অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। যথারীতি নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে রিসেপশনে গিয়ে পরিচয় দিতেই রুমের চাবি পেয়ে গেলাম। দেখি আগেই হোটেল বয় ব্যাগ নিয়ে রুমের বাইরে অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে ঢুকেই দেখলাম ঘরটা আগে থেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় খটকা লাগল, পাশের এ্যটাচড রুমটা তালা বন্ধ। অথচ ওই রুমটার লাগোয়া সমুদ্রের বিচ। থাকার পক্ষে একেবারে আদর্শ জায়গা। বয়কে বললাম, চাবি নিয়ে এসো, আমি ওই ঘরটায় থাকব।
-ওই রুমটা খোলা বারণ স্যার।
-কেন ?
-রাত হলেই ওখানে এক মেম ভূত দরজা খুলে বাইরের ব্যালকনিতে হাওয়া খান।
-মেম ভূত ? যতসব আজগুবি গল্প। তুমি চাবি নিয়ে এসো।
ছোটবেলা থেকেই আমার ডাকাবুকো বলে খুব খ্যাতি। ভূতের ভয়-টয় কোনোদিন পাইনি। এই হোটেলের সঙ্গে আমাদের অফিসের রিলেশন খুবই ভালো। আশাকরি পাশের রুমে থাকতে অসুবিধে হবে না।
পোশাক ছাড়ছি এমন সময় দরজায় নক। দেখি হোটেলের ম্যানেজার এসে উপস্থিত। তিনিও একই কথা বললেন। আমিও নাছোড়।
বললেন, দেখুন অবিনাশবাবু, আপনি আমাদের পরিচিত। জেনেশুনে তো আপনাকে বিপদে ফেলতে পারি না। আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। আজ অবধি ওই রুম থেকে কাউকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। রুমটি অভিশপ্ত, তাই প্লিজ, জেদ করবেন না।
-কিন্তু রাজীববাবু, আমি যে ওনাদের সঙ্গে মিট করতে খুব উদগ্রীব।
-এটা ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে না ?
-আমাকে কি বাচ্চা ছেলে মনে হয় আপনার ?
-ঠিক আছে এত করে যখন চাইছেন অগত্যা তাই হবে। তবে ভুল করেও ব্যালকনির দিকে যাবেন না। আর কোনো বিপদ বুঝলে সঙ্গে-সঙ্গেই ফোন করবেন।
যাক চাবিটা তাহলে পাওয়া গেল। এই রুমটিও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সবকিছুই আছে ঠিক-ঠাক। ঠিক করলাম জেগেই থাকব সারারাত। বেশ রোমাঞ্চ লাগছে। জীবনের একটা লক্ষ্য অন্তত আজ পূরণ হবে। তাই ডিনার সেরে চোখ খোলা রেখেই অপেক্ষায় থাকলাম চুপটি করে শুয়ে।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল করিনি। অনেক রাত্রে কিসের শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। একি, আলো জ্বলছে কেন! স্পষ্ট মনে আছে আলো বন্ধ করেই শুয়েছিলাম। তাছাড়া রাত্রিতে আলো অফ রেখেই ঘুমোনো আমার বরাবরের অভ্যাস। তাহলে আলো জ্বাললো কে! আরে, ওরা কারা! সাদা অ্যাপ্রোনে ঢাকা শরীর। রুমে ঢুকল কি করে! দরজা ভেতর থেকে বন্ধই তো ছিল। এখনো তেমনই আছে। তাহলে! তবে কি ওনারাই-তেনারা...! শরীরের ভেতর শিহরণ খেলে যাচ্ছে। হঠাৎ ভীষণ ঠাণ্ডায় কাঁপুনি দিয়ে উঠল। আমি কি ভয় পেয়ে যাচ্ছি! টেবিলের ওপর কেউ শুয়ে আছে মনে হল। কে ও! কি-ই বা করছে ওরা! কৌতুহল চেপে রাখতে পারি না, এ আমার অনেকগুলো বদভ্যাসের একটা। ওদের চোখ এড়িয়ে সন্তর্পণে বিছানা থেকে উঠলাম। ধীরে-ধীরে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। ওদেরকে চেনার উপায় নেই। মুখ অবধি ঢাকা। কিন্তু ছুরি-কাঁচি নিয়ে ওরা একি করছে! পেট কাটছে কার যেন! টেবিলে শোয়ানোকে ও! আমার মতই দেখতে! এরা কি তবে পেট কাটা ভূত! উফঃ! কি নৃশংস ব্যাপার! আমার মাথা ঝিম-ঝিম করে উঠল। এবার আমার সত্যিই ভয় পাওয়া শুরু। হাত-পা যেন পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। শ্বাসের শব্দ টের পাচ্ছি।
হঠাৎ ক্যাঁচক্যাঁচ, ওদিকের দেওয়াল থেকে গুপ্ত দরজা খুলছে। ওখান দিয়ে যিনি ভেতরে এলেন, তাকে দেখেই চমকে উঠলাম। বিজয়বাবু! এখানে! ঢুকেই চাপা গলায় বলে উঠলেন, প্রতীমবাবু আপনাদের কাজ কদ্দুর ?
-হ্যাঁ স্যার। কিডনি ঠিকঠাক আউটলেট করা গেছে।
-এবার সারা গায়ে নখের আঁচড় টেনে দিয়ে লাশটা জঙ্গলে ফেলে দিন। আর হ্যাঁ ম্যাডামকে ডাকুন। ব্যালকনিতে আর কতক্ষণ ঠান্ডায় বসে থাকবেন উনি। ওনারা পেমেন্ট করে দিয়েছেন। তাই দ্রুত ওনাকে ডেলিভারি করে ছেড়ে দিন। ভোর হয়ে এল যে।
-হ্যাঁ স্যার এই হয়ে এল। আর একটু।
এতক্ষণে বোঝা গেল ব্যাপারটা। ভূতের গল্প ফেঁদে বিজয়বাবু এখানে কিডনি পাচারের ব্যবসা করছেন। এ চলতে দেওয়া যায় না। আপনা-আপনি চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। এই কুখ্যাত গ্যাংটাকে পুলিশে দিতে হবে। প্রমাণ দরকার। কিভাবে তা করা যায় ভাবতে গিয়ে চোখে পড়ল বিছানায় বালিশের পাশে পড়ে থাকা আমার মোবাইলটা। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে ভিডিও ক্যামেরা অন করলাম। আশ্চর্য, কারোরই ছবি আসছে না! কেবল আমার লাশটা ছাড়া!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুন ২০১৯
0 মন্তব্যসমূহ