Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।। বিধান সাহা

কত হাসি-কান্না দুরন্তপনা খুনসুটি হুটোপুটি দুষ্টুমিতে ভরা আমাদের ছেলেবেলা। জীবনের এই সময়টি পেরিয়ে এসে যাঁরা অনেক বড়ো হয়ে যান, তাঁদের ছেলেবেলার কথা কার না জানতে ইচ্ছে করে। সেইসব বড়ো মানুষদের সেরা সময়ের গল্প কথাই দলিল হয়ে রইল এই বিভাগে-

বাংলা উপন্যাসের জগতে 'পথের পাঁচালী' একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। উপন্যাসটি 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে গ্রন্থাকারে বের হয় ১৯২৯ সালের ২রা অক্টোবর। এই উপন্যাসের অমর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৃণালিনী দেবীর পুত্ররূপে কাঁচরাপাড়ার কাছে ঘোষপাড়া মুরাতিপুর গ্রামে ১৮৯৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বিভূতিভূষণ জন্মগ্রহণ করেন। মুরাতিপুর গ্রামে ছিল বিভূতিভূষণের মামার বাড়ি। এখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বনগ্রাম মহাকুমার অধীন ব্যারাকপুর গ্রামে।

মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় কথকতা করতেন। কাজের জন্য বেশি দিন বাড়িতে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাড়িতে চারটি ছেলে-মেয়ে। নুন-ভাত জোটানোর লোক ছিলেন তিনি। তাই অভাব-অনটন ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। বাড়িতে থাকলেই তিনি বিভূতিভূষণকে পড়াতে বসাতেন। 'পথের পাঁচালী'র হরিহর চরিত্রটি বিভূতিভূষণ এঁকেছেন তাঁর বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে।

সংসারের এই অভাব-অনটনের মাঝে বিভূতিভূষণ মায়ের কাছে বায়না ধরেছিল স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য। টাকা ছিল না, বাবা ছিলেন দূরে। টাকা পাঠানোর কোনো ব্যবস্থাই করতে পারছিলেন না। বিভূতিভূষণ মায়ের কোনো অজুহাত শুনলেন না। দুদিন না খেয়ে বসে রইলেন। শেষপর্যন্ত মা কোমরের এক ছড়া রুপোর গোট সাড়ে-সাতটায় বন্দক দিয়ে টাকা জোগাড় করে বনগ্রামের স্কুলে পাঠিয়ে ছিলেন।

স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় বিভূতিভূষণকে রোজই প্রায় ১০ মাইল হাঁটতে হত। কোনোদিন ভাতে-ভাত খেয়ে যেতেন। কোনোদিন ভাত না খেয়েও রওনা দিতে হত। মা একটি করে পয়সা দিতেন রোজ। সেই পয়সা দিয়ে বিভূতিভূষণ মুড়ি-মুড়কি কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতেন।

স্কুলের মাইনে ঠিকমতো দেওয়া সম্ভব ছিল না। আসা-যাওয়ার কষ্ট দেখে সেই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই স্থানীয় এক সরকারি ডাক্তারের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ওখানে বিভূতিভূষণ থাকতেন, খেতেন। তার বদলে ডাক্তারবাবুর ছেলেটিকে পড়াতে হত। এই স্কুল থেকেই বিভূতিভূষণ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন।

বিভূতিভূষণের ছেলেবেলা কেটেছে পাড়াগাঁয়ে। এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদীটিকে খুবই ভালোবাসতেন। এই নদীটি ছিল তাঁর ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী। নদীর সঙ্গে অনর্গল কথা বলতেন তিনি। বালক বয়সে একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেন। নির্জন নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আপন মনে গল্প বলে যেতেন। এটা তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য। সে গল্প বলা একদিনে শেষ হত না। দিনের পর দিন নদীকে গল্প শোনাতেন তিনি। কঞ্চি হাতে বালক স্কুলমাস্টারের প্রতীক চিত্র এবং কথা বলা অর্থাৎ গল্পলেখক দুই-ই হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। পরিণত বয়সে এই নদীকে নিয়েই 'ইছামতি' উপন্যাস লেখেন বিভূতিভূষণ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই গ্রন্থটিকে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত করে। এই গ্রন্থটি দিয়েই ১৯৫০ সালে রবীন্দ্র পুরস্কারের প্রচলন ঘটে।

গ্রামের বাড়ির উঠোনে বিভূতিভূষণের একটি মাটির ঘর ছিল। আদর করে সেই কুটিরের নাম রেখেছিলেন 'শ্যামলী'। সেই ঘরে দরজা ছিল না। বাবার একটি তক্তপোষ ছিল সেই ঘরটিতে। রাতে গরু-ছাগল সেই ঘরে এসে রাত্রি যাপন করত। বিভূতিভূষণও গরু-ছাগলের সঙ্গে অনেক রাত এই ঘরে কাটিয়েছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল বিভূতিভূষণকে। ছোটবেলাতেই পিতার মৃত্যু সেই অভাব অনটনকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। ছাত্র পড়িয়ে নিজের বাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল বিভূতিভূষণকে। অভাব-অনটন প্রকৃতির সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই যোগসুত্র স্থাপিত হয়েছিল তাঁর। গ্রামের নানা ফুল গাছ, নদীর সঙ্গে বাল্যকাল থেকেই আকর্ষণ বোধ করতেন তিনি। তারই ছায়া দেখি 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে অপু চরিত্র এর মধ্যে। বাঙালির অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র এই অপু। যাকে সৃষ্টি করেছেন বিভূতিভূষণ।

১০০-র মতো গ্রন্থের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটে ১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর ঘাটশিলার বাড়িতে।

 

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ ১৪১৬ (জানুয়ারি ২০১০)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ