বা বয়স মাত্র ১০ বছর। তাতে কি, খুব শিগগিরই তাকে বড়ো হতেই হবে। অবশ্য বড়ো
হতে চাওয়ার কারণও আছে। বড়ো হওয়ার যেমন বেশ সুবিধা, তেমন বেশ অসুবিধা ছোটো হওয়ারও।
ভূত পরিবারের এই সদস্যটি তাই মাঝে-মধ্যে একলা থাকলেই মনমরা হয়ে পড়ে। আর ভাবে
বড়ো হওয়ার আকাশকুসুম ঠিকানা। অবশ্য বড়ো হওয়ার এই খেয়ালটা মাথা নাড়া দিয়ে
উঠল এবার ভোটের সময় থেকেই।
ভোটের একটা উৎসাহ ছড়িয়ে পড়েছিল সব ভূতেদের মধ্যেই। ভূতমহলে ভোটটা এবারে নতুন। না প্রথমে মতৈক্য ঘটছিল না, তারপর ঠিক হল ভোট হবেই। আর না হয়েই বা যায় কোথায়, এই ভোট-ভোট করে প্রতিদিন কত মানুষই মরছে, তা সেই মানুষগুলো মরে ভূত হয়ে কি নিয়ে বাঁচবে ? অগত্যা ভোট।
মানুষেরা কত উন্নত হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই পুকুর-জঙ্গল সাফ করে বড়ো-বড়ো বিল্ডিং তুলে ফেলছে। সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ে উঠছে ভূতেদের বিপদ। ভোট করে-করে মানুষগুলো নিজেদের কত উন্নতি করে ফেলছে, আর ভোট না করে ভূতগুলো ভূত-ই হয়ে আছে। তাই এবার ভোট হবেই। ভূতেদের স্বার্থেই ভূত নেতা নির্বাচিত হবে। একটু আগেই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
এই ভোট নিয়ে উধোর উৎসাহ তুঙ্গে। কত খাটা-খাটনি সারাদিন। নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত নেই। সব গাছে-গাছে, শ্মশানের দেওয়ালে, রেললাইনের ধারে, প্রতীক চিহ্ন আঁকা, পুকুরঘাটে, শ্যাওড়াগাছে কত মিটিং-মিছিল করা, সব ভূতেদের কাছে গিয়ে-গিয়ে বোঝানো, আরো কত কাজ।
শেষে এল ভোট। সারাদিন ফাই-ফরমাশ খাটল উধো। কিন্তু যখনই ভোট দিতে গেল, তখনই...। যে দুজন ভোট নিচ্ছিল, ছোটো বলে তাকে একদম বের করে দিল। আর এই যে অন্যায়ভাবে উধোকে বের করে দেওয়া হল তাতে কোনো বড়ো ভূত প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না। তাতেই তার সবচেয়ে রাগ, আর সেজন্যই তাড়াতাড়ি বড়ো হবে সে।
উধো ভেবে দেখেছে ছোটো হলেই ঝামেলার একশেষ। সারাক্ষণ শুধু ফরমাস খাটা। এটা কর, ওটা কর, এটা নিয়ে আয়, ওকে ডেকে দে।
উফ, বিরক্তির শেষ নেই। বড়ো হলে কি কেউ বলতে পারত ? তার ওপর ছোটো মনে তার মাঝে-মাঝে খুব খেলতে ইচ্ছে হয় ? কিন্তু মানুষের খেলার মাঠেরই যা অভাব দেখা দিচ্ছে, তাতে উধো ভূতের জায়গা কোথায়!
এদিকে ভোটের শেষে নবগঠিত ''ভূত সরকার'' বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করে ফেলেছে। ৩ ভূতের এক কমিটি গঠন করে ''মানুষ সরকার''-এর কাছে পাঠিয়ে প্রতি রাতে অন্তত ২ ঘণ্টার লোডশেডিং একেবারে পাকাপাকি লিখিয়ে নিয়েছে। যাতে সকল ভূত রাতে অন্তত দু-ঘন্টা হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারে। তবে এতে উধোর একটু অশান্তি দেখা দিয়েছে। হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে গেলেই তার মনখারাপ শুরু হয়ে যায়। খালি বড়ো হতে ইচ্ছে করে। একা-একা কত আকাশকুসুম চিন্তা করা যায়। তাই এবার সে ঠিক করেছে আর একা নয়, সকলকে দিয়েই তার এই বড়ো হবার সমস্যার জন্য ভাবাবে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। প্রতি আমাবস্যায় ''প্রগতিশীল ভূত কমিটি'' নিজেদের মধ্যে মিটিংয়ে বসে। সেই মিটিংয়ে যোগ দিয়েই নিজের সমস্যার কথাটা বলে ফেলল উধো। প্রথমে সমস্যাটা সবাই মাথায় নিতে না চাইলেও, ''সমস্যা সমাধান মন্ত্রী'' মিস শ্যাওড়া দেবী মিটিংয়ে যোগ দিতেই সকলে সমস্যাটার গুরুত্ব বুঝতে পারল। কারণ মিস শ্যাওড়া দেবী মন্ত্রী হওয়ার আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সকলের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন। ''মানুষ মন্ত্রীদের'' মতো তিনি তো আর প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারেন না!
সমস্যার সমাধানও হয়ে গেল খুব শিগগির। উধোর গালে যদি দাড়ি থাকত তাহলে কি, কেউ তাকে বড়ো না ভেবে থাকতে পারত ? আর অসময়ে দাড়ি বানানোর সহজ উপায় বার-কয়েক দাড়ি চেঁছে ফেলা।
বুদ্ধিটা বেশ মনে ধরল উধোর। সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে সেই রাতেই সেলুনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। উধো চেয়ারে আর তার সব সাঙ্গ-পাঙ্গরা ওকে ঘিরে মাটিতে বসে আছে। বেশ খোশ-মেজাজে চেয়ারে হেলান দিয়ে গান শুনতে শুরু করল উধো। নাপিত গালে সাবান ঘষতেই সুড়সুড়ি লাগল। মাঝে-মাঝে ফোকলা দাঁতে দু-একবার হেসে ফেলল সে। কিন্তু সব হাসি, কান্না হয়ে গেল তখন, যখন নাপিত খুর বার করতে গেল। লোহাতেই যে তার সবচেয়ে ভয়। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখল ততক্ষণে তার সবকটা সাঙ্গ-ভূত উধাও। অবশেষে চেয়ার থেকে তাকেও ভ্যানিশ হতে হল।
এরপর থেকে মিস শ্যাওড়া দেবীর ওপর ভীষণ চটল উধো। সমাধানের নাম করে তাকে অত বড়ো বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া কি একটা দায়িত্বপূর্ণ মন্ত্রীর উচিত! অথচ এই শ্যাওড়া দেবীর জন্যই ভোটের আগে কত গাছে-গাছেই না পোস্টার মেরেছে উধো। প্রথমে বিরোধী দলের হয়ে কাজ করার কথা ভেবেছিল, তারপর নিজেই সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিল সে।
এদিকে আন্দোলন দিন-দিন প্রবল আকার নিচ্ছে দেখে, মিস শ্যাওড়া দেবীর তো আর মাথার ঠিক নেই। রোজদিনই ছোটো-ছোটো বয়সের ভূতেরা এসে তাদের বড়ো করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। এক উধোকে বড়ো করতে গিয়ে এত ঝামেলা, এত হাজার-হাজার উধোকে বড়ো করার কথা ভেবেই চুল ছিঁড়তে শুরু করলেন ''সমস্যা সমাধান মন্ত্রী''। শেষে চুল ছিঁড়তে-ছিঁড়তেই হালকা সমাধান মাথায় এল। ওদিকে ''প্রগতিশীল ভূত কমিটি''র গেটের সামনে লম্বা লাইন। লাইনে স্লোগান- ''আমাদের দাবি মানতে হবে, বড়ো আমাদের করতেই হবে''। মিস শ্যাওড়া দেবী সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এক্ষুনি পাঁচ ভূতের প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছি। তারা মানুষ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই তোমাদের সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।
কিন্তু উধো একেবারে নাছোড়। যতক্ষণ না সে বড়ো হবে তার আন্দোলন চলবেই। সে এটা সাফ জানিয়ে দিল মিস শ্যাওড়া দেবীর মুখের ওপর। পড়িমরি করে পাঁচ ভূতের কমিটি নিয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লেন, মানুষ সরকারের সঙ্গে মিটিং করার জন্য।
ওদিকে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আন্দোলনের চেহারাও বাড়ছে। আর যত বাড়ছে, ততোই মুখ হলুদ হয়ে উঠছে প্রগতি ভূত কমিটির কর্তাব্যক্তিদের। সর্বক্ষণ তারা ফোন করে জানতে চাইছেন। কিন্তু মিস শ্যাওড়া দেবী তো আর ফোন ধরেন না। অবশেষে তিনি ফোন করে বললেন, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আর তিনি নিজেই সমাধান হাতে করে নিয়ে আসছেন।
সমাধানের সংবাদটা উধোর কানে যেতেই স্লোগান একটু বন্ধ হল বটে, সেই সঙ্গে শুরু হল প্রতীক্ষা। অবশেষে সমস্যা-সমাধান মন্ত্রী মিস শ্যাওড়া দেবী মিছিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সকল খুদে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে দাঁত-ভাঙ্গা-হাসি হেসে বললেন, যে সমস্যা যত জটিল, সমাধান তার তত সরল। সমস্যার সমাধান আমি নিয়েই এসেছি। তবে প্রথমে যার সমস্যা সে-ই সকলের সমস্যার সমাধান করবে। এই বলে উধোকে সামনে ডেকে তার হাতে স্লেট-পেন্সিল তুলে দিলেন। স্লেট-পেন্সিল হাতে পেয়ে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ সেদিকেই চেয়ে রইল উধো। এতক্ষণে পাঁচুদের কমিটিও এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে সমস্যা সমাধান মন্ত্রীর পিছনে। মিস শ্যাওড়া দেবী মাইক হাতে বেশ উঁচু গলাতেই বলছেন, বড়ো যদি হতে চাই, লেখাপড়া করা চাই। আমি উধোর স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে এসেছি। এবার ও লেখাপড়া শিখবে আর বড়ো হবে। তারপর তোমাদেরও বড়ো করবে। ততদিন আমি তোমাদের জন্য স্কুল তৈরির ব্যবস্থা করছি।
এরপর প্রগতিশীল ভূত কমিটির উদ্যোগে মহাসমারোহে শুরু হল স্কুল তৈরি, আর ব্যাগ কাঁধে স্কুলের দিকে এগোতে লাগল উধো।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬
0 মন্তব্যসমূহ