Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সে আবার কে ।। বরুণ মণ্ডল



প্রতিবারেই স্বাধীনতা দিবসের দিন বকুলতলা বয়েজ ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতা করে। সেসব নিয়েই আলোচনা করছি আমরা কজনে। সকাল সাতটা থেকে খেলা শুরু হয়, শেষ হতে-হতে বিকেল গড়িয়ে যায়। তারপর পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান তো আছেই। সারাদিন হৈ-হৈ করে কেটে যায়। শুধু গোল গোল করে। মাঝে একবার বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে ভাত খেয়ে আসা, ব্যাস।

সেদিন পড়ার কথাও কেউ বলে না। বলবেই বা কে ? বাবা নিজেই তো মাঠে থাকে, খেলা দেখে। আর দাদা ? সে তো ওদের ক্লাবের হয়েই খেলে। ওদের ছাতিমতলা কিশোর সংঘ প্রতিবারই প্রতিযোগিতায় নাম দেয়। যদিও কোনোবারেই জিততে পারেনি।

আমি ছানুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ছানু, আমরাও তো এই প্রতিযোগিতায় নাম দিতে পারি ?

হ্যাঁ, তা দিতে পারি। কিন্তু আমাদের টিম হবে কাকে নিয়ে ?

কেন! তুই, আমি, পকাই, ভাদু-

আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভাদু বলল, আর পটাইকে যদি পটিয়ে আনতে পারি তো সোনায় সোহাগা।

পটাই ? সে আবার কে ? ছানু জিজ্ঞেস করল।

পটাই আমার খুড়তুতো পিসির ছোটো ছেলে। দারুণ ফুটবল খেলে। একবার ওদের ক্লাবের হয়ে একাই আঠারো গোল দিয়েছিল।

আমি আঁতকে উঠে বললাম, আঠারো গোল!

ছোটন বলল, বিশ্বরেকর্ড করেছে তাহলে বল!

ঠিক তাই, ভাদু বলল।

তারপর সবাই মিলে বসে এগারো জনের একটা টিম তৈরি করলাম। তাতে অবশ্যই রইল পটাই।

পরদিন আমরা খেলোয়াড়ের নামের তালিকা ও প্রবেশ মূল্য জমা দিলাম। ঠিক করলাম সামনের রবিবার আমরা পটাইয়ের খোঁজে যাব। পটাইয়ের বাড়ি ডায়মন্ড হারবারের সরিষার হাটে।

আমি, ভাদু আর ছোটন প্রথমে ট্রেনে, তারপর বাসে সরিষার হাটে গিয়ে পৌঁছলাম। সরিষার হাটে এর আগে আমরা কোনোদিন আসিনি। নতুন জায়গা। জায়গাটা আমার বেশ ভালো লাগল। পথ-ঘাট ভাদুর চেনা। হাট থেকে ডান দিকের একটা ইঁট পাতা রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। দুপাশে মাঠ, কোথাওবা সব্জির ক্ষেত। ধূ-ধূ মাঠের মাঝে বটগাছের ছায়ায় একটুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বেশ ভালো লাগল। কেমন রোমাঞ্চ জাগে, অনেকটা গল্পের বইয়ের মতো।

ভাদু বলল, আর একটু গেলেই পুকুর, পুকুরের পাড় ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পটাইয়ের বাড়ি।

ভাদু প্রথমে ঢুকল। পিছন-পিছন আমি আর ছোটন। ভাদু পটাইয়ের নাম ধরে ডাকল, পটাই, পটাই-

তারপর কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার ডাকল, পিসি পটাই আছে ? ও পিসি-

ঘরের ভেতর থেকে একটা মুখ উঁকি দিল। তারপর কান্নার শব্দ। ভাদু বলল, ওই তো পিসি। ও পায়ে-পায়ে পিসির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে আমরা দুজন।

ভাদুকে জড়িয়ে ধরে পিসির সে কি কান্না ! ভাদুরে তুই অ্যাদ্দিন পরে এলি, কোথায় ছিলি বাপ ?

আমরা তো পিসির কাণ্ড দেখে অবাক। ভাদু তো আরো অবাক! শুধু বলছে, পিসি কাঁদছো কেন ? কেঁদো না। ও পটাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগই পাচ্ছে না।

প্রায় ঘন্টাখানেক পিসির কান্নাকাটির পর ভাদু কোনোরকমে পিসির কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচল।

বাইরে এসে ভাদু বলল, কোনো কাজই হল না। শুধু-শুধু মনটা খারাপ হয়ে গেল।

-তুই এলেই কি পিসি এরকম কান্নাকাটি করেন ? আমি জানতে চাইলাম।

-না না। তা কাঁদবেই বা কেন ? আজ কেন যে কাঁদল বুঝতেই পারছি না।

আমরা হাঁটতে-হাঁটতে ততক্ষণে সেই বটগাছের কাছে এসে গেছি, যেখানে যাওয়ার সময় বিশ্রাম নিয়েছিলাম। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে বেরোবার পর কারোরই কিছু খাওয়া হয়নি। এমন সময় পটাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমরা প্রথমে দেখতে পাইনি। পটাই-ই বলল, আরে ভাদু তুই! আমাদের বাড়ি গিয়েছিলি নাকি ?

-হ্যাঁ, ভাদু বলল।

সব কথা শুনে পটাই বলল, ঠিক আছে। কোনো চিন্তা নেই। খেলার দিন সকালেই আমি চলে যাব। আর আমি যখন খেলছি, তোরা জিতবিই।

আমরা মহানন্দে বাড়ি ফিরে এলাম।

খেলার আগের দিন পর্যন্ত জোর অনুশীলন চলল। আমাদের প্রথম খেলা সকাল সাড়ে আটটার সময়। খেলার প্যান্ট-গেঞ্জি পরে বল নিয়ে মাঠে নামার জন্যে প্রস্তুত। কিন্তু পটাই ? পটাই তো এখনো এল না! ওকে নিয়েই তো আমাদের যত মনোবল।

শেষ পর্যন্ত পটাইকে ছাড়াই আমরা প্রথম ম্যাচ কোনোক্রমে এক গোলে জিতে গেলাম। এবার বড়োদের মুখোমুখি হতে হবে। নিশ্চয়ই গো-হারান হারব আমরা। কডজন গোল যে হজম করতে হবে কে জানে। দুরু-দুরু বুকে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামলাম। কিন্তু আশ্চর্য, যে খেলায় আমাদের কয়েক ডজন গোলে হারার কথা, সে ম্যাচে আমরা এক গোলে জিতে গেলাম। কেষ্টদার হেড করা বলটা আমাকে পরাস্ত করেও গোলে কেন ঢুকল না বুঝতে পারলাম না।

ম্যাচ জিতে বাইরে এসে দেখি পটাই দাঁড়িয়ে আছে। বলল, দেরি হয়ে গেল রে, কিছু মনে করিস না। আমি পরের ম্যাচে খেলব।

আমরা দুটো ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠে গেছি। খেলতে হবে গতবারের চ্যাম্পিয়ন একবালপুর একতার বিরুদ্ধে। ওরাও দুটো ম্যাচ জিতে ফাইনালে উঠেছে। ওদের গোলকিপার নাকি কলকাতা ক্লাবের খেলোয়াড়। কিন্তু তা হোক। পটাই যখন এসে গেছে ও নিশ্চয়ই একটা কিছু করবে।

আর করলও। পরপর দুটো গোল দিয়ে পটাই আমাদের চ্যাম্পিয়ন করে দিল।

মাঠের বাইরে এসে পটাইকে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুজি করলাম। না, পটাই কোথায় কে জানে। পটাইকে ছাড়াই আমরা ট্রফি নিয়ে এলাম মঞ্চ থেকে। ভাদু বলল, ওটা ওইরকমই, কেমন এসে আমাদের জিতিয়ে দিয়ে আবার চলে গেল।

আমি বললাম, প্রতিভাবানরা ওইরকমই হয়।

বন্ধুরা দল বেঁধে বাড়ি ফিরছি। সবার মধ্যেই আনন্দের জোয়ার। আমরা চ্যাম্পিয়ন। অবিশ্বাস্য আশাটা এখন সত্যি।

ভাদু, খেলে ফিরছ বুঝি ? ভাদুর পরিচিত এক ভদ্রলোক ভাদুকে জিজ্ঞেস করলেন।

-হ্যাঁ, আপনি!

-আমি তোমাদের বাড়িতেই গিয়েছিলাম। খবরটা বোধহয় শোনোনি। পটাই গত শনিবার বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।

-মারা গেছে ! ভাদু চোখ বড়ো-বড়ো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে-

-আপনি পটাইয়ের কে হন ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

-আমি পটাইয়ের দাদা। তোমরা যেদিন গিয়েছিলে সেদিন তখন আমরা শ্মশাণে গিয়েছিলাম। মায়ের কাছে শুনলাম তোমরা এসেছিলে। কী আর করা যাবে বলো! পৃথিবীতে যার যত দিন আয়ু।

আমি তখন ভাবছি পিসির বাড়ি থেকে ফেরার সময় বটগাছের নিচে তাহলে পটাইয়ের সঙ্গে দেখা হল কী করে! জয়ের গোল দুটোই বা দিল কে ?

পটাইয়ের দাদা চলে যেতে ভাদু আমার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, তাহলে!

তারপর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুলাই ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ