Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ছায়াবাজি ।। অবি সরকার



আগে শুধু সন্ধ্যে হলেই গা ছমছম করত মুন্নির। এখন যখন তখন ওর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। পড়তে বসে ডাইনে-বাঁয়ে-পেছনে কোনো দিকে তাকায় না। পড়ার বইতে চোখ রেখে ও দুলে-দুলে পড়ে। মনে হবে, মুন্নি বুঝি খুব মনোযোগী মেয়ে, পড়াশোনায় ভালো। মোটেও না। ও ভয়ে বইয়ের পাতার দিকে চেয়ে সিঁটিয়ে থাকে। এই বুঝি কোনো ছায়া আসে। এই বুঝি কোনে ছায়া কাঁপে- শক্ত করে পড়ার বই চেপে ধরে ও।

এমনিতে বেশ হাসিখুশি। দুষ্টুমিতে টই-টুম্বুর। এই তো সবে ক্লাস থ্রিতে উঠল। গানের গলাটি ভারি মিষ্টি। হারমোনিয়ামে রোজ রেওয়াজ করে। ইদানিং নাকি সেই গানেও ওর অনীহা। ওর ভয়, গান শুনে যদি ছায়ারা আসে! ওকে ঘিরে নাচে! যে দিদিমণি গান শেখাতে আসেন, তিনি কত বোঝান- কেউ আসে না, ছায়া কেন আসবে- সব ভুল-

সেদিন গান গাইছে, মায়াবন বিহারিনী হরিণী... ঝপ করে লোডশেডিং। অন্ধকার। ভেতরের ঘর থেকে মা চেঁচিয়ে বললেন, দাঁড়া, উঠবি না, আমি হারিকেন জ্বালিয়ে আনছি।

মুন্নি চিৎকার করে বলল, লাগবে না। তুমি হ্যারিকেন আনবে না। অন্ধকারই ভালো। অন্ধকারে ছায়া হয় না। হ্যারিকেনে ছায়ারা ঝুলতে-ঝুলতে আসে। বলে, ও হারমোনিয়ামে সুর ধরে চেঁচিয়ে গাইতে লাগল- আমি  ভয় করব না ভাই, করব না। দুবেলা মরার আগে-

একটা ছোটো মেয়ে অন্ধকারে একা গান গাইছে, কোন মা এটা মেনে নেবে ? অতএব হ্যারিকেন দুলিয়ে-দুলিয়ে মা এলেন, আর ঘরের চারপাশ থেকে সরু, মোটা, গোল, চৌক, লম্বা, বেঁটে নানাবিধ ছায়ারা নাচতে-নাচতে কেউ জানলা গলে, কেউ পর্দার পেছনে, কেউ খাটের তলায়, টেবিলের পাশে লুকিয়ে পড়ল। হ্যারিকেন টেবিল রাখার পর মায়ের মোটা ছায়া পেছনের দেওয়ালে স্থির হয়ে রইল। মুন্নির ডান দিকে হারমোনিয়ামের ঢাউস চৌকো ছায়ার সঙ্গে মুন্নির বসে থাকা ভঙ্গি একটা ধ্যাবড়া বাইসান হয়ে মেঝে আর দেয়ালের ফাঁকে আটকে রইল। মুন্নি চোখ বন্ধ করে দাঁত মুখ চোয়াল শক্ত করে অপেক্ষা করতে লাগল- কখন এই ছায়ারা ওকে গ্রাস করে নেবে। এই পৃথিবীতে ওর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। মনে-মনে শুধু বলতে পারল, মা তুমি আমাকে মারলে শেষে!

ডাক্তার, কবিরাজ, মনস্তাত্ত্বিক, কাউন্সিলিং- যে যা বলেছে সব করা হয়ে গেছে, কিন্তু মনের ভয় কাটেনি।

কাকার এক বন্ধু দুই হাতের ছায়া পর্দায় ফেলে হরেক রকম খেলা দেখায়। তাকে ডেকে ছায়ার মজা কত রকম হতে পারে দেখানো হল। চুক্তি করে সব দেখল মুন্নি। কোনো কথা বলল না। বন্ধুটি যাবার সময় মুন্নিকে আদর করে বলল, ছায়াকে খেলার সঙ্গী করে নাও, খুব মজা হবে।

মুন্নি তার হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে টিপে, ঘুরিয়ে দেখল। তারপর বলল, শিল্পীর হাত পবিত্র আর সুন্দর হাত, বলে চুপচাপ ঘরে চলে গেল।

ওর স্কুলের রাস্তায়, এক জায়গায় মাথার ওপর রেল ব্রিজ পড়ে। সেদিন দুটোয় বেরিয়ে শুনল, স্কুল বাস খারাপ। নিজের উদ্যোগে যেতে হবে।

ও বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে রিক্সা ধরতে আসছিল। আর তখনই ঝমঝম করে বিকট শব্দে একটা মাল গাড়ি ব্রিজের উপর দিয়ে চলতে লাগল। তলায় মুন্নি। দুপুর দুটো। লাইনের ফাঁক দিয়ে আর পাশ দিয়ে গাড়ির আলো ছায়া পড়তে লাগল মুন্নির সর্বাঙ্গে। মুন্নির মনে হল, শ-য়ে শ-য়ে দৈত্য ওকে পাথর ছুড়ে মারছে। আর পাথরের বহর কি লম্বা, বেঁটে, চ্যাপ্টা, কোনো কোনোটা তো আবার মুন্নির গায়ে ধাক্কা মেরে গেল। যতক্ষণ গাড়িটা ব্রিজ থেকে না গেল, মুন্নি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর বন্ধুরা ফিরে এসে বলল, কিরে দাঁড়িয়ে গেলি কেন ?

মুন্নি কথা বলল না। বন্ধুদের সঙ্গে চলল রিক্সা ধরতে। ওরা চারজন। নন্দিতা বলল, আজ হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করতে-করতে যাবি ? বেশ মজা হবে।

সবাই রাজি হল। বেশ খানিকটা পথ এসে ডান দিকে বেঁকে চলল। নন্দিতা হঠাৎ বলল, নাচতে-নাচতে যাবি ?

মুন্নি বলল, আমি গাইতে পারি, নাচতে পারি না।

-না না, আমরা নাচব।  নাচবে তো ছায়া।

মুন্নি থমকে গেল। -কই কোন ছায়া ? কোথায় ছায়া ? কার ছায়া ?

-ওমা, তুই অমন করছিস কেন ? খুব মজা হয়। আমরা তো অনেক খেলেছি। একটা খেলা আছে- ছায়াগুলোকে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে দৌড় করানো।

নন্দিতা নতুন বন্ধু। খুব ডাকাবুকো। মুন্নির অত সাহস নেই, বিশেষ করে ছায়ার ব্যাপারে-

রেলের কোয়ার্টার একপাশে। লোহার রেলিং। ২ইঞ্চি পাতি ২ইঞ্চি ফাঁকা, এভাবে বানানো বেড়া। রুপালি রং। ওরা পাশ দিয়ে চলল। ছায়া পড়ল ফালিফালি।

নন্দিতা বলল, ছোট্ আর পাশ ফিরে দেখতে থাক। ছায়া তো না, যেন জল তরঙ্গ- এই আছে, এই নেই, ঝির ঝিরে বৃষ্টির মতো আলোছায়া ঝরে পড়ছে!

বেড়া শেষ। একটা মোড়। ওদের মধ্যে অনুষ্কার বাড়ি সামনেই, তিনটে বাড়ি পরে। ও চলে গেল।

এতটা দৌড়ে মুন্নি হাঁপিয়ে গেছে। নন্দিতা বলল, আরো একটা খেলা আছে, পথেই হতে পারে। খেলবি ?

বেশ মজাই লেগেছে মুন্নির। বলল, কি  খেলা ?

-ছায়াবাজি। আমার দারুন লাগে। জানিস তো, আমার মামাবাড়ি কেষ্টনগরে। ট্রেনে করে যাই। যখন ছুটি পড়ে তখনই যাই। ছ-টা চল্লিশের লোকালটা ধরি। সঙ্গে কেউ না কেউ তো থাকেই। জানলার ধারে সিট না পেলেও আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ছায়াবাজি খেলি। লাইনের ধারে কত কিছু থাকে। কাঠের স্লিপার, লোহার বিম, পাথরের স্তুপ, কংক্রীটের খুটি। ময়লার গাড়ি। ভাঙা কোনো ওয়াগান। গরু,বাছুর, মোষ, ঝুপড়ি, লেপ-কম্বল, লোহার পাতের রেলিং, খেজুর গাছ, ডুমুর গাছ, কলা গাছ, ক্ষিরীষ, কার্পাস, অশত্থ- স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কত কি। কিন্তু আমি দেখি শুধু ছায়াবাজি। এইসব জিনিসের ওপর দিয়ে ছ-টা চল্লিশের লোকাল যখন ছায়া ফেলে দৌড়ায়, সে ছায়ারা কত যে লম্ফ-ঝম্প করতে-করতে উঁচু-নিচু ঢেউ, সাঁতরে, লাফিয়ে, ডিঙিয়ে চলতে থাকে- আবার কখনো কখনো সেই লম্বা নদীর মতো চলমান ছায়াটা বেঁটে হতে-হতে ট্রেনের তলায় অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন শুধুই রোদ্দুর আর রোদ্দুর। সে রোদ্দুর এসে আমার মুখেও পড়ে। তখন কিছু সময় টেলিগ্রাফের তারের ওঠানামা দেখি। ছয় থেকে পাঁচ চার তিন, তিন চার পাঁচ ছয়- খটাং করে পোস্ট পেরিয়ে আবার সে তার নামতে থাকে- ফের উঠে যায় উপরে। হঠাৎ নজরে আসে গাড়ির তলা দিয়ে জল আসার মতো ছায়াটা আবার আসছে- আসছে- চলল আবার চড়াই-উৎরাই ডিঙোনো-

-তোর মামাবাড়ি বাড়িটা তো দারুণ। মুন্নি উচ্ছসিত।

-সব মামাবাড়িই দারুণ। শুধু দেখতে জানতে হয়। নতুন করে দেখতেই শিখতে হয়। প্রতিদিন বদলায়- নিজেকে বদলাতে হয়। ছায়া নাচাবি-

কিছু না ভেবেই মুন্নি বলল, চল-

সামনেই রাইস মিলের বাউন্ডারি। করোগেট টিনের বেড়া। সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে, কিন্তু রাস্তা বরাবর। ওদের অর্ধেক ছায়া সেই টিনের বেড়ায়। পায়ের দিকটা মাটিতে শোয়ানো টিনের ঢেউয়ে তির-তির করে ছায়াগুলো নেচে উঠল- ওরা ছুটল- পায়ের দিকে ছায়া ঢেউ দিয়ে উপর-নিচ করে, রাস্তার ধারের খানা-খোন্দল, ঝোপ ডিঙিয়ে চলল। টিনের বেড়ার ছায়া চলল, কত্থক নাচতে-নাচতে। ঝড়ো বাতাসে কাঁপন  ধরিয়ে।

চড়কডাঙার মাঠের কাছে ওরা থামল। মিলের বেড়া গেছে বাঁ দিকে বেঁকে। সোনালীর বাড়ি এসে গেল।

রইল শুধু মুন্নি আর নন্দিতা। মুন্নিকে দেখে বলল, খুব ঘেমে গেছিস। চল, আইসক্রিম খাই। রিক্সার পয়সা তো বেঁচে গেছে।

ওরা আইসক্রিম খেতে খেতে চলল বাড়ির দিকে। নন্দিতা বলল, অনেকদিন পর আজ খুব মজা হল। তোরা ছিলি তাই। নইলে একা একা থাকা বাজিতে মজা নেই।

মুন্নি বলতে পারল না, ওর ছায়াতে খুব ভয়। মনে হয় ছায়াগুলো কোথাও ওৎ পেতে থাকে। হঠাৎ লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে। এটা বলতে খুব লজ্জা  করবে। তাই শুধু বলল, আমার একা একা ছায়া দেখতে ভালো লাগে না।

নন্দিতা সেই কাকুর বন্ধুর মতো হাত ঘুরিয়ে, আঙুল বেঁকিয়ে ছায়া বানিয়ে বলল, একা থাকলে আমি এই খেলাটা খেলি। তুই শিখবি ? ছায়াবাজি দারুণ মজার। ম্যাজিকও সুন্দর-

-তুই ম্যাজিকও জানিস নাকি ?

-একটু একটু, বলেই আইসক্রিমটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিয়ে, ডান হাতে পকেটে ঢুকিয়ে একটা পঞ্চাশ পয়সা বের করে দেখাল- এই হল পঞ্চাশ পয়সা, বলে মুঠো করল, আইসক্রিম চুষল, তারপর হাত খুলে দেখাল, কোথাও নেই। উলটে পালটে দেখাল কোথাও নেই। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মুন্নির কানের পাশ থেকে পঞ্চাশ পয়সা ধরে নিয়ে এল। বলল, এগুলো খুব সোজা, তোর ভালো লাগলে শিখিয়ে দেব।

-আমার ছায়াতে খুব ভয়। অকপট স্বীকারোক্তি মুন্নির। নন্দিতা থমকে দাঁড়াল। তারপর আবার চলতে চলতে বলল, আমি ছোটোবেলায় ঘরের দেওয়ালে আমার ছায়া দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার দুটো বিনুনি- কিন্তু ছায়াতে ছিল একটা। আমার মনে হল, ওই ছায়াটা আমার বিনুনি নিয়ে নিয়েছে। মা এসে আমার দুটো বিনুনি দেখিয়ে বলল, পাশ থেকে ছায়া দেখলে দুটো কি করে দেখতে পাবি ? একটা তো আড়াল। সেদিন থেকে আমি ছায়ার মতো বুঝে গেছি। ছায়ার নাড়ি-নক্ষত্র আমার মুখস্থ। তুই আমার সঙ্গে থাক। ছায়া তোর ন্যাওটা হয়ে পায়ে পায়ে ঘুরবে। ছায়াকে যদি বশ করতে পারিস, জানবি তোর মতো জাদুকর বিজ্ঞানী আর নেই। আমি তো ভাবছি এবার ছায়ার স্বাদ পরীক্ষা করব- কোন ছায়া কেমন খেতে। কি রে জমবে না ?

মুন্নি উৎসাহিত হয়ে বলল, জমে ক্ষীর।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ