দোয়েল আর দোয়েলনি। দোয়েলনি মানে দোয়েলের বউ। একটা বড়ো গাছের ছোট্ট কোঠরে বাসা বেঁধেছে। সুন্দর মোলায়েম বাসা। চাষির খড়ের গাদা থেকে খড় এনেছে বয়ে। বনে ঘুরঘুর করে কুড়িয়ে এনেছে পালক। তুলো, পাটের আঁশ। সব মিলিয়ে আরাম করার মতো বাসা করেছে দোয়েল আর দোয়েলনি।
দুজনের সংসার। কোনো ভাবনা নেই, চিন্তা নেই। তবে ওদের চোখে অনেক স্বপ্ন। দোয়েলনি দুটো ডিম পেড়েছে। পুচকে দুটো ডিম। পালক তুলোর তোষকে দেখতে বেশ লাগে। এই ডিম ফুটে এক সময় বাচ্চা বেরোবে। ওদের চোখ-ঠোঁট, ডানা-পা সবই থাকবে। চোখ ফুটবে, পালক গজাবে। বড়ো হবে, চিঁচিঁ ডাকবে। তারপর বাসার আগল ভেঙে যাবে বনে। সন্তানকে ঘিরে মা-বাবারা এমন স্বপ্ন দেখে, দোয়েল-দোয়েলনির মনেও সেই স্বপ্ন।
দুজনে তাই পালা করে বসে ডিমে তা দেয়। কখনও দোয়েল কখনও দোয়েলনি। এক রাতে দোয়েলনি টের পেল, তার বুকের কাছে কি যেন নড়ে চড়ে উঠছে। আনন্দে সে ঝটকা মেরে সরে গেল। জেগে গেল দোয়েল। সবে ডিম ফোটা বাচ্চাদের মুখ চেয়ে কি খুশি।
বাইরে ঘন অন্ধকার। নিঝুম রাত। তবু দোয়েল-দোয়েলনি নীল চোখে ঘুম এলো না আনন্দে। ভোরের আলো ফুটছে পুবাকাশে। কত না মিঠে সুরে গান গাইল ওরা। ওদের বাঁধভাঙ্গা খুশির কারণ বনের কেউ জানলো না।
তারপর ভোরের মিঠে রোদ্দুরে শুরু হল আনাগোনা। পিঁপড়ের ডিম কুড়িয়ে আনে, বনের পোকামাকড় কুড়িয়ে আনে, ফুলের মধু কুড়িয়ে আনে, বাচ্চাদের জন্য। কখনও দোয়েল যায়, কখনও দোয়েলনি। একজন বাইরে বেরোয় তো অপরজন ঘর পাহাড়া দেয়। খাবার নিয়ে এলে বাচ্চারা হাঁ করে। অমনি টুক করে মুখে পুরে দেয়।
হাঁ করলে বাচ্চাদের মুখের ভিতরটা কেমন সুন্দর লাগে। মা-র চোখ এড়ায় না। সে খুশি হয়ে দোয়েলকে বলে, খোকা-খুকুর মুখের ভিতরটা কেমন টুকটুক করে দেখেছ ?
-দেখবো না আবার হাঁ করলে আমার কি মনে হয় জানো ?
-কি ?
-মনে হয় ফুলের পাপড়ি খুলছে।
-চমৎকার বললে তো! তবে একটা মজার কথা বলি।
-থামলে কেন ? বলো!
-রাতেরবেলা শুলে আমার ঠোঁটটা হাঁ করে ওর মুখে পুরে নেয়।
-তাই নাকি? দোয়েল হাসল, অবুঝ শিশু ওরা মনে করে খাবার।
-হবে হয়তো!
-হয়তো কি ? তাই। এরপর শিয়রে ডুমুর পাতায় পিঁপড়ের ডিম রেখে দেবে। অমন করলে খাইয়ে দেবে।
-একদিন রাতের তৃতীয় প্রহরে বিকট চিৎকারে সারা বনভূমি কেঁপে উঠল। দোয়েল-দোয়েলনির গাছের মাথায় বসে ডাকছে এক ঈগল পাখি। ডাকটা ধারালো তরবারি মতো বাতাস কেটে অনেক-অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ল। কোটরের বাসায় বসে কেঁপে উঠল, দোয়েল দোয়েলনি। দোয়েলনি বলল, ওগো শুনছো কে ডাকছে ?
-শুনেছি।
-এখন কী হবে!
-কিচ্ছু হবে না।
আমরা না হয় উড়ে যাব। কিন্তু খোকা-খুকু কি করবে ? ওরা তো পালাতে পারবে না। দোয়েলনির চোখে জল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
দোয়েল বলল, কোনো ভয় নেই। ঈগলের সঙ্গে ভাব করব খুব ভোরেই। তুমি শুধু আমার কাণ্ডটা দেখবে।
-পারবে তুমি ?
-না পারার কি হয়েছে ? তোমার মনে নেই, সেদিন বাসার মুখ আগলাবার জন্য চিলের কাছ থেকে কেমন পালক চেয়ে এনেছিলাম। কেমন লম্বা সাদা খয়রি পালক। চিলের গা খুঁটে দিলাম। চিল খুশি হয়ে দিল। একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা পালক।
-না হলে বর্ষায় আমাদের মরণ হত। দয়ালু বটে আমাদের চিলখুড়ো।
-দয়া কি সাধে ? কাজ পেয়েছে তাই দয়া। ফাই-ফরমাস কম তো খাটিনি।
-তা যা বলেছ, তবে মনে আছে তো, চিলখুড়ো আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল ওদের বাড়িতে যেতে।
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ? ওর ঘর কোথায় জানো ? নোনা গাঙের ওপারে, হোগলা বনের ধারে, আকাশছোঁয়া তালগাছে। সে কি এখানে ?
-বুঝেছি-বুঝেছি। দোয়েলনি বলল। উত্তুরে বাতাস এলে, আমরা হাওয়ায় ভর করে নোনাগাঙ পেরবো।
-তা মন্দ বলনি। হাওয়ায় ভর দিয়ে যেতে ভালোই লাগবে।
পরের দিন ভোরে উঠল দোয়েল। দোয়েলনি বাচ্চাদের নিয়ে তখনও ঘুমিয়ে। বউকে না জানিয়ে দোয়েল গাছের মগডালে এসে বসল। মিঠে সুরে গান জুড়ে দিল। সে সুরের কত বাহার, কত কেরামতি! ঈগলের কানে দারুন লাগল। সুরের আরামে চোখ বুজে আসছিল তার। হঠাৎ সে হাঁক দিল, কে গায় ?
-আমি মহারাজ।
-আমি কে ?
-শ্যামা পাখির বড়দা দোয়েল।
-এ সময় এখানে গান গাইছ ব্যাপার কি হে ?
-মহারাজ রাতে টের পেলাম, আপনি এসেছেন এখানে।
-কি করে টের পেলে ?
-আপনার হুংকার শুনে। শোনামাত্র কি যে আনন্দ হল!
-কেন-কেন ?
-এতদিন দারুন ভয়ে ছিলাম, বউ ছেলেপেলেদের নিয়ে। ডাকাত কাক বাচ্চাদের দিকে তাক করে আছে সব সময়। আপনি আসায় সে ভয় কেটে গেল। তাই গান শোনাচ্ছি। রাজবাড়ী, ভোরবেলায় নহবত বাজবে না! সে কি হয় ?
কথা শুনে ঈগল দারুণ খুশি হল। বলল, অভয় দিচ্ছি, কেউ তোমাদের টিকি ছুঁতে পারবে না।
তখন আর কে পায় দোয়েলকে! বউকে খবর দিতেই সে খুশিতে আটখানা। বলল, সাহস বটে তোমার।
-তবে, ঈগলকে কেমন ঘোল খাইয়ে দিলাম। এমনিতেই তো ভোরবেলা আমাদের গান গাইতে হয়। সেটাকে কেমন ঈগলের সম্মানে চালিয়ে দিলাম।
যা হোক এরপর রোজ-রোজ দোয়েল-দোয়েলনি সূর্য ওঠার আগে ঈগলের মাথার কাছে বসে সুরেলা কন্ঠে গান গায়। ঈগল সে গান শোনে আর মনে-মনে ভাবে, সত্যিই সে পাখিদের রাজা।
বড়ো শত্রু বশ মানায় দোয়েল-দোয়েলনির আর কোনো ভয় রইল না। পরম সুখে ওদের বাচ্চারা বড়ো হয়ে ওঠে। পালক গজায়, বিচিত্র রঙের পালক।
কিন্তু লক্ষীছাড়া কাকটা সুযোগের অপেক্ষায়, ঠিক দুপুরটায় আড়ি পেতে বসে থাকে। কখন দোয়েলরা বাসা ছাড়বে আর সেই সুযোগে বাচ্চাদের লুফে নিয়ে যাবে।
নিরুপায় হয়ে একদিন দোয়েল কাকের সম্বন্ধে নালিশ করল ঈগলকে, মহারাজ কাকব্যাটাকে একটু শিক্ষা দিন। ওকে দেখে ভয় করে। ব্যাটা তাকে-তাকে আছে আমার বাচ্চাদের খাওয়ার জন্য।
যেই না এই কথা বলা, আর যায় কোথায়? ঈগল সত্যি-সত্যিই একদিন তেরে গেল কাকের দিকে। কাককে প্রায় ধরে ফেলে আর কি! বেচারা কাক তো কা-কা করে প্রাণ নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। কান্ড দেখে দোয়েল-দোয়েলনি বাসায় বসে হাসে আর গড়াগড়ি খায়। বাপ-মার দেখাদেখি বাচ্চারাও হাসে।
দোয়েলের বাচ্চারা বড়ো হয়েছে শুনে একদিন ঈগল দেখতে এল ওদের বাসায়। বাচ্চারা ঈগল দাদুকে গড় হয়ে ভক্তি করল। দোয়েলনি হেসে বলল, দাদু হল এ বনের রাজা। উড়তে-উড়তে ঐ মেঘের দেশে চলে যায়।
এই শুনে বাচ্চারা বায়না ধরল, তারাও ওই মেঘের দেশে যাবে দাদুর সঙ্গে। শুনে ধমক দিল দোয়েল। ঈগল পাল্টা ধমক দিল ওদের বাপকে। কারণ ওরা অবুঝ। ওদের বায়না রাখতেই হয়।
একদিন রোদ উঠলে ঈগল এল। দোয়েলের বাচ্চাদের মেঘের দেশে নিয়ে যাবে বলে। ওরা ঈগলের গলা আঁকড়ে ধরল। দোয়েল দোয়েলনির ভয় করতে লাগল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না।
দেখতে-দেখতে ঈগল পাখা খুলে দিল। ঘুরে-ঘুরে পাক খেয়ে উঠতে লাগল আকাশে। উঠতে-উঠতে ছোটো পাতার মতো হয়ে গেল। দোয়েল দোয়েলনির ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। দোয়েলনি তো কেঁদেই ফেলল। শত হলেও মা-র মন। যাহোক, পনের-বিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল ঈগল। বাচ্চারা আনন্দে লাফালো।
এরপর থেকেই ঈগলের সঙ্গে দোয়েলের বাচ্চাদের মাখামাখি শুরু হয়ে গেল। গল্প-গুজব আর হাসাহাসি। দিনের শেষে দোয়েলের বাসার সামনে একবার আশা চাই তার। এ-নিয়ে দোয়েল-দোয়েলনি ভয়ে মরে। কারণ ঈগল তো যে সে পাখি নয়। পাখিদের যম। কাজেই যেমন করে হোক, এখান থেকে পালাতে হবে। ঈগলকে না জানিয়ে গোপনে পালাতে হবে। এমনকি বাচ্চারাও জানবে না। শুধু রাতের বেলা শোবার সময় ওদের বাচ্চাদের বলল, কাল আমরা খুব ভোরে এক জায়গায় বেড়াতে যাব। কোনো শব্দ যেন না হয়।
-কোথায় যাব মা ? বাচ্চারা বলল।
-যাব তোমাদের মামার বাড়ি। দেখবে মামি কত আদর করে। দিদা কত খুশি হয়।
বাচ্চারা আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল। মা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। কারণ এবার ঘুমোতে হবে। কোনো কথা বলা চলবে না। ওরা ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব ভোরে চুপিচুপি সবাইকে ডেকে তুলল দোয়েল। সূর্য ওঠেনি। ফর্সা হয়েছে সবে। কাকেদেরও ঘুম ভাঙেনি। ঠিক সেইসময় দোয়েল-দোয়েলনি বাচ্চাদের নিয়ে বাসা ছেড়ে উড়ে চলল। উড়তে-উড়তে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গেল। অবশেষে সেই মামার বাড়ির বাগান।
এদিকে ভোরবেলা গাছের ডালে দোয়েল পাখির মিঠে গান আর শোনা গেল না। হঠাৎ এ অনিয়মে ঈগল গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। অনেক হাঁক-ডাক করেও যখন কোনো সাড়া মিলল না, তখন সে নিজেই দোয়েলের বাসার সামনে এল। কিন্তু কোথায় দোয়েল! মুহূর্তে থমকে গেল ঈগল। ফাঁকা বাসার মতোই হৃদয়টা তার ফাঁকা হয়ে গেল। দারুণ কষ্ট হল দোয়েলের বাচ্চাদের জন্য। দু-চোখে তার জল ভরে এল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত - চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮
0 মন্তব্যসমূহ