Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সবুজ রঙের বিড়াল ।। সায়ন্তনী বসু চৌধুরী



রুকুদের বিড়ালটা ভারী অদ্ভুত। যেমন বিদঘুটে তাকে দেখতে তেমনি তার জ্বালাতনের স্বভাব। সারাদিন ম্যাঁও ম্যাঁও করে কেঁদে যায়। মাছ দাও, দুধ দাও, ভাত দাও কিছুতে তার মন ওঠে না। খিদে পেলে খাবে নয়তো মুখ ফুলিয়ে জানলার ধারে বসে থাকবে। কোলে তুলে আদর করবেউঁহু! খবরদার নয়। ঘাড়ের লোম ফুলিয়ে সে তোমায় তক্ষুণি তেড়ে আসবে। গতবার বর্ষায় যখন চারদিকে জল থইথই তখন রুকুর মা বিড়ালটাকে তুলে এনেছিলেন। চায়না বাজারের ভেতর একটা বন্ধ কমিটির সামনে জড়ো করে রাখা স্যাঁতস্যাঁতে বস্তার গাদায় বিড়ালছানাটা পড়েছিল। এক্কেবারে একা। একরত্তি তুলোর বলটা ভিজে চুপসে গিয়েছিল। রুকুর মায়ের মায়া হয়েছিল খুব। তাড়াতাড়ি গায়ের ওড়না খুলে তাতে জড়িয়ে নিয়েছিলেন ছানাটাকে।

প্রথম দিন বিড়ালছানাটাকে দেখে রুকু মোটেই খুশি হয়নি। হবেই বা কি করে ? ওর তো চিরকালই কুকুরছানা পছন্দ। পার্কে খেলতে এসে রুকু আমায় বলেছিলজানিস রোদ্দুর দাদাবাজার থেকে মা একটা বিল্লি  নিয়ে এসেছে। একটুও মিশুকে নয় রেআদর করতে গেলেই রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।

আমি ওকে বুঝেছিলাম, দিন কতক যেতে দে। দেখবি কেমন ন্যাওটা হয়ে যাবে। আমাদের মোটা মেনিকে দেখিসনিআগে সবেতেই কেমন সন্দেহ করতো। অথচ এখন দেখ আমায় ছাড়া ওর চলেই না ।

রুকু নিমরাজি হয়ে ঘাড় নেড়ে ছিল।

রুকুদের বিড়ালের নাম মিউসিং। ছাই ছাই তার গায়ের রং। গোলা গোলা নীল চোখ। নাকটা গোলাপি। ঠোঁটের দু'পাশে বুড়োদের মত সাদা সাদা গোঁফ। দেখলেই মনে হবে ড্রইং খাতায় আঁকা একটা কার্টুন বিড়াল।  আমার তো আবার বিড়াল খুব পছন্দ। তাই একদিন সকালে আমি হাতে করে এক টুকরো মাছ নিয়ে মিউসিংকে দেখতে গিয়েছিলাম। মিউসিং আমায় দেখে ঘুম মেরে বসে ছিল। বিড়াল পটানোর যা যা টেকনিক আমার জানা আছে, একে একে সব কটা আমি এপ্লাই করেছিলাম। কিন্তু নাহ, একটিও কাজে লাগেনি। ধরা দেবো দেবো করেও মিউসিং ধরা দেয়নি। চলে আসার সময়  কাকিমনির হাতে মাছের টুকরোটা দিয়ে আমি বলেছিলামমিউসিং এর জন্য এনেছিলাম কিন্তু সে তো ছুঁয়েও দেখল না। দুপুরেও যখন খাবে মাছটা বরং তখনই দিও।

ঠিক সেই সময় এক লাফে মিউসিং আমার হাতের ওপর এসে পড়েছিল। আমি বাবাগো বলে চিৎকার করে দু-পা পিছিয়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ মিউসিং আমার কড়ে আঙুলটা আদর করে চেটে দিচ্ছিল।  মাছের টুকরোটার দিকে ওর কিন্তু একটুও মন ছিল না। আমার করে আঙ্গুলের সবুজ পাথরের আংটিটাকে চেটে চেটে দেখছিল মিউসিং। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলামকিন্তু কাউকে কিচ্ছুটি বুঝতে দিইনি। রুকুর মা কাকিমণি বলে্ছিলেন, দেখলি রোদ্দুর, মিউ ঠিক তোকে চিনে ফেলেছে।

আমি মুচকি হেসে বেরালটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছিলাম। তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রুকুর সঙ্গে মিউসিং-এর ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের বাড়ি আর রুকুদের বাড়ি কিন্তু পাশাপাশি নয়। দুটো বাড়ির মাঝখানে পড়ে আমাদের পার্কা আর খেলার মাঠ। বিকেলবেলা রুকু যখন মাঠে আছে মিউসিংও মিউ মিউ করতে করতে এসে হাজির হয়। সে এখন আগের চেয়ে অনেক বড়ো হয়েছে। তার চোখ-মুখ খানিকটা বদলে গেছে। ছোটো অবস্থায় তাকে দেখে মনে হয়েছিল ছাইরঙাকিন্তু এখন তাকে দেখলে যে কেউ বলে দেবে যে তার গায়ের রং ঘন শ্যাওলার মতো। মিউসিংকে দেখতে কিন্তু আমাদের দেশি বিড়ালের মতো নয়। তার গায়ে অনেক লোম। আর কানগুলো বেশ বড়ো বড়ো। একটা ব্যাপার আমি রোজ লক্ষ্য করি। আমাকে দেখলেই মিউসিংয়ের ভীষণ আনন্দ হয়। পায়ে-পায়ে আমার পাশে গা ঘেঁষে বসে। আমার কোলে মাথা রেখে শোয়। আর সুযোগ পেলেই আমার সবুজ পাথরের আংটিটা শোঁকে এবং চাটে।

এর মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল। মাস চারেক হল আমাদের মোটকা মেনির সঙ্গে মিউসিংয়ের ভারী দোস্তি হয়েছে। মেনির পিছুপিছু সেও এখন আমাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। সেদিন দুপুরে আমি বসার ঘরের সোফায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম।  পড়তে পড়তে কখন যে আমার চোখ লেগে গেছে আমি টেরই পাইনি। একটা অদ্ভুত গন্ধে হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি আমার বুকের ওপর সবুজ রঙের কি একটা জন্তু গোল হয়ে গুড়ি মেরে শুয়ে আছে। তার গা থেকে সবুজ রঙের আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আর সেই আলো আমার সবুজ পাথরের আংটিতে গিয়ে মিশে যাচ্ছে। মাগো বলে চিৎকার করতে গিয়ে দেখি আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ভয়ে আমি সোফাতে শুয়ে ঘামতে লাগলাম।  ততক্ষনে আমার নড়াচড়ায় সে জন্তু আমার বুকের উপর উঠে বসেছে। আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখছে আমি কি করি। ওমা! খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি সবুজ জন্তুটা তো অচেনা কেউ নয় আসলে।  ওতো রুকুদের মিউসিং! আতঙ্কে আমি যেই না চেঁচিয়ে উঠেছি, অমনি আমার বুকের ওপর থেকে লম্বা লাফে মিউসিং ঠিক ডাইনিং টেবিলের মধ্যিখানে গিয়ে পড়ল। কি আশ্চর্য! মিউসিংকে ঠিক অবিকল একটা সবুজ আলোর বাউন্সিং বল এর মতো দেখতে লাগছে। বলটা জ্বলছে-নিভছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে দাঁত বের করে হাসছে। হাসিটা ঠিক একটা মানুষের মতো! আমি উঠে বসার আগেই আমাদের মেনিকে নিয়ে জানলার বাইরে লাফিয়ে পড়ে মিউসিং গায়েব হয়ে গেল। আমি পড়ি কি মরি করে ওদের পেছনে দৌড়ালাম। কিন্তু জানলার বাইরে দুটো বিড়ালের একটা কেউ দেখতে পেলাম না। আমি সোজা রুকুদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। সেখানে গিয়ে দেখি মিউ আর মেনি রুকুদের বারান্দায় পাশাপাশি বসে আয়েশ করে মাছের কাঁটা  চিবুচ্ছে। আমাকে দেখে তাদের কোনো হেলদোল নেই। নিউ কিংবা মেও বলে একটিবার ডাকলোও না। রুকুর মা আমায় ভেতরে ডাকছিলেন কিন্তু আমি পড়ার অজুহাত দেখিয়ে চলে এলাম।

বাড়ি ফিরে প্রথমেই আমার বিজ্ঞানী দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদু আমার মায়ের মামা। অনেক বড় বিজ্ঞানী।  বিদেশে থাকেন। চুপি চুপি মায়ের মোবাইল ফোন থেকে আমি দাদুর নম্বরটা ডায়াল করলাম।  ওখানে এখন মাঝ রাত। দাদু যেন কি একটা জরুরি কাজ করছিলেনকিন্তু আমার গলা শুনেই ধরে ফেললেন।

তারপর মাষ্টার রোদ্দুরকি মনে করে সবকিছু ঠিক আছে তো নাকি কোন জটিল ব্যাপার ?

আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মিউসিং আর সবুজ আলোর ব্যাপারটা এক নিশ্বাসে দাদুকে জানিয়ে দিলাম। সবটা শুনে দাদু বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, ভেরি  ন্যাচারাল। আমি জানতাম ও আসবে।

জিজ্ঞেস করলাম কে ?

দাদু জবাব দিলেন মিউসিং। আমি তোমাকে আংটিটা দিয়ে কি বলেছিলাম রোদ্দুর মনে পড়ে ?

আমি বললামহ্যাঁ। আপনি বলেছিলেন নিচ্ছ নাওতবে খুব সামলে রেখো। যার জিনিস সেই সময়মতো এসে নিয়ে যাবে।

দাদু শান্ত গলায় জানালেনসে  সময় এখন আসন্ন। মিউসিং তার জিনিস নিতে এসে গেছে।  খুব সাবধানে থেকো দাদুভাই।

আমি তো মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। কে এই মিউসিং আর সবুজ আংটিটার সঙ্গেই পাতার কি সম্পর্ক!  উঠতে-বসতে খেতে-শুতে আমি কেবল একটাই কথা ভাবি। পড়াশোনায় মন বসে না। আংটিটা আমার কাছে আর থাকবে না! ভাবলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। রুকুর সঙ্গেও অনেক দিন দেখা নেই।  আমার মোটা মেনিও ইদানিং কেমন মন মরা হয়ে থাকে। খায়নাকাছে  এসে বসে না।

সেদিন বিকেলে হঠাৎ রুকু এসে হাজির। ওকে দেখেই আমি জিজ্ঞেস করলামমিউসিং কেমন আছে রে

মুখ বেজার করে সে বললমিউসিং ভালো নেই। তার খুব অসুখ। মনে হয় আর বাঁচবে না।

আমি অবাক হয়ে রুকুর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। সে আবারও বললমা মামার বাড়ি যাবার পর থেকেই মিউ একেবারে চুপ হয়ে গেছে। দিন রাত জানালায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কিচ্ছু খায় না। তুই একবার মিউকে গিয়ে দেখবি রোদ্দুর দাদা একা একা আমার খুব ভয় করছে।

আমার খুব কান্না পেল।  কেঁদে কেঁদে রুকুটারও চোখ ফুলে গেছে। ওর হাতটা ধরে বললামভয় পাস না, মিউ মরবে না। ওকে আমি ঠিক বাঁচিয়ে তুলব।

রুকুদের বাড়ি গিয়ে দেখি মিউসিংয়ের এখন-তখন অবস্থা। বারান্দার কোণে একটা চটের উপর শুয়ে আছে।  রোগা হয়ে হাড়গোড় সব বেরিয়ে পড়েছে। চোখ দুটো বোজা। রুকু বলল, সাতদিন কিছু খায়নি জানিস!

আমি হাঁটুমুড়ে মিউসিং-এর পাশে বসলাম।  হাত বাড়িয়ে আলতো করে ওর পিঠে সুরসুরি দিতে লাগলাম। মিউসিং নড়েও না চড়ে ও না! যেন একটা জড়বস্তু। অনেকক্ষণ ওইভাবে হাত বুলানোর পর ধীরে ধীরে চোখ খুললো। ওর চোখ আমার সবুজ পাথরের আংটির দিকে। আমার মনে হল মিউসিং যেন অনুনয় করে পাথরটা ফিরিয়ে দিতে বলছে। বিজ্ঞানী দাদুর কথা মনে পড়ল। দু'বছর আগে পুজোর সময় দাদুর সব পেয়েছির দেশ কাঠের বাক্সটা থেকে আমি যখন আংটিটা চেয়ে নিয়েছিলাম, তখন দাদু বলেছিলেন, এটা একজনের হৃদপিণ্ড। নিচ্ছ নাওতবে আংটি কিন্তু হারিয়ে ফেলো না। যার জিনিস সময়মতো সে যদি পাথরটা না পায়তাহলে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।  সেদিন আমি দাদুর কথাগুলো বানানো গল্প ভেবেছিলাম।  কিন্তু আজ….

আমি আঙুল থেকে আংটিটা খুলে মিউ-এর পাশে রাখলাম। আর কী আশ্চর্য, এক-দুই- তিন গোনার আগেই  সেই আংটির পাথর হওয়ায় উঠে বনবন করে ঘুরতে লাগল।

রুকু চেচিয়ে উঠে জাপ্টে ধরেছে আমায়। ওকে শান্ত করছি আমি। আর সবুজ পাথর থেকে ঘন সবুজ আলো ঠিকরে বেরিয়ে গোটা ঘর ভেসে যাচ্ছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আমরা হাঁ করে দেখছি। ভয় যে একেবারেই করছে না তা নয়কিন্তু মিউসিং আমাদের ক্ষতি করবে না। রুকু আর আমার সে বিশ্বাস আছে।

সবুজ আলো আর ধোঁয়ায় গোটা ঘর ভরে গেছে। মিউকে আমরা আর দেখতে পাচ্ছিনা। পাথরটা ঘুরতে ঘুরতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যেন সে পাথরের ভেতর বাজি পটকার মতো আলো আর ধোঁয়া ভরা ছিল। রুকু এতক্ষণে খানিকটা সাহস ফিরে পেয়েছে। হাত দিয়ে ধোঁয়া সরাচ্ছি আমরা। হঠাৎই ম্যাঁও'' করে একটা শব্দ হল। আমরা দুজনেই চমকে তাকালাম। মিউসিং আবারও সেই দিনের মতো সবুজ হয়ে গেছে। তার কান দুটো বদলে গিয়ে সরু সরু অ্যান্টেনার মতো হয়ে গেছে। জানলার ধারে সোজা হয়ে বসে আছে মিউসিং। তার গা থেকে সবজেটে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। রুকু একবার চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো, মিউ মিউসিং...

সবুজ বিড়ালটা আমাদের দিকে তাকিয়ে  দুবার ডাকল, “ম্যাঁও,ম্যাঁও...''। আর তৃতীয়বারে পরিষ্কার মানুষের ভাষায় সে বললথ্যাংক ইউ রোদ্দুরথ্যাঙ্ক ইউ রুকু।

আমরা হাঁ করে জানলার দিকে চেয়ে রইলাম আর মিউসিং থুরি সেই সবুজ রঙের বেড়ালটা জানলার গ্রিল গলে হাওয়াতে উড়ে গেল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৯



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ