Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ক্যালিডোস্কোপ ।। অমিতাভ গঙ্গোপাধ্যায়



অনুতোষমামার পোষ্টকার্ডটা গত সপ্তাহে এসেছে। মার কাছে লেখা চিঠি। অনেক দিন পরেই মনে পড়েছে অনুমামার। ছুটির দিন দেখে সকালবেলাই আবীর তাই চলেছে অশোকনগরে তার মামারবাড়ি। কতদিন যে যাওয়া হয়নি, কে তার হিসেব রাখে। অনুমামা চিঠিতে লিখেছে, পুরোনো বসত বাটিটা কোনোক্রমেই আর সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ভেঙে-চুরে যাচ্ছে দালানকোঠা। তাই শেষপর্যন্ত প্রোমোটারের হাতেই তুলে দিতে হচ্ছে। কথাবার্তা একরকম পাকাপাকি হয়েই গেছে। আইনসংক্রান্ত কিছু ব্যাপার-স্যাপার বাকি আছে। সে সব চুকেবুকে গেলে হয়তো পুজোর পর থেকেই বাড়ি ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়ে যাবে। আবীর যেন একবার তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এসে ছেলেবেলার সেই মামাবাড়ি দেখে যায়। আর তো সুযোগ পাবেনা কোনোদিন।

চিঠিটা পড়ার পর থেকেই চোখ মুছছিল মা। সেই কবে দেখা মামাবাড়ি। আবীরের চোখের সামনে সময়ের কুয়াশা সরিয়ে যেন ঝাপসাভাবে ভেসে উঠছিল। শেষবার যখন সে গিয়েছিল তখন ইস্কুলে নীচু ক্লাসে পড়ে। দিম্মা-দাদাই বেঁচেছিল তখনও। সেই তার শেষ যাওয়া। মার সঙ্গে গিয়ে বেশ কিছুদিন সে কাটিয়ে এসেছিল। বাবা যায়নি ওদের সঙ্গে। ও আবছাভাবে শুনেছিল মামার বাড়ির সঙ্গে কি রকম একটা ভুল বোঝাবুঝি চলছিল তখন বাবার। আবীরের এখন ঠিকঠাক মনেই পড়ছে না সে সব পুরোনো কথা। শুধু মার সঙ্গে দিনগুলো তার স্বপ্নের মতো কেটে গিয়েছিল, এইটুকুই মনে আছে।

জায়গাটার নাম সেনডাঙা। অশোনগর ইষ্টিশন থেকে অনেকটাই ভেতরের দিকে। তখন এদিকটায় খুব বেশি বাড়ি ঘরও ছিল না। ঝোপঝাড় জঙ্গল, এদিক-ওদিক ঝুপসো কলাবাগান আর ঘন হয়ে ওঠা বাঁশঝাড়। আর ছিল বড়ো বড়ো অনেক পুকুর। সন্ধ্যার পর শেয়াল ডাকত দল বেঁধে। তক্ষকের ভুতুড়ে গা ছমছম করা ডাক শোনা যেত শুনশান দুপুরবেলায়। তখন হাওড়ার শিবপুরে থাকত ওরা। হাওড়া থেকে অশোকনগর সেনডাঙার সেই প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে কতবার তার যাবার ইচ্ছে হয়েছে। বাবার জন্য যেতে পারেনি। বাবা রাগী মানুষ, বলতেও সাহস পায়নি আবীর। তার তখন মনে হত মামারবাড়িটা যেন এক বিসৃতপ্রায় রূপকথার গল্প। আজ বনগাঁ লাইনের ট্রেনে বহুদিন পরে যেতে যেতে অনেক কথাই মনে পড়ছে তার।

বদলীর চাকরির সুবাদে তারপর চলে যেতে হল উত্তরবঙ্গে। সুতরাং হাওড়ার পাট পাকাপাকিভাবে তুলে দিতে হল। প্রথমে জলপাইগুড়ি, তারপর সেখান থেকে কুচবিহার। আবীর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে সেখান থেকেই। তারপর অনেকদিন পরে আবার এই বদলী কলকাতাতেই। আবীর এ বছর স্কটিশচার্চ থেকে ইংরেজি নিয়ে পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দেবে। কতদিন মামাবাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। আজ এতদিন পরে অনুমামার এই মলিন পোস্টকার্ডটা যেন এক আকুল অনুরোধ নিয়ে হাজির হয়েছে তাদের কাছে। এবারে আর বাবা আপত্তি তোলেনি তার যাওয়ার ব্যাপারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। বাবার এতদিনের অসন্তোষ আর ভুল বোঝাবুঝি বোধহয় মনের মধ্যে অবশিষ্ট নেই আর। আবীর মনের মধ্যে অকারণেই এক ধরনের বিষন্নতা অনুভব করল।

ট্রেন সবে ছেড়েছে বারাসাত জংশন থেকে। শরৎ আসতে খুব বেশি দেরি নেই আর। এ বছর বৃষ্টিও ভালো হয়েছে। ভরা ফসলের সবুজ ক্ষেতগুলির দিকে তাকিয়ে আবীরের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। নয়ানজুলির ওপারে লম্বা একটা খুটির ওপরে বসে আছে গাঢ় নীল রঙের একটা পাখি। কে জানে ওটাই নীলকণ্ঠ পাখি কিনা। জানলা দিয়ে শনশন ছুটে আসা ঠাণ্ডা তাজা হাওয়ায় আবীরের যেন ঘুম পেয়ে গেল।

অশোক নগর স্টেশন থেকে অটো রিক্সায় সেনডাঙা অনেকটাই দূর। ভেতরকার রাস্তাঘাটের এখনও সেরকম সংস্করণ হয়নি। এবড়ো-খেবড়ো খোয়া ছড়ানো রাস্তা, ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলছিল অটো। দুপুরের আগেই আবীর পৌঁছে গেল মামাবাড়ি।

অনেকদিন পরে এলেও মামাবাড়ির সেই পুরোনো ছবিটা যেন একরমই আছে। আবীরের মনে হল সময়ের যেন কোনো ছাপ পড়েনি এখানে। রঙচটা, ইটবার করা দোতলা বাড়িটার একতলার সবগুলি ঘরই প্রায় তালাবন্ধ। অনুতোষ মামারা ওপরে থাকেন দুভাই নিজেদের সংসার নিয়ে। অনেকদিন পরে হলেও আবীরের চিনতে অসুবিধা হল না। অনুমামার একমাত্র ছেলে সুখেন ওরই বয়সী। হাবড়া কলেজে পড়াশুনো করছে। আবীরকে দেখেই প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরল।

-চিনতে পারছিস তো আমায় অবু। কত লম্বা হয়ে গেছিস। ফর্সাও হয়ে গেছিস আগের চেয়ে।

-নর্থবেঙ্গলের জল হাওয়ার সুফল হয়ত। আবীর মন্তব্য করল।

দুজনেই পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে হাসাহাসি করল অনেকক্ষণ।

হঠাৎ আবীরের একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেক দিনের পুরোনো একটা ঘটনা। তবু যেন স্মৃতির ধুলি ধূসর পর্দা তুলে মুখ বাড়াল হঠাৎ। কি যেন ছিল নামটা।

ক্যালিডোস্কোপ- হঠাৎই মনে পড়ল তার। এতদিনের পরেও ঐ তুচ্ছ সামান্য জিনিসটা স্মৃতির অতল গভীর থেকে ভুস করে জেগে উঠল। বারান্দার রেলিং ধরে সে তার দৃষ্টিকে ভাসিয়ে দিল অনেক দূরে। সেই ছোটোবেলার ঝাপসা হয়ে আসা হারানো দিনগুলিতে।

কি যেন এক পরবের মেলা বসেছিল সেবার এই সেনডাঙাতেই। ধর্মীয় কোনো উৎসব হবে হয়ত। অনুমামা তাকে কিনে দিয়েছিল একটা ক্যালিডোস্কোপ। সেই যে লম্বা চোঙের মতো জিনিসটা। যার মধ্যে ছিল কয়েক টুকরো ঝলমলে রঙীন কাঁচ। এমনভাবে সাজানো যে লম্বা চোঙটা হাতে ঘোরালেই কাঁচের নানারকম ফুলকারি নকশা তৈরি হয়ে যেত চোঙের মধ্যে। আগে কখনো এ জিনিস দেখেনি আবীর। সেই অল্প বয়সী দিনগুলোতে তাকে যেন ঠিক চুম্বকের মতো টানতে লাগল জিনিসটা। যেন এক স্বপ্নলোকের চাবিকাঠি এই ক্যালিডোস্কোপ। কিছুতেই সে হাতছাড়া করত না সদ্য পাওয়া এই সাতরাজার ধন মানিককে। কিন্তু যেদিন ওরা মামাবাড়ি থেকে ফিরে আসবে কলকাতায়, সেদিন অদ্ভুতভাবেই শখের জিনিসটা আর খুঁজে পেল না আবীর। তন্নতন্ন করে এদিক-ওদিক কতবার খুঁজে বেড়িয়েছিল, কোথাও পাইনি খুঁজে, দুঃখে আর হতাশায় চোখে তার জল এসে গিয়েছিল সেদিন।

দুদিন আগেই বাড়ির পুকুরে ছিপ দিয়ে তিতপুঁটি ধরা নিয়ে মামাতো ভাই সুখেনের সঙ্গে একটু হাতাহাতি হয়েছিল তার। সেই সুখেনও রাগ ভুলে গিয়ে তার সঙ্গে খুঁজে বেড়িয়েছিল জিনিসটা। আজ এতদিন পরে সেই স্মৃতি যেন তার নীরব বেদনা নিয়ে ভেসে উঠতে চাইছে। ইস্ মাঝখানে কতগুলো বছর যে পার হয়ে গেছে। ভেবে যেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল আবীর।

দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর নীচতলায় একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। অনেকগুলো তালাবন্ধ পুরোনো ঘর। তার একপ্রান্তে মান্ধাতা আমলের জিনিসপত্র ডাঁই করা একটা অনাদৃত ঘর। চারপাশে কেমন যেন এক পুরোনোদিনের গন্ধ। এই কতদিনের স্মৃতিজড়ানো বাড়িটা ভাঙ্গা হবে একদিন। এই পুরোনো ঘরদোর, বাঁধানো চাতাল কিছুই আর থাকবে না। একটা অনেক পুরোনো গল্প তার সমস্ত স্মৃতি নিয়ে চিরকালের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কেন যে মনটা ভারী হয়ে উঠছে তার। সুখেন খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কোথায় যেন একটু বেরিয়েছে। কি মনে হতে পুরোনো বাতিল জিনিসের ঘরটার সামনে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল আবীর। কি যেন সে ভাবছে। ঘরটা যেন এক অদৃশ্য চুম্বকের মতো টানছে তাকে। দরজায় মরচে ধরা অনেক পুরোনো একটা ভারী তালা। অন্যমনস্কভাবে একটু চাপ দিতেই তাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে তালাটা খুলে গেল। দরজাটা কি তাকে ইশারা করছে।

আবীর আর দেরী করল না। কি মনে করে ঢুকে পড়ল ঘরটায়। সাবেকী আমলের কাঠের ভাঙ্গাচোরা আসবাবপত্র ঘরের মধ্যে ডাঁই করা। অনেকগুলো লাল শালু দিয়ে বাঁধা ছোটো বড়ো বেতের চুবড়ি। কড়ি বসানো বিবর্ণ হয়ে যাওয়া দু-চারটে লক্ষ্মীর ঝাঁপি। একটা পুরনো আমলের গড়গড়া নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। এখানে ওখানে মাকড়শার জাল পাতা। বাইরের ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুরের কিছুটা ভেতরে ঢুকলেও অন্ধকার তেমন পাতলা হয়নি। দুটো পাল্লা খোলা কাঠের দরজাটার চৌকাঠে বসে একটা ডোরাকাটা বেড়াল অবাক হয়ে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকেই। যেন মনে হচ্ছে, এক বাদলা দিনের মেঘলা সকালবেলা। সোঁদা-সোঁদা একটা পুরনো দিনের গন্ধ ভাসছে ঘরের বন্ধ হাওয়ায়। তাকে লক্ষ্য করছে চোখে ভারী চশমা পরা আরশোলার দল। আবীর যেন আর বর্তমানে নেই। ফিরে গেছে কবেকার সেই ছেলেবেলায়। কোথাও কোনো শব্দ আর সে শুনতে পাচ্ছে না। শুধু পুরনো বাতিল হওয়া জিনিসগুলো অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগে হঠাৎ একটা আদ্দিকালের তোরঙ্গের দিকে ওর নজর পড়ল। তোরঙ্গটায় কোনো তালা লাগানো নেই। কি মনে হতে তোরঙ্গের ভারী পা্ল্টা তুলে ধরল আবীর। ভেতরে অনেকদিনের ডাঁই করা পুরনো পত্র-পত্রিকা। কে জানে কবেকার! উবু হয়ে বসে সাময়িক পত্রগুলো নাড়াচাড়া করছিল আবীর। কলেজস্ট্রীটের ফুটপাতে যেমন সে করে মাঝে-মাঝেই। পুরনো হয়ে যাওয়া পাতাগুলোর কেমন এক উদাস করা বিচিত্র গন্ধ। দু-চারটে পত্রিকা অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করে এবার সে উঠতে যাবে। হঠাৎই যেন আবীরের দম বন্ধ হয়ে এল। ওটা কি! পুরনো পত্রিকাগুলোর নিচের দিকে কি যেন একটা গড়িয়ে গেল ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে। সামান্য ঝুঁকে তোরঙ্গের প্রাচীন হিমগহ্বর থেকে এবার সে তুলে আনলো ধুলো মলিন বিবর্ণ বস্তুটাকে। সেই ক্যালিডোস্কোপ, সেই সাতরাজার ধন মাণিক তার! সেই কবেকার ছেলেবেলার, রাতের ঘুম কাড়া প্রিয় জিনিসটা। কোথায় লুকিয়ে ছিল এতদিন। ধুলোয় আর অনাদরে আসল রঙটাই বুঝি হারিয়ে গেছে তার। তার মনে হল, গাঢ় অভিমানে ক্যালিডোস্কোপ তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আবীরের চোখ ছলছল করে উঠল। হাতে তুলতেই কয়েক টুকরো বিবর্ণ রঙিন কাঁচ ভেঙ্গে পড়ল। ক্যালিডোস্কোপের সেই রঙিন স্বপ্ন বুঝি এতদিনে শেষ হয়ে গেল। বাইরের ঝুপসো আমগাছটায় একটা কাক ডাকছিল। আবীর অনেক্ষণ বসে রইল সেই ধুলি ধূসর মেঘের উপরে। হাতের মুঠোয় ধরা সেই ছেলেবেলাকার স্বপ্নলোকের চাবি, কেউ হয়তো লুকিয়ে রেখেছিল এখানে নিছক মজা দেখার জন্যই। আবীরের ইচ্ছে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষণ এই স্তব্ধ প্রাচীনতার মধ্যে সে বুঁদ হয়ে থাকে। হাতের মুঠোয় ধরা প্রিয় জিনিসটার দিকে কোমল চোখে তাকাল আর ফিসফিস করে বলে উঠল, ক্যালিডোস্কোপ, আমি তোমায় ভুলে যাইনি।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আগস্ট ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ