Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মেধা নয় উপস্থিত বুদ্ধি ।। অনন্যা দাশ



অভাবনীয় ক্ষমতার এক বালক

নিজস্ব সংবাদদাতা, সূর্য নারায়ণপুর, মে ১৯, ২০০৯ : সূর্য নারায়ণপুরের বারো বছরের উল্লাস কর্মকার ছেলেবেলা থেকেই এক অভিনব ক্ষমতার উত্তরাধিকারী। উল্লাস যা দেখে তাই ওর মগজে ছবির মতন ছাপা হয়ে যায়। এই গুণটাকে ফটোগ্রাফিক মেমরি বলে। উল্লাসের বাবা উমাশঙ্কর কর্মকার সূর্য নারায়ণপুরের বড়ো বটতলার পাশে একটা মুদির দোকান চালান। আমরা ওনাকে প্রশ্ন করতে উনি হেসে বললেন, “খুব ছোটোবেলা থেকেই ও যা দেখে ওর মনে থাকে। কি আর করব বলুন, গরিবের ঘরে ভগবান এইরকম রত্ন পাঠিয়ে দিয়েছেন!

মানুষের মস্তিস্কের চিকিৎসক শ্রী মানবেন্দ্র কাঞ্জিলালের সঙ্গেও কথা বললাম আমরা। ডাক্তার কাঞ্জিলাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। উল্লাসের মতন গিফটেডছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কাজ করেছেন উনি। উল্লাসকে পরীক্ষা করে উনি বলেছেন যে, ওর ক্ষমতা সত্যি অভাবনীয়। ওনাকে আমরা জিজ্ঞেস করি- উল্লাস তো সবকিছু মনে রাখতে পারে তাহলে ও কি উঁচু ক্লাস এই ধরুণ ইলেভেন টুয়েলভের পরীক্ষা দিতে পারবে ? সেটা শুনে গম্ভীর হয়ে পড়লেন ডাক্তার কাঞ্জিলাল, বললেন, “আমাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওপেন বুক পরীক্ষা হয় জানেন ? মানে ছাত্রদের পরীক্ষার সময় বই দেখার অনুমতি থাকে। কিন্তু বইগুলো তো ইয়া মোটা মোটা! ওদের জানতে তো হবে প্রশ্নের উত্তরটা কোথায়! উল্লাস পুরো বইটা হয়তো উগরে দিতে পারবে কিন্তু তার মানে এ তো নয় ও বইয়ের সব কিছু বুঝেছে। বয়সটা তো ওর বারোই! ওকে এখন ওই সব চাপ দেওয়ার মোটেই দরকার নেই। এই রকম ট্যালেন্টেড বাচ্চাদের বেশি চাপ দিলে উল্টো ফল হয় প্রায়ই। আপনারা ওকে নিয়ে এত মাতামাতি করবেন না। দয়া করে ওকে ওর মতন থাকতে দিন। ওর ছেলেবেলা ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না। বড়ো হয়েও যদি ওর ওই ক্ষমতা থাকে তাহলে ও জীবনে অনেক কিছু করবে।

উল্লাসের সাথে কথা বলতে সে বলল, তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার আইসক্রিম আর মাংস। আর সবচেয়ে প্রিয় খেলা ক্রিকেট। ক্রিকেটারদের মধ্যে ওর সবচেয়ে প্রিয় কে জিজ্ঞেস করতে লাজুক হেসে বলল, ‘ধোনি

ও আমাদের আরো বলল যে, কাল থেকে ওর স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে যাচ্ছে, তাই ও খুব খুশি। আর যে কোনো সাধারণ ছেলের মতন উত্তেজিত সে।

গরমের ছুটিতে কী করবে জিজ্ঞেস করতে উল্লাস বলল, “মার সাথে বেলিপুকুর যাবো। ওখানে আমার মামার বাড়ি। মামাতো দিদির বিয়ে তো তাই। ভারি মজা হবে। সব ভাইবোনরা জড়ো হয়ে ক্রিকেট খেলব!

কথাগুলো শুনে কি মনে হচ্ছে ? যে কোনো একটা বারো বছরের ছেলের কথা তাই তো ? কিন্তু ওকে আমরা একটা বাংলা বই দিয়েছিলাম। ও সেটা উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর যখন জিজ্ঞেস করা হল, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫-এ কী লেখা আছে, উল্লাস গড়গড় করে বলে দিল।

অভাবনীয়! অবিশ্বাস্য!                

দুই

-ন্যাপলা, আজকের কাগজটা পড়েছিস ?

-না তো ! কী আছে কাগজে ? তুমি লটারি পেয়েছ নাকি ? না তোমাকে ভারতরত্ন দেওয়া হচ্ছে ?

-তুই থাম তো ! পেটে একবর্ণ বিদ্যে নেই আর শুধু ফ্যাচ ফ্যাচ !

-আহা রাগ করছ কেন ? কী আছে কাগজে বলই না।

-এই দেখ, এই খবরটা পড়ে দেখ।

-আঃ বঙ্কুদা, তুমি পড়ে দাও না। আমার পড়তে সময় লাগে।

-একটা ছেলের কথা লিখেছে। তার নাকি ফটোগ্রাফিক মেমরি !

-সেটা আবার কী ?

-যা দেখে তাই ওর মগজে ছবির মতন ছেপে যায় !

-অ্যাঁ বলে কী ! ওই রকম আবার হয় নাকি ?

-তাই তো লিখেছে। মোটা মোটা বই সব এক নিমেষে মুখস্থ করে ফেলে। ছেলেটাকে যদি একবার হাতে পাই না আমরা দুজনে কোটিপতি হয়ে যাবো !

-কেন ছেলেটার বাবার বুঝি দেদার পয়সা ?

-দূর বোকা, ওর বাবার তো সামান্য একটা মুদির দোকান। আমাদের চেয়েও গরীব। তোর বুদ্ধিতে কিছুটি হবে না। হাতির মতন চেহারা শুধু খাই খাই আর মগজে কিছু নেই। নন্দর দোকানের বিলটা কে দেবে শুনি ?

ন্যাপলা মাথা হেঁট করে বলল, ক্ষিদে পেয়েছিল যে! নিজের পকেট গড়ের মাঠ তাই তোমার খাতায় দিলাম তুলে।

-ঠিক আছে তাহলে আমার সাথে কাজে হাত লাগা। এমন পয়সা রোজগার হবে যে বিল নিজেই দিতে পারবি।

-কী কাজ ?

-ওই যে বললাম, ছেলেটাকে তুলে আনতে হবে।

-কিন্তু তুমিই তো বললে ওরা গরীব !

-যা বুদ্ধি তোর ! ওরা টাকা দেবে নাকি। আচ্ছা বল আমি কে ?

ন্যাপলা হেসে বলল, তা জানি না আবার! বঙ্কুদা!

-পুরো নাম ?

ন্যাপলা মাথা চুলকে জিভ কেটে বলল, ওই যাঃ! ভুলে গেছি মনে হয়! না, না মনে পড়েছে, মনে পড়েছে, বঙ্কুবিহারী দত্ত! কি ঠিক বলিনি ?

- হুঁ, আর আমার দাদা ?

-ও টিপুদা ? টিপুদা তো বিশাল লোক, কি সব গবেষণা-টনা করেন।

-ত্রিলোকবিহারী দত্ত। আলফা বিটা ইন্কের বড়ো গবেষক। আমাকে তো সে কিছু বলে না, কিন্তু মার সাথে তার কথা হয়। সে জানেও না যে আমি মার সঙ্গে দেখা করতে মাঝে-মাঝে বাড়ি যাই। মা-ই আমাকে ওর সব গবেষণার কথা বলেন গর্ব করে করে। মাঝে মাঝে উল্টো-পাল্টা কি সব করে, কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই। কিন্তু এবারে যেটা করেছে সেটা বেশ যুগান্তকারী মনে হচ্ছে।

ন্যাপলা উৎসাহের সাথে বলে উঠল, কী ? কী ?

-এক রকমের উদ্ভিদ থেকে তেল বার করেছে। পেট্রলের অর্ধেক দাম আর অর্ধেক পরিমাণে গাড়ি চলবে।

-সেটা কি বাজারে বেরিয়েছে ?

-না এখনো ফর্মুলার অবস্থাতেই আছে। ওরা পেটেন্টের চেষ্টা করছে। সেই ফর্মুলা যদি একবার হাতে পাই তাহলে বিদেশী কোম্পানিরা টাকার গদি পেতে দেবে আমার জন্যে !

-ফর্মুলা চুরি করবে ?

- না রে বোকা, চুরি করতে হবে না। চুরি করলে তো জেল খাটতে হবে। সেটা করতে আমি রাজিও নই। মন দিয়ে শোন, ছেলেটাকে তুলে নিয়ে আসবো। ফর্মুলাটা একটিবার দেখালেই তো তার মনে গেঁথে যাবে, পরে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে বিদেশীদের হাতে বিক্রি করবো।

- কিন্তু ছেলেটা যদি না রাজি হয় ?

- আলবাৎ রাজি হবে। তাকে রাজি করানো আমার কাজ।

-ফন্দিটা তুমি হেবি ফেঁদেছো গুরু! ছেলেটাকে আমি অনায়াসেই ধরে নিয়ে আসতে পারবো। এই তো খবরের কাগজে কেমন সুন্দর একটা ছবি দিয়েছে!

-ওরা এখন বেলিপুকুরে রয়েছে!

-আরে বলো কি!

-না হলে আর বলছি কি! দেশের অন্যপ্রান্তে হলে কি আর এত সব পরিকল্পনা করতাম ? তোর কাজ হল ছেলেটার মামার বাড়ি কোনটা সেটা খুঁজে বার করা। অসুবিধা হবে না, কারণ ওর মামাতো দিদির বিয়ে। কোন কোন বাড়িতে বিয়ে সেটা খুঁজে বার করতে পারলেই হয়ে যাবে। ওই টুকুনি তো ছোটো জায়গা!

-ও তাহলে তো আরোই সুবিধা হল! বিয়ের ওই হট্টগোলের মধ্যে ওকে সরিয়ে ফেলতে কোনো ঝামেলাই হবে না!

তিন

-এই স্বপন তুই উল্লাসকে খেলতে দিচ্ছিস না কেন ?

-ওরে বাবা মনে নেই গতবার ওকে ব্যাট করতে দিয়ে কি ঝামেলা হয়েছিল ? আউট হয়ে গিয়েও ব্যাট ছাড়ছিল না ! অন্য কাউকে ব্যাট করার সুযোগ কিছুতেই দেবে না। শেষে ব্যাট নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। এবারে আর ওই ভুল করছি না বাবা !

ওর কথা শুনে উল্লাস হেসে ফেলল, “স্বপনদা তুমি যেমন! তখন আমি কত ছোটো। এখন আর আমি ওই রকম করব নাকি!

- করবি না ঠিক বলছিস ?

- হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ! তাছাড়া এখন আমার বোলিং বেশি ভালো লাগে।

-এই খেয়েছে তাহলে তো এবার বলটা গেল! গতবার ব্যাট আর এবার বল। আচ্ছা নে বল কর না হয়।

একটু দূরে একটা ঝোপের আড়াল থেকে ন্যাপলা ওদের খেলা দেখছিল। উল্লাসের মামার বাড়ি খুঁজে বের করতে তার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। খবরের কাগজের ছবিটা থেকে কোনটা উল্লাস সেটা বুঝতেও কোনো অসুবিধা হয়নি। ওই তো ওইখানে ফিল্ডিং করছে ছেলেটা। বিয়েটা কালকে। কাল বিকেলের জন্যে সব কিছু প্রস্তুত। গাড়ি আজ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে। ন্যাপলা সকাল থেকে গাড়িটা চালিয়ে হাতও পাকিয়ে ফেলেছে। শুধু কালো গাড়ি পাওয়া যায়নি, গাঢ় নীল গাড়িতে কাজ চালাতে হবে। ভিলেনদের কালো গাড়ি না হলে মানায় ? কিন্তু কি আর করা যাবে। ক্লোরোফর্মের শিশিও পকেটে রেডি। বঙ্কুদার সেকেলে কায়দা পছন্দ আর ন্যাপলারও তাই। রুমালে ক্লোরোফর্ম ছেটাও আর সেটা নাকে চেপে ধরলেই কেল্লা ফতে আর কিছুটি করতে হয় না! এই রকম সাতপাঁচ ভাবছিল ন্যাপলা, হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ শুনতে পেল। কি হল ? এই যাহ! ক্রিকেটের বলটা ওর থেকে কিছুটা দূরে ঝোপের মধ্যে পড়েছে! কেউ একজন নিশ্চয়ই আসবে বলটা কুড়োতে। সে তো ন্যাপলাকে দেখে ফেলতে পারে। ঝোপের মধ্যে আরো সিঁটিয়ে গিয়ে লুকিয়ে বসল ন্যাপলা। অতবড়ো শরীর নিয়ে এইভাবে বসে থাকতে ভারি কষ্ট হচ্ছে। পকেট থেকে রুমালটা বার করে ক্লোরোফর্মে ভিজিয়ে নিল সে যদি ওকে দেখতে পায় কেউ তা হলে তার নাকে দিয়ে পালাবে। কেউ একজন আসছে। খচমচ করে শব্দ হচ্ছে! ঝোপের ফাঁক দিয়ে আড়চোখে দেখল ন্যাপলা। আরে এ তো উল্লাস ! মেঘ না চাইতেই জল। ন্যাপলা ঠিক করে ফেলল। গাড়ি আছে, ক্লোরোফর্ম আছে তাহলে কেন শুধু শুধু আজকের কাজটা কালকে করবে।

উল্লাস বলটা খুঁজছে।

-এই খোকা চকোলেট খাবে ?

-অ্যাঁ কে অঅপনি ? ছেলেটা আর কিছু বলার আগেই ধাঁ করে দেওয়া রুমালটা ওর মুখে চেপে দিল ন্যাপলা। ঢলে পড়ল ছেলেটা। গাড়ি ঝোপের ধারেই। একরত্তি ছেলেটাকে অনায়াসেই পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলে ফেলল ন্যাপলা। তারপরেই হুস্। ভাগ্যিস ভালো এদিকে আর কেউ নেই।

চার

- তোকে নিয়ে কোনো কাজ করা মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা !

বঙ্কুদার কথা শুনে ন্যাপলার ভারি রাগ হল। বঙ্কুদাটা যেন কেমন! এতবড়ো একটা কাজ করে আনল সে! কোথায় তার প্রশংসা করবে, বাহবা দেবে, তা না একগাদা কড়া কথা শোনাচ্ছে।

- কেন, কেমন সুন্দর কাজটা করে আনলাম ...!

-হ্যাঁ, তা করেছো কিন্তু সময় বলে একটা জিনিস আছে জানিস ?

-একদিনে কি বা হবে ?

-কালকে বিয়ে বাড়ির হট্টগোলের মধ্যে ও হারিয়ে গেছে সেটা বুঝে উঠতেই বাড়ির লোকেদের কিছুটা সময় লেগে যেত। এখন বল কুড়োতে গিয়ে হাওয়া হয়েছে, আধ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ চলে আসবে ! তাচাড়া আমি দাদাকে বলেছিলাম পরশু ওর সাথে দেখা করবো, এখন আর সেটা করা যাবে না, কালকেই করতে হবে।

ন্যাপলার দুটোর মধ্যে কোনোটাকেই সমস্যা বলে মনে হল না। অপহরণের কেস, পুলিশ তো আসবেই। আর দাদার সাথে পরশু না দেখা করে কাল দেখা করলে সমস্যাটা কোথায় ? বরঞ্চ তাড়াতাড়ি কাজ হবে।

ন্যাপলা মুখ হাঁড়ি করে বসে আছে দেখে বঙ্কুদা বলল, “নে নে অনেক হয়েছে আর গোঁসা করে বসে থাকতে হবে না। দাড়ি গোঁফটা লাগিয়ে নে। ছেলেটা উঠে পড়বে।

-আচ্ছা এই গোঁফ দাড়ি কেন ?

-কাজ হাসিলের পর সরে পড়তে সুবিধা হবে বলে। যা বলছি তাই কর। ছেলেটা নড়াচড়া শুরু করেছে। আর একদম বাড়তি কথা বলবি না।

সত্যি সত্যি ছেলেটা একটু পরেই চোখ খুলল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু চিনতে না পেরে বলল, “আমি কোথায় ?”

-আমাদের ভাঙা ঘরে! ন্যাপলা বলল।

এবার ধড়ফড় করে উঠে বসল ছেলেটা। চোখ রগড়ে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা ? আমাকে এখানে এনেছ কেন ?”

বঙ্কুদা এবার এগিয়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে কড়া স্বরে বলল, “তোমাকে ধরে আনা হয়েছে। আমরা কে সেটা জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না। একটা কাজের জন্যে তোমাকে এনেছি। কাজ শেষ হলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। চুপ করে থাকবে। কথা বললে টুঁটি টিপে দেবো।

ছেলেটা ভয়ে চুপ করে গেল।

ওকে একটা ঘরে বন্ধ করে বঙ্কুদা ন্যাপলাকে বলল, “যা এবার দাড়ি গোঁফ খুলে খাবার নিয়ে আয়।

-চার প্লেট আনবো বঙ্কুদা ?

-আবার চার প্লেট কেন ? তিনজন তো মানুষ।

-কালকে এক প্লেটে পেট ভরেনি। রাতে ঘুমোতে পারিনি খিদের চোটে।

-ঠিক আছে চার প্লেটই আন। এনে আমাকে দিবি। ছেলেটার খাবার আমি নিয়ে যাবো। তুই ওর ঘরে গেলেই মেলা বকবক করবে। কাল খুব ভোরে বেরুতে হবে। গাড়িতে তেল ভরে নিস্। ফোন করেছিলাম দাদাকে কালকেই দেখা করবে। আমি অবশ্য বৈজ্ঞানিক সোমেশ্বর সিংহ বলে নিজের পরিচয় দিযেছি আর তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট শৈবাল বোস।

-ওরে বাবা আমি তো বিজ্ঞানের ব-ও জানি না !

-সেই জন্যেই তো বলছি মুখে কুলুপটি এঁটে বসে থাকবি। যা করার আমি করব।

-কিন্তু তুমিই বা বিজ্ঞানের কি বোঝো ? নিজেই আমাকে বলেছো যে স্কুলের গণ্ডিও পেরতে পারনি !

- সে আমি বুঝব, তোকে ওই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই যা খাবার নিয়ে আয়।

পাঁচ

পরদিন সকালবেলা ন্যাপলাকে তুলে দিল বঙ্কুদা। টান-টান করে দাড়ি-গোঁফের ছদ্মবেশ পরে তৈরি হয়ে নিল। বঙ্কুদা নিজেও তৈরি আর ছেলেটাকেও গুম থেকে তুলেছে। ওর জন্যে কেনা নতুন প্যান্ট-শার্টও পরিয়েছে। ছেলেটাকে ঘর থেকে বের করার আগে বঙ্কুদা একটা লেকচার দিল, “তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। তুমি সেখানে যদি একটি কথা বলেছো তাহলে আজকের তোমাদের বিয়ে বাড়িতে বোমা ফেলে আসবো। আর তুমি যদি চুপটি করে বসে থাকো তাহলে আজ রাতেই তোমাকে ছেড়ে দেব।

ছেলেটা কোনো কথা বলছে না দেখে বঙ্কুদা আবার বলল, “কি কিছু বলছ না যে ?”

-বারে তুমিই তো বললে কোনো কথা না বলতে !

- আমার কথা বুঝেছ ?

- হ্যাঁ, একটা জায়গায় যাচ্ছি সেখানে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে। বুঝেছি।

- এই তো ভালো ছেলে, চলো।

গাড়ি করে ঘন্টা দুয়েক চলার পর টিপুদার অফিস আর ল্যাব চলে এল।

তিনজনে মিলে অফিসে যেতে রিসেপশানের মহিলা ওদের নিয়ে গিয়ে একটা অফিসে বসালেন।

-স্যার আসতে একটু দেরি হবে। আপনারা এখানেই বসুন, কেমন ? বলে মহিলা চলে গেলেন।

বঙ্কুদা উৎসাহিত হয়ে বললে, “এ তো একেবারে দারুণ ব্যাপার। এতটা সহজ হবে আমিও ভাবিনি! আমাদের সোজা অফিসে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল আর কেউ নেই! নাও উল­াস এবার কাজে লেগে পড়তে হবে। ওর যত তথ্য সব কিছু উনি ওই লাল মলাট দেওয়া খাতাতে লিখে রাখেন।

ন্যাপলা তাড়াতাড়ি গ্লাভ্স পরা হাতে খাতাগুলো নামিযে ফেলল, “এই খেযেছে এতো চব্বিশটা খাতা। কোনো সাল নেই! কি করে বুঝবো কোনটা নতুন ?”

- ওসব দেখার সময় নেই, চব্বিশটারই তাহলে ফটো করতে হবে।

উল্লাস তখনও ঠায় ফোনটার কাছে বসে রয়েছে দেখে বঙ্কুদা খাতাগুলো ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও নাও শুরু করো। বেশি সময় নেই। এতোগুলো খাতার সব কটা পাতা মনে রাখতে হবে।

-একটা কথা বলব ?

- হ্যাঁ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি বলো, এখুনি হয়তো টিপুদা এসে পড়বে !

- একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে।

- কি গণ্ডোগোল ?

-আমি তো উল্লাস নই।

-অ্যাঁ, উল্লাস নও ? তাহলে তুমি কে ? মিথ্যে বলার আর জায়গা পাওনি। এই তো কাগজের ফটো। দেখো, দেখো ব... মানে সোমদা।

বঙ্কুদা ন্যাপলার কাছ থেকে ফটোটা নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এতো তোমারই ছবি !

-আমি উল্লাস নই, আমি কল্লোল, উল্লাসের যমজ ভাই।

- সে কি! যমজ ভাইয়ের কথা তো ওরা কাগজে লেখেনি!

-সব কথা কি ওরা লেখে নাকি ? তাছাড়া আমাকে নিয়ে লেখবারও কিছু নেই। আমার তো আর ফটোগ্রাফিক মেমরি নেই উল্লাসের মতন।

- নেই ? তাহলে, অতগুলো টাকা গাড়িভাড়া, জামাকাপড়! বঙ্কু আর ন্যাপলা দুজনে কিছুক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ধপাস করে চেয়ারগুলোতে বসে পড়ল। ঠিক তক্ষুনি এক লম্বা ঝাঁকড়াচুল ভদ্রলোক অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন।

- আরে আপনারা এইভাবে বসে কেন ?

বঙ্কুদা কিছু বলছে না দেখে ন্যাপলাই সামাল দিল, “মানে ইয়ে বাইরে খুব গরম কিনা তাই সোমদার শরীরটা একটু ইয়ে।

-এমন সময় বঙ্কুদা একটা বিকট হাঁচি দিল। বিশাল হ্যাঁচ্চোটার পরই সে তার স্বভাব অনুসারে জয় মা!বলে উঠল। হ্যাঁচির চোটে আঠা দিয়ে লাগানো নকল গোঁফটাও খুলে ঝুলে পড়ল।

ত্রিলোকবিহারীর মুখ হাঁ, “অ্যাঁ বঙ্কু তুই ! এখানে কি করছিস ?

-মানে তোমার ওই উদ্ভিদ দিয়ে তেল বানানোর ব্যাপারটা মা আমাকে বলেছিলেন আর কি !

-ও! আর তুই ভাবলি সেবারের মতো আমার ফর্মুলা চুরি করবি ? তোর ভাগ্যি ভালো যে চুরি করিসনি ! ওই জিনিসটা এখনও ঠিক মতন স্ট্যান্ডার্ডইজ হয়নি। কিছুদিনে ওটাতে গাড়ি চালালেই ইঞ্জিনটা বিকল হয়ে যাচ্ছে। তুই যাকেই ফর্মুলা বেচতিস সে পরীক্ষা করেই বুঝতো ব্যাপারটা। তুই একটি পয়সাও পেতিস না। ফর্মুলা চুরি করবি বলে আমার সব নোটবুক নামিয়েছিস্ !

ঠিক তক্ষুনি একগাদা পুলিশ ঘরে এসে ঢুকল। ত্রিলোকবিহারী লাফিয়ে উঠলেন, “এ কি আপনারা কেন ?”

-আপনার রিসেপশানিস্ট মহিলা আমাদের ফোন করেন। উল্লাস কর্মকার ছেলেটি যে কাল বাড়ি থেকে উধাও হয় সে নাকি এখানে। এইতো ! সংগ্রাম সিং, ওকে নিয়ে চলো। আপনারা তিনজনও চলুন আমাদের সাথে। ভাগ্যিস ছেলেটা ইন্টারকাম টিপে রেখেছিল। মহিলা ঘরের সব কথা শুনতে পান।

ত্রিলোকবিহারী হাঁ হাঁ করে লাফিয়ে উঠলেন, “না, না, আমি ওসব কিছু জানি না। আমি তো এই এলাম, বিমলা তো আমায় কিছু বলেনি ! এ সব বঙ্কু আর ওর চেলা ন্যাপলার কাজ। ওরাই আমার ফর্মুলা চুরি করতে এসেছিল।

- ওসব জানি না, থানায় গিয়ে বলবেন যা বলার। চলো সংগ্রাম সিং, বুলাকি প্রসাদ।

ছয়

উল্লাস কর্মকার অপহরণকর্তাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ :

-অপহরণকারীদের তুমি কেন বললে যে, তুমি কল্লোল ? সত্যি সত্যি তো তোমার কোনো যমজ ভাই নেই !

-ওটা আমার একটা প্রিয় খেলা। আমার যদি ফটোগ্রাফিক মেমরি না থাকত তাহলে আমি যে সাধারণ ছেলেটা হতাম সেটাই হল কল্লোল। উল্লাসের পক্ষে সম্ভব ছিল না ওদের জব্দ করা কিন্তু কল্লোল ওদের কাৎ করে দিল। ওদের সমস্ত পরিকল্পনা পরিশ্রম পণ্ড করে দিল কল্লোল। ওরা এতই হতাশ হল যে পালাবার কথাও ভুলে গেল। আপনারা বারবার কাগজে আমার নাম ছেপে আমাকে সুপারম্যান করে দিয়েছেন, দয়া করে আর করবেন না। আমি সুপারম্যান নই, হতেও চাই না। উল্লাসের জীবন বড়োই কঠিন। আমাকে কল্লোল হয়ে বাঁচতে দিন !

তারপর একটু থেমে আবার বলল, “তাছাড়া ওইরকম ছিঁচকে বদমায়েসদের জন্যে কল্লোল কর্মকারই যথেষ্ট। ওদের জব্দ করতে ফটোগ্রাফিক মেমরি লাগে না, লাগে শুধু একটু উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহস।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ