ভালো মানুষ রাজামশাই। দিব্যি রাজত্ব করছিলেন। হঠাৎ কি যে হল, বলে বসলেন, মন্ত্রী সবাই তোমরা ছুটি পাও। আমি কেন পাব না ? মন্ত্রী বললেন, তা ঠিক। তা ঠিক। রাজামশাই-এর সঙ্গে-সঙ্গে ঘোষণা- আমার ছুটি চাই। কিন্তু ছুটি চাই বললেই তো হয় না। প্রধান সমস্যা রাজামশাই কার কাছে দরখাস্ত করবেন। তিনিই তো সবার দরখাস্তে সই করে ছুটি মঞ্জুর করেন। তাঁর দরখাস্তে কে সই করবে! মহা ভাবনা। ভার পড়ল রাজসভার মহাপণ্ডিতের ওপর। তিনি টাক চুলকে, বিস্তর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে, তিন টিপ নস্যি পরপর টেনে বললেন, উপায় আছে। রাজামশাই খেঁকিয়ে ওঠেন, বাতলান, জলদি বাতলান। মহাপন্ডিত বললেন, মহারাজ আপনি হলেন শ্রী শ্রীল শ্রীযুক্ত গঙ্গারাম, মানে ওইটি আপনার নাম। আপনি দরখাস্ত লিখুন ওই নাম দিয়ে। তারপর মহারাজ হিসেবে দরখাস্ত মঞ্জুর করুন। তবে মহারাজ কখনো কিন্তু শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীশ্রী গঙ্গারাম লিখবেন না। মানে ওই মঞ্জুরের সিগনেচারটা আর কি! স্রেফ মহারাজ।
রাজামশাইয়ের আনন্দ দেখে কে। ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। রানীকে বলতেই রানী বললেন, ব্যাস, এবার খাও-দাও, ঘুমোও। রাজামশাই বললেন, সে কি! ছুটিতে বেড়াতে যাব দুটিতে। রানী চোখ কপালে তুলে বললেন, আমি বেড়াতে যাব! বল কি! আরে তাহলে তো আমাকে পাঁচ সখী কাজের পঁয়ত্রিশ, তার সঙ্গে আছে অন্তত আরো পনের। সবাইকে নিয়ে যেতে হয়। না বাপু, আমার যাওয়া হবে না। এখন যাও তো, আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমাকে ফেসিয়াল করতে হবে। রাজামশাই বললেন, ফেসিয়াল কোনো নতুন খাবার বুঝি! রানী বিরক্ত হয়ে বললেন, ফেস শুনেই তুমি খাবার কথা ভেবেছ। ফেসিয়াল হচ্ছে মুখের পরিচর্যা। রাজার কপালে হাত। আরে মুখের পরিচর্যা মানেই তো খাওয়া। তবে সে কথা বললেন না।
তা, কি আর করা যায়। বেরিয়ে পড়লেন রাজামশাই। উঁহু, রাজামশাই নয়, বেরিয়ে পড়ল গঙ্গারাম। এখন আর রাজা কোথায়! একটা খাটো ধুতি, তারওপর শার্ট, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। এসব অবশ্য মন্ত্রীমশাই জোগাড় করে দিয়েছেন।
রাস্তায় বেরিয়ে গঙ্গারামের কি স্ফূর্তি। একেই বলে ছুটি। আহা! দিনের রং কি ঝলমলে! ঝকঝকে আকাশ, সবুজ পাতার ঝালর নিয়ে কতোরকমের গাছ, রাস্তায় কতো লোক যাচ্ছে, কতো দোকানপাট। কি আনন্দ! গঙ্গারাম হেঁটে চলল। রাজধানী শহর ছাড়িয়ে একটা ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল সরু লতার ক্ষেত ভর্তি। তার মধ্যে বিরাট-বিরাট ফল। কী আশ্চর্য! না দেখলে, বিশ্বাস হত না। গঙ্গারাম একটা লোককে দেখতে পেল ক্ষেতের সামনে। মোটা-সোটা কালো শরীর, খাটো ধুতির উপর গামছা বাঁধা, গায়ে কিছু নেই, এক মাথা চুল, খোঁচা দাড়ি-গোঁফ।
-ও ভাই, এগুলো কি ফল ? গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করে।
-ফল! এ যে দেখি হাঁদা গঙ্গারাম।
-তুমি আমার নাম জানো দেখছি!
লোকটা বলল, তোমার নাম বুঝি হাদা গঙ্গারাম ?
-না, হাঁদাটা নয়, শুধু গঙ্গারাম।
-ঠিক আছে, হাঁদাটা না হয় যোগ করে নিও। আর শোনো, এগুলো কুমড়ো। একে ফসল বলতে পারো। ফলের মাঝে একটা দন্তস্য দিতে হবে।
-বুঝেছি। কুমড়োর ছক্কা আমি খেয়েছি।
-বাব্বা, ঘ্যাঁট নয়। একেবারে ছক্কা!
গঙ্গারাম বলল, শোনো, আমার কিন্তু খাওয়ার কথা মনে পড়ায় খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দিতে পারো ?
-কেন পারব না! তবে ওই দেখো, কুমড়ো ডাঁই করা আছে। আমার ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর কাল হাটে নিয়ে যাব।
-ঠিক আছে, আমি পৌছে দেব।
লোকটা একলা চাষ করে। দেখল, এরকম হাঁদা গঙ্গারাম যখন পাওয়া গিয়েছে, তখন একে দিয়ে দিব্যি কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। তবে একদিনেই বুঝল, এ খুব পরিশ্রমী নয়। তা হোক, মনে হচ্ছে এসব কাজ অভ্যেস নেই। হয়ে যাবে ধীরে ধীরে।
লোকটার বউও বলল, ভারি ভালো লোক। একটু বোকা-সোকা। বলে কিনা পোলাও কালিয়া থেত নাকি! কে যে দিত। যাক গে, রেখে দাও ওকে। মুখে বললেও যা দিই, দিব্যি খেয়ে নেয়।
গঙ্গারাম লোকটাকে বলল একদিন, আচ্ছা, তুমি ছুটি পাওনা ?
-ছুটি! সে আবার কি ?
-আরে আরাম। কাজকর্ম করবে না। বসে থাকবে।
লোকটা চোখ কপালে তুলে বলল, বসে থাকব! তাহলে তো চাষের ক্ষতি! খাব কি! না, না, ওসব ছুটি-ফুটি জানি না। তবে হ্যাঁ, শরীর খারাপ হলে, জ্বর-জ্বালা হলে বসে থাকতে হয়। সে ভারী কষ্ট।
গঙ্গারাম কথা বাড়াল না।
বিকেলবেলায় নদীর ধারে গিয়ে গঙ্গারামের এক জেলের সঙ্গে আলাপ। গঙ্গারাম মাছ চেয়েছিল। তারপর ওর বাড়িতে জাল বয়ে দিয়ে এসে একটা মাছ ও পেয়েছে। সেই থেকে ভাব। তাকেও একদিন জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি ছুটি পাওনা ?
ছুটির নাম শুনে জেলের মুখ হাঁ। তার ছুটি। বলল, আরে ভাই, যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন কাজ। মরলে ছুটি। তবে মরতে কে চায়! আমার ছুটির দরকার নেই। দিব্যি আছি।
গঙ্গারাম বলল, তাই তো দেখছি।
জেলে বলল, ওই যে কাঠের কাজ করছে, ওরও ছুটি নেই।
-আর ওই মিষ্টির দোকানদার ?
-উঁহু। ওরও ছুটি নেই। তা অমন ছুটি নিয়ে পড়লে কেন ?
গঙ্গারাম বলল, তাই ভাবছি।
-তা তুমি ভাবতে পারো। তোমার তো এখানে-ওখানে করে খাওয়া। ওই চাষি লোকটাও ভালো। তুমি ছুটির কথা ভাবতেই পারো।
এই ছুটির ভাবনা থেকেই গঙ্গারামের মনে হল, আরে! সে তো ছুটিতে দিব্যি আছে! কিন্তু রাজ্য কেমন চলছে ?
চাষি লোকটাকেও জিজ্ঞাস করতে সে বলল, কি জানি ভাই। কে খবর রাখে!
জেলেকে জিজ্ঞাসা করতে তারও একই উত্তর।
মিষ্টির দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করতে তারও একই উত্তর।
এরপর কাঠের মিস্ত্রি, মাটিকাটা মজুর, নৌকা চালানো মাঝি, তাদেরও একই উত্তর।
গঙ্গারামের মাথায় এখন রাজামশাই জেগে উঠেছে। ভাবলেন, থাক, ঢের হয়েছে। আর ছুটি নয়। এবার ফেরা দরকার। গিয়েই প্রথম কাজ ছুটি বন্ধ।
ফিরতেই রাজপ্রাসাদের কেউ চিনতে পারে না। কিন্তু মন্ত্রী চিনলেন। বললেন, তাহলে ফিরে এলেন!
-হ্যাঁ। রাজত্ব তো ভালোই চলছে।
-চলছে ভালোই। আমরা মন্ত্রীরা সব কাজকর্ম ভাগ করে নিয়েছি।
রাজামশাই বললেন, আরে ভাগের দরকার নেই। আমি এসে পড়েছি।
মন্ত্রী বললেন, তা পড়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীসভায় এনিয়ে আলোচনা দরকার।
মন্ত্রীসভায় বৈঠক বসল। বিস্তর তর্ক-বিতর্ক। আইনমন্ত্রী রাজার দরখাস্তটা নিয়ে পড়ে বললেন, আপনি ছুটি নিয়েছেন। নির্দিষ্ট করা সেই কতদিন। ছুটি মানে অনন্তকাল। আপনার ছুটি তো ফুরবে না। স্বয়ং মহারাজ এ-দরখাস্ত মঞ্জুর করেছে গঙ্গারামবাবু।
রাজামশাই তখন মহাপণ্ডিতকে চেপে ধরলেন, একি মহাপণ্ডিত! আপনি একি দিয়েছিলেন ? দরখাস্ত আপনিই লিখেছেন, এখন আপনি উপায় বাতলান।
মহাপণ্ডিত টাক চুলকে তিন টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, ঘাবড়াবেন না। উপায় আছে, উপায় আছে।
-জলদি বলুন। জলদি বলুন।
মহাপণ্ডিত বললে, মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব নেওয়া হোক, যেমন এখন চলছে তেমন চলবে। রাজামশাই সিংহাসনে বসে থাকবেন। তিনি ছুটিতে থাকবেন। কোনো মন্ত্রীরই ক্ষমতা খর্ব হবে না। এদিকে মহারাজের থাকার সুরাহা হয়ে গেল।
মন্ত্রীসভা সমস্বরে বলল, সাধু। সাধু। প্রস্তাব পাশ হল।
তারপর রাজামশাই সিংহাসনে বসে থাকেন, আর ভাবেন, ছুটি বন্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছিলেন। এদিকে তিনিই ছুটির ফাঁদে পড়ে গেলেন। কি দুঃখ!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ডিসেম্বর ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ