Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

দুমুখো সম-শব্দ, শব্দগুচ্ছ, বাক্য ।। অসিত দত্ত

শুধু দুমুখো বা উভমুখী হলেই হবে না, দুদিক থেকে পড়লে একইরকমের অর্থবোধক হতে হবে। সোমনাথ সোম বা চন্দ্রমাধব চন্দ্র নাম দুটো শোনার সময় প্রথম আমার একটু মজা লেগেছিল। এ মুড়ো থেকে পড়লেও যা, ওমুড়ো থেকে পড়লেও তাই। দুমুখো সাপের মতন! জানি না দুমুখো সাপ সত্যি-সত্যিই আছে কিনা, তবে দুমুখো শব্দ, শব্দসমষ্টি বা বাক্য যে অনেক আছে, পরে তা জেনেছি। আগে যে দুটো নাম বলেছি তা শব্দে-শব্দে দুমুখো, প্রচুর শব্দগুচ্ছ আছে যা বর্ণে-বর্ণে অক্ষরে-অক্ষরে দুমুখো। এগুলো একরকমের শব্দ নিয়ে খেলা করার মতো মজার। কেউ-কেউ এইরকম শব্দ নিয়ে খেলা খেলতে ভালোবাসে। এই করতে-করতে একসময় দেখা গেল পৃথিবীতে অনেক ভাষাতেই এই দুমুখো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ পাওয়া যায়। যার অনেকগুলো আবার বাক্য। পরে এই ধরণের শব্দগুচ্ছকে নাম দেওয়া হল প্যালিনড্রোম বা দুমুখো শব্দগুচ্ছ। এর আভিধানিক অর্থ, যে শব্দ উচ্চারণ বদলায় না। শব্দটি গ্রিক শব্দ প্যালিন ড্রোমাস থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মতে, নামটা এমন হওয়া উচিত ছিল, যেটা নিজেই একটা উভমুখী শব্দ। এই যেমন পেলিন লিপ্যা  গোছের একটা হলে বেশ আরো মজার হত।

বাংলা ভাষায়, অন্তত দুজনকে জানি, যারা দুমুখো শব্দগুচ্ছ নিয়ে খেলা করতে ভালোবেসেছেন। একজনের কথা প্রথমেই বেশি মনে পড়ে, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ওরফে দাদা ঠাকুর আর একজন পরিমল গোস্বামী। ''বিদূষক'' পত্রিকায় দাদাঠাকুর দুমুখো শব্দ নিয়ে চর্চা করে দেখিয়েছেন শব্দের মজা বা মজার শব্দ কাকে বলে। যেমন, চেনা সে ছেলে বলেছে সে নাচে, তাল বলে নেব লতা, কাক কাঁদে কাঁক কা- ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় যুক্তাক্ষর এবং অ-কার, আ-কার, ই-কার, ঈ-কার এর প্রাবল্য থাকায় লম্বা-লম্বা দু-মুখো শব্দগুচ্ছ রচনা করা সহজসাধ্য নয়। সম্ভবত দাদাঠাকুরই প্রথম যুক্তাক্ষর সম্বলিত জটিল দুরূহ একটি প্যালিনড্রোম তৈরি করে আমাদের উপহার দেন। কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী। যদিও কীর্তন মঞ্চের ওপরে নর্তকীর কোনো সংখ্যারই ভূমিকা নেই। তবে  দুমুখো শব্দের খাতিরে এইটুকু অসঙ্গতি তো আমাদের করতেই হবে। সে কথা পরে হবে। ইদানিং নতুন-নতুন দুমুখো শব্দসমষ্টি আর বেশি পাওয়া যাচ্ছে না বা সময়ের অভাবে তার চর্চা হচ্ছে না।

একই অর্থ বজায় রেখে সাধারণ দুমুখো শব্দ তো প্রচুর। বাবা, কাকা, চাচা, মামা, পাপা, নানা, মাসিমা, মামীমাদের সঙ্গে দাদা-দিদিরাও সামিল। হিন্দিতে সামোসা মানে সিঙ্গারা এমনি আরো অনেক আছে অভিধানে ধ্যান দিলেই পাওয়া যাবে। Madam নবীন, খগেন, কনক, নন্দন, মহিম। ছোটো-বড়ো নাম যেমন- হারান রাহা, রমাকান্ত কামার, দেবী দে, সুবল লাল বসু, সদানন দাস, রায়মনি ময়রা, নিধুরাম রাঁধুনী। এখানে একটা কষ্ট কল্পনা আছে। চন্দ্রবিন্দু নিয়ে নিঁধুরাম যদি একটু ভৌতিক হয়, তবে কোনো কথা নেই। যাঁরা খুঁতখুঁতে তাঁরা আপত্তি করতে পারেন।

এই কষ্টকল্পনা প্রসঙ্গে বলি, মজার খেলা এই দুমুখো শব্দ বানানোর কালে বানান শুধু নয়, দ্বিভাষিকতাও এসে যেতে পারে। আমি নিজে যেমন কয়েকটা বানালাম। মহামহিম হাম। হাম অর্থাৎ আমি এটা দ্বিমুখো এবং দ্বিভাষিক। বাংলা হিন্দি মিশিয়ে হিংলা হয়ে গেছে আবার একটা লোকের নাম লোকদাস না হয়ে যদি লোকাদাস হয়। কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। সে যদি সদাসর্বদা কালোও হয় তাতেও কারোর আপত্তি থাকার কথা নয়। হয়ে গেল, লোকা দাস সদা কালো। তেমনি মিসি পিসি গেল লগে মিসিসিপি। এই ১২ বর্ণের দুমুখো বাক্যে ''লগে'' মানে সঙ্গে শব্দটা জোর করে ঢোকানো হয়েছে। তবে সেটা কিন্তু মজার খাতিরেই। আমি তো কোন ছাড়, এইটুকু দাদাঠাকুরের মতো অনেকেই নিয়েছে। অসমাপ্ত বাক্য বা শব্দসমষ্টি নিয়েও যে দু'মুখো শব্দ হয়, তা কল্পনার খাতিরে মেনে নেওয়া যায়। যেমন-

বিকল্প কবি/ ঘুরবে রঘু/ বই চাইবে/ নাম লেখালাম না/ মার কথা থাক রমা/ তুমি কি মিতু- ইত্যাদি।

বই চাওয়া নিয়ে আমি একটা এক্ষুনি বানালাম। কেউ যদি কি না বলে ''কিই'' বলে অ্যাকসেন্ট (স্বরাঘাত ভঙ্গি)দেয়, তবে মেনে নেওয়া যায় না এইটা ? কিই বই চাই বই কি ? ভেবে দেখো। আরো কিছু উদাহরণ- বনমানব, নবজীবন, সহীস, সবস, সরেস, মরম, মলম, দরদ, কালিকা, জলজ, তফাত, বাহবা, সন্ন্যাস, সন্ত্রাস, নরুন, নরেন, নবীন, এমনি আরো অনেক। এই অধমের বানানো আরেকটি সবিনয় উদাহরণ- বনহরিণী নিরীহ নব।

কিছু খুঁতখুঁতে লোকের কথা বলছিলাম। ইংরেজদের মধ্যে এমন অনেক পুতু-পুতু করা লোক আছে। যারা একটু খুঁত থাকলেই তাকে প্যালিনড্রোমের জাতে তুলবে না। একটা শব্দ আছে, RELEVELLER আমাদের অভিযানে পাইনি কিন্তু একে RELEVELER করতে চেয়েছিল দুমুখো শব্দবাজেরা। কিন্তু রক্ষণশীলদের বাধাদানের ওই একটা L- এর কারণে এটাকে প্যালিনড্রোম লেভেল দেওয়া গেল না। হলে তিনিই রি-লেভেলার অর্থাৎ তিনিই শব্দটার পুনরায় লেভেল দিতেন এবং হলে ওটাই হত ইংরেজি ভাষার দীর্ঘতম (দশ) বর্ণের দুমুখো শব্দ। দুই নম্বর জায়গায় থাকত REDIVIDER, যে এখন এক নম্বর জায়গায় লাঠি ঘোরাচ্ছে। এছাড়া আছে, ROTATOR, REPAPER, NO IT IS OPEN ON ONE POSITION : NO LEMON NO MELON, MADAMI’M ADAM, AMAN-APLAN-ACANAL-PANAMA (এটা একটু  কষ্টকল্পিত)।

নেপোলিয়নের বহুকথিত একটি বিখ্যাত দু-মুখো শব্দমালা আছে  ABLE WAS I ERE I SAW ELBA- এমন ভাষায় কেউ কথা বলে না। দুমুখো শব্দগুচ্ছ এমন বাক্য। প্যালিড্রোমের ভ্যালার প্যালায় এমন গুচ্ছ শব্দ পুচ্ছ তুলে নেচে নেচে আমাদের মনে মজা দেয়। এবারে আবার একটা এই লেখকের দুমুখো শব্দমালা। নেচে নেচে খাদের ঘর দেখা চেনে চেনে। যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে, খাদের মধ্যে ঘর ? তাও আবার নেচে নেচে দেখা ? কেমন অচেনা অচেনা না ? তবু বলব, 'নেচে নে'

মানে কৌতুহল জাগতে পারে সবচেয়ে বেশি বর্ণ নিয়ে দুমুখো শব্দ কোনটি ? এখনো অবধি যেটা জানা গেছে, সেটা ফিনল্যান্ড দেশের ফিনিশ ভাষার লোকেরা ১৯টি শব্দ দিয়ে ফিনিশ করেছে এই দু-মুখো শব্দটি। এর মানে হচ্ছে সাবান বিক্রেতা। এক নিঃশ্বাসে লেখাও মুশকিল। SAIPPUAKIVAKUPPIAS।  আর একটা মালায়ালাম- মালায়ালামা অর্থাৎ শেষে যদি একটা আ-কার বসাতে পারতাম, তবে বাংলা অক্ষরে দু-মুখো হয়ে যেত। ইংরেজিতে MALAYALAM কিন্তু সার্থক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো দৈর্ঘ্যের নয় (৯) অক্ষরের প্রপার নাউন-এর প্যালিনড্রোম। বড়ত্বের কথাতেই শেষ করি, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো প্যালিনড্রোম- রসিক ওডওয়ার্ড রেনবো এবং তাঁর ১৯৮১ সালে প্রকাশিত চল্লিশ হাজার শব্দ সম্মিলিত একটি আকাশছোঁয়া হিমালয় সদৃশ্য রচনা, যার শুরু এইভাবে- ANON NOW, EVEN ODDER I HAVE MAKE LINES… এবং শেষ হয়েছে SENILE DAMEVA HIRED DON EVEWON NONA- যার শুরু এবং শেষ এই দুই মুখে একই ধারার শব্দ সাজানো। ভাবতে পারা  যায় ? কি করে সম্ভব ? না জানি কত-কত বছর ধরে ভেবে-ভেবে ধৈর্য ধরে লেগে থেকে-থেকে হাল ছেড়ে না দিয়ে চল্লিশ হাজার বর্ণমালা সাজিয়ে-সাজিয়ে একটা সম্পূর্ণ অর্থবহ প্যালিনড্রোমিক রচনা নির্মাণ করেছেন। আমাদের মহান কালিকলম অর্থাৎ 'মসিমহিম হিমসিম' খেয়ে যায় একটা দুটো দুমুখো বাক্য তৈরি করতে। পরিশেষে বলি, আমার এই মসিমহিম-এর হিমসিম খাওয়ার দুমুখো শব্দগুচ্ছ কেমন লাগল ?

 

 প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ